সুনসান এখন সব সময় জমজমাট ম্যানহাটান। ছবি-লেখিকা।
আমি আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে থাকি। মধ্য ম্যানহাটানে। সেন্ট্রাল পার্ক ১৫ মিনিটের হাঁটা পথ, ইউনাইটেড নেশনসের অফিস ১০ মিনিট। অফিস, দোকান, রেস্তরাঁ, সব কিছুই একেবারে জমজমাট। টাইম্স স্কোয়ারে মানুষের ঢল, গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল বা পেন স্টেশনে চূড়ান্ত ব্যস্ততা। মিউজিয়াম, কনসার্ট, প্রতিবাদ-জমায়েত, রাস্তায় হকার, চাকাওয়ালা টিনের ডাব্বার মতো পুশকার্টে খাবার বিক্রি, মাটির নীচে ট্রেনের শব্দ, গায়ের উপর এসে পড়া গাড়ির হর্ন (এক মাত্র নিউ ইয়র্কেই কলকাতার মতো হর্ন শুনতে পাবেন)। আপাতত এই সবই ‘ছিল’তে আটকে আছে।
চার দিক সুনসান, মাঝে মাঝেই অ্যাম্বুল্যান্সের তীক্ষ্ণ আওয়াজ। এখন শহরে অপরাধ কমে গিয়েছে, অন্তহীন পুলিশের গাড়ির সাইরেন, হেলিকপ্টারের গুঞ্জন আর নেই।
আমার বাড়ি থেকে ইস্ট রিভারের দিকে তাকালে আকাশে অবিরত সি-প্লেন দেখা যেত জলের দিকে নামতে। তা আর নেই। অবশ্য বাস-সাবওয়ে সীমিত সংখ্যায় চালু আছে। যাঁরা জরুরি কর্মী, যেমন নার্স, সাফাই-কর্মী, তাঁদের কাজে যাওয়ার জন্য।
সকালবেলা সেন্ট্রাল পার্কে হাঁটতে যেতাম। শহরের মধ্যে থেকেও বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যেত। ৬ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে লকডাউন চলছে। এর মধ্যে আর যাইনি। তাঁবু খাটিয়ে হাসপাতাল হয়েছে সেখানে। ফেরার পথে কফি কিনতাম। কফি কেনা গেলেও মাস্ক পরে সে কফি খাওয়া যাবে না। বাড়ির সামনেই ফলবিক্রেতা হামিদের পুশকার্ট থেকে টুকটাক কিনে বাড়ি ঢুকতাম।
এই হামিদ বাংলাদেশের মানুষ, একে নিয়ে কিছু দিন আগে ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ একটা লেখা লিখেছিলাম। বাড়ির লবিতে ঢুকেই ডোরম্যানদের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়, খবরাখবর নেওয়া হত। এখন লবিতে অহেতুক দাঁড়িয়ে কথা বলা নিষেধ। কত প্রাত্যহিক অভ্যাস হারিয়ে গিয়েছে। মনে হয় যেন গত জন্মের স্মৃতি!
মার্চ মাসেই আমার বিল্ডিংয়ে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্তের খবর পাই। পেশেন্ট প্রাইভেসির কারণে কোন অ্যাপার্টমেন্ট, তা আমাদের জানানো হয়নি। আমি থাকি তেইশ তলায়। লিফটে উঠতেই হয়। মাস্ক পড়া থাকলেও অজান্তেই দম বন্ধ করে ফেলি। মনে হয় যিনি এই মাত্র লিফ্ট থেকে বেরলেন, তাঁর ছেড়ে যাওয়া প্রশ্বাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছি! এই ঘেঁষাঘেষি শহরে আজ প্রায় ১২ বছর আছি, অফিসটাইমের সাবওয়ে চড়েছি অজানা মানুষের গায়ে গা লাগিয়ে, এ ভাবে কখনও ভাবিনি।
রমজানের মাস চলছে, অন্যান্য বছর সপ্তাহান্তে এক বার জ্যাকসন হাইটস-এর বাংলাদেশি পাড়ায় যেতাম বিভিন্ন ধরনের ফুলুরির টানে, যা বছরের এই সময়ই শুধু পাওয়া যায়, কিন্তু এ বছর লকডাউন উঠে গেলেও ওই ভিড়ে যেতে সাহস পাব না। করোনাভাইরাস আমাদের চিন্তায়, ব্যবহারে শিকড় ছড়িয়েছে। সেই পুরোনো জীবনে বোধহয় আর কোনও দিনই ফেরা যাবে না, ফেরাটা সহজ হবে না।
আরও পড়ুন: কোন জেলায় করোনা আক্রান্ত কত, মৃত কত, তালিকা দিল রাজ্য সরকার
আরও পড়ুন: কেন্দ্রীয় সহায়তা চায় তৃণমূল, বিজেপি রাজ্যে
এখানকার সামাজিক জীবন বেশির ভাগই ঘরের বাইরে। তাই এই ছন্দপতন আরও অস্বাভাবিক লাগছে। নিউ ইয়র্ক বড়ই একাকী শহর। কারও জন্য কারও বিশেষ সময় নেই। গৃহবন্দি থাকায় এখন আমরা একে অপরের খোঁজ নিচ্ছি অনেক বেশি। জানান দিচ্ছি, ‘এখনও আছি!’ জানলায় বা বারান্দায় মানুষ সচরাচর দেখা যায় না, কিন্তু এখন প্রতি সন্ধ্যা ৭টায় সবাই বারান্দায় বেরিয়ে আসেন, জানলা খুলে দেন, আর থালা-বাসন বাজিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিবাদন জানান। সরকারের নির্দেশে নয়, একেবারেই স্বতঃপ্রণোদিত। যে শহরে মানুষ প্রতিবেশীর সঙ্গে কথা না বলে প্রতিবেশীর কুকুরের সঙ্গে কথা বলে, সেই শহর আজ চোখ রাখছে প্রতিবেশীর চোখে, খুঁজছে জীবনের আশ্বাস মানুষের কাছে।
অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাগ নিউ ইয়র্ক শহরে যত প্রকট, আর কোথাও বোধহয় ততটা নয়। এই দুঃসময় তা আরও সামনে এনেছে। আমরা অনেকেই সব কিছু হোম ডেলিভারি নিচ্ছি, দোকানের লাইনে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নিচ্ছি না। আর এই ডেলিভারি যাঁরা করছেন, তাঁদের না বেরনোর যে উপায় নেই! স্বাস্থ্য-সুরক্ষা নেই অনেকেরই। অভিবাসী অনেকের এই দেশে থাকার সঠিক কাগজপত্র নেই। সম্প্রতি অভিবাসনের নিয়ম অনেক বেশি কঠোর হওয়ায় এঁরা অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে সাহস পান না। যে সব দিনমজুরির কাজ এঁরা করতেন, রেস্তরাঁ পরিষ্কার, পরিচারিকার কাজ, সেই সবই খুইয়েছেন, কিন্তু সরকারি সাহায্য পাচ্ছেন না। পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী এই শহরে ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করেন। প্রতি ১২৫ জনে এক জন গৃহহীন। সরকারি আশ্রয়ও আজ এঁদের কাছে ভীতিজনক, কারণ যেখানেই অনেক অরক্ষিত মানুষের ভিড়, সেখানেই ভাইরাসের দাপট। নিউ ইয়র্কের উজ্জ্বল আলোর নীচে যে অন্ধকারে থাকেন এঁরা, তা আজ গাঢ়তম। এই শহরের এক ইঞ্চি জমিও মহার্ঘ, ৬ ফুট দূরত্ব এ সব মানুষের নাগালের বাইরে। আর বিত্তশালী মানুষ যাঁরা, তাঁরা অনেকে সেই প্লেগের সময়ের মতো মৃত্যুনগরী ছেড়ে তাঁদের শহরতলির বাড়িতে চলে গিয়ে একই রকম বিলাসী জীবন কাটাচ্ছেন। আমার উল্টো দিকের আকাশচুম্বী অট্টালিকা আজ প্রায়ান্ধকার নিঝুমপুরী।
কিন্তু পালিয়ে কত দিন? ভাইরাস-জনিত পরিস্থিতি এই অসম ব্যবস্থার যে ভয়ঙ্কর চেহারা প্রকাশ করেছে, তা না বদলালে কোনও দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। যাঁরা সুরক্ষিত নন, এই ভাইরাস তাঁদের মধ্যে দিয়ে স্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়তেই থাকবে।
তবে বাণিজ্য বন্ধ থাকায় শব্দদূষণ, আলোকদূষণ অনেক কমেছে। আমার অঞ্চলের আকাশ রাতেও এত আলোয় ভরে থাকে যে তারা দেখা যায় না। এখন দেখা যাচ্ছে। ভোরের দিকে পুব আকাশে শুকতারা নিষ্কম্প জ্বলজ্বল করে। মিটিমিটি তারারাও। এই মৃত্যুমিছিল এক দিন শেষ হবে, দুরন্ত গর্জনে ব্যস্ততা আবার বিপুল তরঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে আমাদের, আমাদের আবার সময়ের অভাব হবে, এই ভিড়ের শহর আবার ভীষণ অন্তর্মুখী হবে। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, আজকের এই কোলাহলবিহীন ভোরের জন্যে, খুঁজে পাওয়া এই শুকতারাটার জন্যে, সে দিন মন কেমন করবে আমার।
শতরূপা ঘোষ রায়, নিউ ইয়র্ক, আমেরিকা।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে)