কে বলবে এটাই জনবহুল বস্টন? ছবি- লেখক
ক্যালেন্ডারের পাতায় আমাদের দেশে এখন বৈশাখ মাস এসে গেলেও আমেরিকায় এখনও বসন্ত বা ‘স্প্রিং’। এই বসন্তকালের সবচেয়ে চনমনে দু’টো মাস হল এপ্রিল আর মে। কথায় বলে, ‘এপ্রিল শাওয়ারস্ ব্রিং মে ফ্লাওয়ারস’! আমার বর্তমান বাসস্থান ম্যাসাচুসেটস্ রাজ্যের রাজধানী বস্টন শহরের পার্শ্ববর্তী একটি ছোট শহরতলি। সেখানে বরফ-ঠান্ডা ‘সিলভার লাইক উইন্টার’ একটু-একটু করে বৃষ্টিতে ভিজে ‘মেল্টস্ ইন্টু স্প্রিং’ গানের মতই হাল্কা হলদে-সবুজ ঘাসের পাতায় আর গাছের ডালে কুঁড়ি ফোটানোর উপক্রম শুরু করেছে ক’দিন ধরে। এই বিশাল মহাদেশের অন্যান্য অংশের তুলনায় উত্তর-পুর্ব প্রান্তের কয়েকটা রাজ্যে, যাদেরকে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক ভাবে নিউ ইংল্যান্ড বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে, সেখানে রঙিন বসন্ত আসতে একটু বেশিই সময় লেগে যায়।
একরঙা শীতের দিন শেষ হয়েও যখন শেষ হতে চায় না, তখন বিবিধ রঙের ফুলের শরীর অল্পস্বল্প মাথা তুলতে শুরু করে এ মাসের মাঝামাঝি। তার পর রং ধরতে থাকে চেরি ফুলে আর ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ’য়। আর সেই ফুলের জলসার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জ্যাকেটের আস্তরণ খুলে ঘরের তাপমান-নিয়ন্ত্রিত উষ্ণতা ছেড়ে বাইরের রাস্তায়-পার্কে-জগিং ট্রেলে-পাবে-দোকানে-বাজারে সব জায়গাতেই রঙিন মানুষের ঢল নেমে আসে এই রঙিন প্রকৃতির ক্যানভাসে। বস্টন, কেমব্রিজ ও তার চার পাশের শহরের বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি আর কলেজগুলো প্রস্তুতি নিতে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশনের। আর বিজ্ঞান, শিল্প এবং মেধাচর্চার পীঠস্থান হিসেবে সারা বছর জুড়েই চলতে থাকে আটলান্টিক মহাসাগরের পারে লোগান এয়ারপোর্ট থেকে মানুষের আনাগোনা।
কিন্তু এ বছর বসন্তের এই দিনগুলোয় বাইরের প্রকৃতি রঙিন হয়ে উঠতে শুরু করলেও মানুষ বেরঙিন হয়েই আজ ঘরের ভেতরে বন্দি। ক’দিন আগেও বস্টন-কেমব্রিজের কলেজ ক্যাম্পাস আর অফিস-চত্বরে মানুষের সঙ্গে মানুষের হাসি-কথা-গল্পের যে স্বাভাবিক আদানপ্রদান হতো; গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তা পাল্টে গেছে বেমালুম। করোনাভাইরাসের প্রকোপে মানুষের মুখের হাসি মুছে গিয়ে তাতে লেগেছে দুশ্চিন্তার প্রলেপ, চোখের কোণে জেগেছে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে তাকানো ভয়ের সঙ্কেত। এই ভয়, এই চিন্তা, গোটা রাজ্যের অধিবাসী প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষের মধ্যেই এখন ছেয়ে গিয়েছে; বা গোটা দেশটার তিরিশ কোটি মানুষের মধ্যে।
এ বছরের শুরুর দিনগুলোয় অন্যান্য দেশের মতো এই দেশটাও চিনে কী চলছে, তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামায়নি। তার পর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে ইউরোপের, বিশেষ করে, ইতালির খবর দেখতে দেখতে, আর মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে কোভিড-১৯-কে ‘হু’-র তরফ থেকে অতিমারি ঘোষণা করার পরেই চার পাশের ছবিটা পাল্টাতে থাকে খুব দ্রুত গতিতে। দেশের দু’প্রান্তের দু’টি শহর সিয়াটেল আর বস্টনের দুই বিমানবন্দর হয়ে মানুষের শরীর বেয়ে পশ্চিম ও উত্তর-পুর্বের রাজ্যগুলোয় প্রায় ঝড়ের গতিতে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। আর আজ এপ্রিলের মাঝামাঝি পার হয়ে আমেরিকায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৮ লক্ষেরও বেশি। মৃতের সংখ্যা ৬৫ হাজার; যা প্রতি দিনই বেড়ে চলেছে।
এই মৃত্যুমিছিলের শুরু সিয়াটেল শহরকে কেন্দ্র করে হলেও; সেই কেন্দ্রবিন্দুটি গত ক’সপ্তাহ ধরেই ছিল আমার এক সময়ের বাসস্থান নিউ ইয়র্ক শহর; আর তার পাশাপাশি নিউ জার্সি, অদূরের পেন্সিলভেনিয়া রাজ্য। আর আমাদের এখনকার বাসভূমি ম্যাসাচুসেটস্ রাজ্যে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় দু’হাজারের কাছাকাছি। প্রতিটা দিনের সময়ের হিসেব এখন যেন শুধুই মৃত মানুষের সংখ্যার হিসেব।
এই মৃত্যুর ক্যালেন্ডারের মধ্যে দিয়েই আমাদের একেকটা দিন আসছে, রাত বাড়ছে। কাকতালীয় ভাবে ১৩ মার্চে, যা ছিল ‘ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ’, সেই দিনটা থেকেই আমি ও আমার স্ত্রী দু’জনেই অফিসিয়ালি ঘরবন্দি হয়ে আছি। তবে নিজেদের পেশাগত কাজ সবই চলছে ঘরে বসেই, ল্যাপটপের স্ক্রিনে, ভার্চুয়াল মিটিংয়ের ভিডিয়োর মুখোমুখি হয়ে। নিজেদের হোম-অফিসে বসে সকাল থেকে বিকেল অবধি একটানা কাজের পর একটু অবকাশ নিয়ে খানিকটা রিচ্যুয়ালের মতই ভিডিয়োর সামনে বসে পালন করা হচ্ছে ‘হ্যাপি আওয়ার’।
‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’! ঠারেঠারে বুঝেছে বস্টন। ছবি-লেখক।
স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে হোম-স্কুলিং করছেন বাবা-মা। সবাই চাইছেন যতটা সম্ভব একে অন্যের ভাবনার সামিল হতে। কর্মস্থলের কলিগ খোঁজ নিচ্ছেন অন্য কলিগদের, তাদের আত্মীয়স্বজনদেরও। আর দূরে থাকা নিজের দেশের কথা তো প্রতি মুহুর্তেই মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে আমাদের মত সব অভিবাসীদের মনের ভেতর। প্রায় প্রত্যেকেই কোনও না কোনও চেনাজানা মানুষের কথা জানতে পারছেন, যিনি কোভিড-১৯-এর টেস্ট পজিটিভ দেখা দিয়ে সেল্ফ-কোয়রান্টাইনের গহ্বরে লুকিয়ে রয়েছেন পরিবারের বাকি সবাইকে সাবধানে রাখার জন্য। কেউ বা শুনেছেন চেনা মানুষের মৃত্যুর খবরও। এ দেশে অনেকেই কর্মরত ডাক্তার বা নার্স অথবা স্বাস্থকর্মী। আক্রান্ত মানুষ এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত মানুষদের জন্য প্রতি মুহূর্তেই ভেবে যাচ্ছেন সবাই। প্রত্যেকেই একে অন্যের সমব্যাথী হয়ে উঠছেন; সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন চ্যারিটি সংস্থাগুলোয়। চেষ্টা করছেন যতটা সম্ভব নিজেদের ও আশপাশের মানুষদের ঠিক রাখার। আমরা, যাঁরা শহরতলীর গাছপালাঢাকা বাড়িগুলোয় থাকি, তাঁরা এই ‘ওয়ার্ক-ফ্রম-হোম’ রুটিনে যোগ করে নিয়েছি খানিকটা শরীরচর্চার রুটিনও, সকালে-বিকেলে। হাঁটার সময় পড়শিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে মেনে চলছি সেফ-ডিস্ট্যান্স। গ্রসারি স্টোরে ঢোকার সময় আগে থেকেই প্ল্যান করে নিচ্ছি কোন আইলে কি পাওয়া যাবে ভেবে। এ দেশে এমনিতেই স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ঘরের সব রকম কাজ সমান তালেই করে অভস্ত। তাই সকলেই অল্পবিস্তর ঘরোয়া ট্যালেন্টে শান দিয়ে চলেছেন। তার সঙ্গে অল্পবিস্তর সময় করে নিচ্ছেন গানবাজনা, নাচ, আলোচনাচক্র, যে যতটা পারছেন। আর স্যোশাল-মিডিয়ায় দিনের শেষে চলছে কথোপকথন, আড্ডা। কাজের ফাঁকে সময় পেলে উঁকি দিয়ে দেখে নিচ্ছি আমার ফেলে আসা শহর কলকাতায় বন্ধুরা, পরিজনেরা, শিল্প-সাহিত্যের প্রিয় মানুষরা, কে কী ভাবছেন, বলছেন।
ফিজিকাল জন্মদিন আর বিবাহবার্ষিকীর সেলিব্রেশনও শুরু হয়ে গেছে ভার্চুয়াল জগতের পাতায়। অথবা যে বন্ধুকে নিয়ে সেলিব্রেশন, তাঁর বাড়ির ড্রাইভওয়েতে গাড়ি নিয়ে অন্য বন্ধুরা এসে শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছেন গাড়িতে বসেই। বাড়ির বারান্দার সামনে নামিয়ে রাখছেন শুভেচ্ছাবার্তা-সহ ফুলের তোড়া। কাল কী হবে বা হতে পারে সবাই এই কথা জেনেও নিজেদের মতো দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা করছেন জীবনটাকে সচল রাখার।
আরও পড়ুন: চিনের ‘ব্যর্থ’ ওষুধেই দিশা দেখাচ্ছেন মার্কিন বিজ্ঞানী
আরও পড়ুন: সংক্রমণ সাগর দত্ত হাসপাতালে, ১৭ চিকিৎসক-সহ কোয়রান্টিনে ৩৬
তবে এই কথাগুলো তো আমাদের মতো বাড়িতে বসে যাঁরা কাজ করতে পারছেন তাঁদের কথা। কিন্তু বহু মানুষের ক্ষেত্রেই এই ছবিটা পুরোপুরি আলাদা। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দেশজুড়ে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ কর্মসংস্থানহীন। এই লকডাউনের সময় তাঁদের বাড়িতে বসে থাকা প্রায় অসম্ভবই হয়ে উঠছে প্রতি দিন। ভারতের ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষের মতো এ দেশেও একটা কথা আছে; ‘লিভিং পে চেক টু পে চেক’। শুধু কর্মসংস্থানে কর্মরত মানুষই নয়; এ দেশে বহু মানুষের পারিবারিক ছোটছোট দোকানপাট, ব্যবসা রয়েছে; যাকে বলা হয় ‘মাম-অ্যান্ড-পাপ-স্টোর’ বা ‘স্মল বিজনেস’। তারা এই লকডাউন কোয়রান্টাইনের সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। ঘরবন্দি হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে ন্যূনতম ‘সেফটি-নেট’ থাকা দরকার, অনেকের সেই পুঁজিটুকুও নেই। অন্য দিকে রয়েছেন সেই সব মানুষ, যাঁরা ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার; কৃষক থেকে শুরু করে কনস্ট্রাকশানম্যান। তাঁরা মুখে মাস্ক বেঁধে প্রাণের ভয় তুচ্ছ করে চালু রাখছেন পরিষেবা। যাঁদের জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। হয়তো পৃথিবীর সব দেশের সব শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা একই। কোভিড-১৯ যে সব মানুষকেই এক লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-কর্ম কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই, সেটা ঠিক। কিন্তু এর ধাক্কা সবচেয়ে বেশি লাগছে সেই সব মানুষদের উপর, যাঁরা গরীব ও প্রান্তিক ভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার।
এপ্রিলকে নিয়ে কবি টি এস এলিয়টের সেই অমোঘ লাইন ‘এপ্রিল ইজ দ্য ক্রুয়েলেস্ট মান্থ’-এর কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের হাতছানি দিয়ে আশার আলো জ্বালিয়েও আবার প্রকৃতির চেহারা পাল্টে নিরাশার অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া ‘ওয়েস্ট ল্যান্ডস’ কবিতার এই হতাশাকেই আশায় বদলে দিতে চাইছেন সব মানুষ। বস্টনের একাধিক গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও চেষ্টা করছেন, যে যে ভাবে পারেন লড়াই করে যাওয়ার। এই পাল্টাতে থাকা প্রকৃতির সঙ্গে ‘আর্থ ডে’ কাটিয়ে মা-ধরিত্রীও হয়তো আমাদের সকলকেই সঙ্কেত পাঠাচ্ছেন পৃথিবীটাকেও সুস্থ রাখার কথা মনে করিয়ে দিয়ে।
‘বস্টন-স্ট্রং’ স্লোগানে বিশ্বাসী মানুষ এই নিউ ইংল্যান্ডের আরেক সর্বজনপ্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার লাইন নিয়ে রাতের ঘুমের আগে প্রার্থনা করছেন ‘অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ’! হয়তো আগামী কাল সত্যিই নিয়ে আসবে করোনাভাইরাসমুক্ত একটি নতুন দিন!
অলকেশ দত্তরায়, বস্টন, ম্যাসাচুসেটস্
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)