লকডাউনে সুনসান সিডনি অপেরা। ছবি: রয়টার্স
আমরা এখন অনেকটাই ভাল আছি। লিভারপুল সিডনির হটস্পট-এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে। ১২ জানুয়ারী ১৯ দিনের ইউরোপ ভ্রমণ সেরে বাড়িতে এসে প্রথম করোনা ভাইরাস সম্বন্ধে জানতে পারি। জানা মাত্রই আমার খুড়তুতো বোন মুম্বই-নিবাসী রুমাকে ফোন করি ওর স্বামী জয় বেজিং-এ কেমন আছে সেটা জানার জন্য। ও বেচারি কিছুই জানত না। আমার কাছ থেকে শুনে আমাকে পরে জানায়, জয় ভাল আছে। বেজিং-এ সব স্বাভাবিক। কিন্তু না। এখন আর কিছুই স্বাভাবিক নয়। যে রোগটা যাত্রা শুরু হয়েছিল চিনের উহান প্রদেশ থেকে, সে এখন সর্বত্র বিরাজমান। প্রতিদিন হু হু করে বেড়েই চলেছে তার প্রকোপ। সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও।
অস্ট্রেলিয়া মার্চের ১৫ তারিখ থেকে কড়াকড়ি নির্দেশ দিল— যাঁরা বিদেশ থেকে আসবেন, তাঁদের আইসোলেশনে থাকতে হবে ১৪ দিনের জন্য। আমার স্বামী প্রিয়াঙ্ক অ্যাকসেনচার-এ কর্মরত।নিয়মিত নিউজিল্যান্ড ট্রাভেল করত। ঠিক সেই সময়ই বিশেষ দরকারে যেতেই হল ওকে শেষ বারের মতো নিউজিল্যান্ডে। অগত্যা এসেই ১৪ দিনের জন্য সেলফ-আইসোলেশন। আমার ছেলে ঈশান পড়ে প্রাইভেট ক্যাথিলিক স্কুলে। তারাও দেখলাম পাবলিক স্কুলগুলোর মতো নির্দেশ জারি করল যে, একান্ত অসুবিধা না হলে সবাই বাড়িতে থাক। ভারতে যখন শুনছি স্কুল বন্ধ, লকডাউন শুরু, আমাদের এখানে তখনও সব স্কুল কলেজ খোলা। এরপর ধীরে ধীরে এক একটা স্কুল থেকে ধরা পড়ছে আর স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমিও যথারীতি বন্ধ করে দিলাম ছেলেকে স্কুলে পাঠানো। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন বরাবরই স্কুল খুলে রাখার পক্ষেই ছিলেন। তাঁর মত অনুযায়ী, ছেলেমেয়েরা স্কুলেই অনেক বেশি সেফ। বাবা-মা যদি এখানে-ওখানে নিয়ে যায় বা একান্ত দাদু-দিদার কাছে রাখেন, সেটা আরও বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে।
নিউ সাউথ ওয়েলস অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্টেট। এখানে তাই প্রকোপটাও অনেক বেশি। এরই মধ্যে মার্চের ১৯ তারিখ একটা ক্রুইজ শিপ ‘রুবি প্রিন্সেস’এসেছিল সিডনি হারবারে। কোনও রকম কোয়রান্টিন না করেই তাঁদের সবাইকে শহরে ঢুকতে দেওয়া হয়। পরে জানা যায়, সেখান থেকে কমপক্ষে ১০০ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। এ বিষয়ে নিউ সাউথওয়েলস হেলথ মিনিস্টার ব্র্যাড হ্যাজার্ড কড়া ভাবে প্রিমিয়ার গ্লাডিস বেরেজিকলিয়ানের নিন্দা করেছেন। অস্ট্রেলিয়ায় করোনা আক্রান্ত সংখ্যা প্রায় ৭০০০। মারা গিয়েছেন প্রায় ৮৪ জন। লকডাউন না করেও যে সংখ্যাটা বেশ কম, তা বলা বাহুল্য। আমি একটা সংস্থার রিক্রুটমেন্ট ম্যানেজার। এখনও যখন ফোন করছি, লোকজন প্রায় জামাই-আদর করার মতোই কথা বলছে। আর বলবে নাই বা কেন? এই মন্দার বাজারে যখন চারিদিকে শুধু হাহাকার, অর্থনীতি তলানিতে এসে ঠেকেছে, তখনও আমি বাড়ি থেকে ফোন করে ওদের নতুন কাজের আহ্বান জানাচ্ছি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, কিছুদূর এগিয়ে আমার ক্লায়েন্টরা কিছু দিনের মধ্যেই বেশিরভাগ পজিশনই বাতিল করে দিচ্ছে। জানি না, এর শেষ কোথায়!
আরও পড়ুন: প্রেগনেন্সির মতো ঘরেই করোনার পরীক্ষা? কিট বানিয়ে দাবি হায়দরাবাদের সংস্থার
কয়েকটা ভাল দিকও অবশ্য রয়েছে। এই যেমন প্রকৃতি নিজে আরও বেশি অপরূপা হয়ে উঠেছে। পৃথিবী থেকে দূষণ কমে গিয়েছে। আকস্মিক মৃত্যুর হার কম। সারা বছর জ্বরে যে হারে লোকজন মারা যেত, তা এখন অনেক কম। আর হ্যাঁ, শিশুরা এর প্রভাব খুব একটা আঁচ করতে না পারলেও এই ভেবে খুব খুশি যে, সবসময় বাবা-মাকে সঙ্গে পাচ্ছে। আমাদের কাজ হয়তো অনেকটাই বেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু এটা কি কম আনন্দের যে ওরা আমাদের সঙ্গেই আছে এবং সুস্থ আছে?
এখানে প্রথম টানাটানি উপলব্ধি করেছিলাম যখন থেকে সরকার আন্তর্জাতিক বিমান পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। তখন থেকেই প্যাকেট দুধ, পাস্তা, টয়লেট রোল, টিসু পেপার, স্যানিটাইজার সব শেষ। ইন্ডিয়ান শপ থেকে চাল, ডাল, তেল থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটা মশলাপাতি হাওয়া। আমরা যদিও কোনওদিন বেশি করে কিছু কিনে রাখিনি, প্রথম থেকেই সপ্তাহান্তে একবার বেরিয়ে সব নিয়ে আসি। কিছু না পেলেও অসুবিধা নেই। ঘরে যা আছে, তাই দিয়েই কিছু বানিয়ে খেয়ে নিচ্ছি। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, যখন সারা পৃথিবী মাস্ক পরে বেরোচ্ছে, এখানকার ডাক্তাররা কিন্তু পরিষ্কার বলেছে, মাস্ক পরার কোনও দরকার নেই। বাড়ি গিয়ে ভাল করে হাত-মুখ ধুয়ে নিলেই হল।
আরও পড়ুন: করোনা রোগীদের পাশেই সাত-আটটি মৃতদেহ, মুম্বইয়ের হাসপাতালের ছবি নিয়ে তোলপাড়
সিডনি তে রৌদ্রোজ্জ্বল উইকএন্ড বিশেষ পাওয়া যায় না। তার মধ্যে শীতকাল আসছে। অস্ট্রেলিয়ানদের বিচ যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। তাই বোধহয় ইস্টারের উইকএন্ড-এ কেউ কেউ বেরিয়ে পড়েছিলেন। খেসারত হিসাবে দিতে হয়েছে মোটা টাকার জরিমানা। সামাজিক দূরত্ব সংক্রান্ত আইনের অপব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ফাইন ১১০০০ ডলার অথবা ৬ মাসের জেল অথবা দুটোই। এ ছাড়া এনএসডব্লিউ পুলিশ অন দ্য স্পট ফাইন করতে পারে ১০০০ ডলার। ইস্টারের সময় সরকারের এখানে আয় হল প্রায় ৩০০,০০০ ডলার। লক ডাউন না করেও সবাই যেভাবে সামাজিক দূরত্ব নিয়ম করে মেনে, সরকারের কড়া ফাইনের ভয়ে বা সম্ভব হলে বাড়িতে থেকে ভাইরাস'র প্রকোপটাকে বিশেষ বাড়তে দেয়নি, তার জন্য অস্ট্রেলিয়ানদের সাধুবাদ দিতেই হয়।
অস্ট্রেলিয়াতে যখন একশোর কাছাকাছি করোনা-আক্রান্ত ছিল, সেখানে ভারতে সংখ্যাটা ছিল ৩। এখন ইন্ডিয়া তে সংখ্যাটা হু হু করে বেড়ে গিয়েছে। যেটা ভয় পেয়েছিলাম ঠিক সেটাই হল। গোটা পরিবার ওখানে। সবাইকে নিয়েই খুব চিন্তা হয়। নিয়মিত ফোনেই যোগাযোগ করি। দূরে থেকেও আমরা সবাই ঐকবদ্ধ।
পারমিতা চন্দ
সিডনি
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন,feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)