সিঙ্গাপুরের রাস্তা সুনসান। —নিজস্ব চিত্র।
শীতের দরজা ঠেলে বসন্ত এল কি এল না, কোভিড-১৯ চলে এল প্রবল পরাক্রমে। ছোটবেলায় গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া আমরাই যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপারমার্কেট থেকে কিনতে শুরু করলাম, যার বেশিরভাগই বহু দূরের সব দেশ থেকে আসা, তখনও ঠিক বুঝতে পারিনি বিপদটা আসলে ঘটে গিয়েছে ক্রমে।
নগরায়নের এপিডেমিক সামাল দিতেই হিমশিম খাচ্ছি যখন, এক বিশ্বজোড়া ভাইরাসের দাপট চোখে আঙুল দিয়ে দেখাল যে সভ্যতা এখনও প্রকৃতির রোষের সামনে শিশু, নিতান্তই অপ্রস্তুত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক না কেন, প্রতি একশো বছরে ফিরে ফিরে আসা মাদার নেচারের তাণ্ডবনৃত্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে রীতিমতো বেগ পেতে হচ্ছে এই একবিংশ শতকেও। নগ্ন হয়ে পড়ছে স্বাস্থ্যপরিষেবা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, মুখ তুলে তাকিয়ে সামাজিক বৈষম্য।
এই লেখা লেখার মাত্র দু’মাস আগে ঠিক এই দিনেই ম্যানেজারের সঙ্গে বাদানুবাদ করছিলাম আমার ছুটির আবেদন বাতিল হয়ে যাওয়া নিয়ে। সপরিবারে তাসমানিয়া বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল, হাজব্যান্ড অস্ট্রেলিয়াতেই আছে রিসার্চের কাজে। কথা ছিল অস্ট্রিয়া ও ইতালি যাওয়ারও। সিঙ্গাপুরে মাত্র আঠারো ও অস্ট্রেলিয়াতে বারোজন আক্রান্ত, প্রত্যেকেই চিনের উহান কিংবা অন্যান্য প্রদেশ থেকে আগত। এই তো কালই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধ করার কোনও দরকার নেই। তবে? তখনও জানা নেই সে দিন রাতেই খবর আসবে সিঙ্গাপুরের তিনজন স্থানীয় নাগরিকও আক্রান্ত, যাদের নিজেদের সাম্প্রতিক বিদেশযাত্রার ইতিহাস নেই।
আরও পড়ুন: সঙ্ঘাত তো শেষ কালই, আজও কেন ঘরে বসে কেন্দ্রীয় দল?
আর দু’দিন পরেই সিঙ্গাপুরের ডিজিজ আউটব্রেক রেসপন্স সিস্টেম হলুদ থেকে কমলা হয়ে যাবে, মানে সর্বোচ্চ বিপদসঙ্কেতের (লাল রং দিয়ে যা বোঝানো হয়) ঠিক আগের অবস্থা। ডায়মন্ড প্রিন্সেস তখনও নিশ্চিন্তে সমুদ্রের বুকে ভাসছে। সার্স-সিওভি-২ এর কোভিড-১৯ নামকরণ হতে আরও কিছুদিন বাকি। পেশায় এপিডেমিওলজিস্ট হয়েও বিপদের ব্যাপ্তি আঁচ করতে পারিনি তখনও।আমি কাজ করি এখানকার সরকারের অধীনস্থ ট্যান টক সেঙ হাসপাতালের রিসার্চ উইং-এ।
এই হাসপাতালটিই সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য স্বাস্থ্য দফতরের নির্দিষ্ট সংস্থা। সমস্ত কর্মীকে হাসপাতালের এন্ট্রান্স পয়েন্টগুলোতে স্ক্রিনিং ডিউটি দেওয়া হল। স্ক্রিনিং অর্থাৎ হাসপাতালে রোগী বা রোগীর সঙ্গে যাঁরা আসছেন তাদের টেম্পারেচার মনিটরিং ও সাম্প্রতিক বিদেশযাত্রার নথিসংগ্রহ। আমাকে রিসার্চের কাজেই বহাল রাখা হল। অন্য বেশ কিছু কাজ আপাতত স্থগিত রেখে শুধু কোভিড-১৯ সংক্রান্ত রিসার্চে বেশি সময় দেওয়া শুরু হল। যাবতীয় টিচিং ক্লাস বন্ধ হল। দশজনের থেকে বেশি লোকের সঙ্গে মিটিংগুলো ভিডিও কনফারেন্সিং-এর মাধ্যমে করা শুরু হল। প্রতি দু-তিনদিন অন্তর অন্তর নতুন ডেটা আসতে শুরু করল, কীভাবে আরও ভাল চিকিৎসা করা যায় তাই নিয়ে গবেষণা চলছে।এরই মধ্যে হাসপাতাল-সহ সব প্রতিষ্ঠানে দিনে দু’বার করে টেম্পারেচার মনিটরিং, সেফ ডিস্ট্যানসিং ও বারবার হাত ধোওয়ার প্রোটোকল চালু হল। বাজারে মাস্ক ও স্যানিটাইজারের স্টক শেষ হয়ে গেল নিমেষেই।
সিঙ্গাপুরে পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্টের অভাব এখনও পর্যন্ত নেই। যাদের কাজ ডাইরেক্ট পেশেন্ট কন্ট্যাক্টে নেই, তারাও তখন সবাই হাসপাতাল থেকে দেওয়া সার্জিক্যাল মাস্ক পরছি। এরই মধ্যে নির্দেশ এল শুধু অসুস্থ ব্যক্তিরাই মাস্ক পরবে, অন্যদের দরকার নেই। সেই শুনে সহকর্মীরা মাস্ক ব্যবহার ছেড়ে দিল, কিন্তু আমার এটা পছন্দ হল না। বাইরে বেরোলে মাস্ক পরেই থাকতাম। এরকম সময়ে সরকার থেকে পরিবার পিছু চারটি করে সার্জিকাল মাস্ক এবং ৫০০ মিলিলিটার স্যানিটাইজার বিলি করল। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে এসে দুটো ক্যাথলিক চার্চকে হটস্পট পাওয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে সব ধর্মপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিল। এভাবে মার্চ চলে এল।
আস্তে আস্তে জানা গেলো এর ভয়াবহতা, প্রতিদিন আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করল। ব্যাপক কনট্যাক্ট ট্রেসিং ও টেস্টিং শুরু হল। শুরু হলো বর্ডার কন্ট্রোল। ট্যুরিস্ট বন্ধ করা হল। হেলথকেয়ার ও ট্রান্সপোর্টে কর্মরত নাগরিকরাই ফিরতে পারবে, ঘোষণা হল। তাদেরকে থাকতে হবে বাধ্যতামূলক চোদ্দ দিনের হোম কোয়রান্টিনে। কিছু পরিচিত ফিরতে পারলেন। আমাদের রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে তৈরি হল সাপোর্ট গ্ৰুপ, যারা বাইরে থেকে ফিরে স্টে-হোম নোটিসে আছেন তাঁদের বাড়িতে গ্রোসারি বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পৌঁছে দেওয়ার। মেয়ের নার্সারি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। তখনও হাসপাতালে যাচ্ছি, এইচআইভির ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কোভিড-১৯ এর জন্য, কিন্তু খুব একটা লাভ পাওয়া যাচ্ছে না। যারা সুস্থ হচ্ছেন, তাদের রক্ত থেকে অ্যান্টিবডি নিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হবে ভাবা হচ্ছে।
মাত্র দুদিনে তৈরি হল অত্যাধুনিক ব্যবস্থাযুক্ত স্ক্রিনিং ছাউনি, যেখানে একসঙ্গে পাচঁশোজনকে পরীক্ষা করা যাবে।এরই মধ্যে জানা গেলো যারা ইনফেক্টেড হচ্ছে, সকলেই অসুস্থ হচ্ছে না, মানে তাদের কোনওরকম সিম্পটম নেই। এরকম ব্যক্তিদের জন্য খোলা হল কমিউনিটি আইসোলেশন ফেসিলিটি। ২১ মার্চ প্রথম মৃত্যুসংবাদ, একদিনে দু'জনের, দু'জনই ষাটোর্ধ্ব। দেশে থাকা বাবা-মা-কে নিয়ে চিন্তা বাড়তে শুরু করলো। ওঁরা একদম একা আছেন উত্তরবঙ্গের একটি ছোট্ট মফস্বল শহর মালবাজারে। বাবা বহুবছর ডায়াবেটিক, ও হৃদরোগে আক্রান্ত, মায়ের শ্বাসকষ্ট।
পশ্চিমবঙ্গেও ঢুকে পড়েছে ভাইরাস ততদিনে। দাদা, বৌদি ও ছোট্ট ভাইপো থাকে লন্ডনের কাছে পিটারবোরো নামের একটি ছোট্ট শহরে, ইংল্যান্ড তখন মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছে। অস্ট্রেলিয়াতে আটকে রইল জীবনসঙ্গী, একা, আর এখানে চার বছরের মেয়ে ও কাজের মেয়েটি রইল আমার সঙ্গে। এইসময় পরিবারের কারওর কিছু হলে আমি তো কিছুই করতে পারব না, এই ভেবে দুঃসহ অসহায়তায় দিন কাটতে লাগল।
মার্চের শেষ দিনে হাসপাতাল থেকে জানানো হলো ডাইরেক্ট পেশেন্ট কন্ট্যাক্টে নেই যারা, তারা সবাই ওয়ার্ক ফ্রম হোম করবে। আমি সেইমতো ব্যবস্থা নেওয়া শুরু করলাম। এরই মধ্যে ৩রা এপ্রিল সরকার ঘোষণা করলো ‘সার্কিট ব্রেকার’ লঞ্চ করা হবে ৭ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে ভার্চুয়াল ক্লাস শুরু হল। এসেনশিয়াল সার্ভিসে জড়িত ব্যক্তি ছাড়া আর সবাই বাড়ি থেকে কাজ শুরু করল। সুপারমার্কেট খোলা রইল। সবাইকে বাড়িতে থাকার ও বাইরে গেলে মাস্ক পরার নির্দেশ দেওয়া হল। নির্দেশ অমান্য করলে ১০,০০০ ডলার অবধি জরিমানা ও ছয় মাসের হাজতবাস নির্ধারিত হল। সব অধিবাসীর জন্য সরকার থেকে আরেক দফা রিইউজেবল মাস্ক বিলি করা হল। ফুড ইন্ডাস্ট্রি, ট্যুরিজম, বিমান পরিষেবা ও স্বনিযুক্ত ব্যক্তিদের আর্থিক সাহায্যের জন্য রেজিলিয়েন্স বাজেট ঘোষণা করা হল। এর মধ্যেই অভিবাসী শ্রমিকরা থাকেন এমন দুটি ডরমেটরিকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হল। প্রকাশ হয়ে পড়লো ঝাঁ চকচকে শহরের একটি তমসাময় দিক।
বাংলাদেশ, ভারত, তাইল্যান্ড, মা
মধ্য ও উচ্চবিত্ত সমাজ হয়তো ধীরে ধীরে কাটিয়েও উঠতে পারবে এই বিপর্যয়, কিন্তু সবথেকে বেশি চিন্তা হয় দরিদ্র মানুষদের নিয়ে। রাতারাতি গৃহহীন, অন্নহীন হল যে অগণন মানুষ, তাদের নিয়ে। প্রতিদিন বিশ্বজুড়ে বাড়ছে মৃতদেহ সংখ্যা, টিভির বিভিন্ন দৃশ্য রাতের ঘুম কেড়েছে। আর কিছুদিন পরেই শুরু হবে বাৎসরিক গ্রীষ্মকালীন জলসঙ্কট, তার জন্য আমরা প্রস্তুত তো? সব মিলিয়ে এই কোভিড-১৯ সমস্ত বিশ্বকে এক অভূতপূর্ব সঙ্কটে ফেলেছে, যে সঙ্কট জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি, ও সামাজিক সঙ্গতিকে একসঙ্গে পরীক্ষার মুখে নিয়ে এসেছে। আমরা সকলেই চেষ্টা করছি এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজ নিজ সামর্থ্য মতো মোকাবিলা করার, মানসিক সুস্থতা বজায় রেখে। বাড়ি থেকে করছি বলে কাজ এগোচ্ছে খুব ধীরগতিতে, এক ঘন্টার কাজ তিনঘন্টায় শেষ করছি।
অন্যদিকে মেয়ের সঙ্গে বেশি সময় থাকতে পারছি। সপ্তাহে একবার মতো বাজার করছি, যা পাচ্ছি যেটুকু পাচ্ছি তাতেই দিব্যি চলে যাচ্ছে। ধ্যান ও যোগাসন করার চেষ্টা করছি, ব্যালকনিতে গাছ লাগাচ্ছি, বই পড়ছি আর কিছু টুকটাক লেখালেখি নিয়ে আছি। তবু মধ্যে মধ্যে বিবেকদংশন, এইসবের জন্য কোথাও তো আমরাই দায়ী! আকাশছোঁয়া লোভের জিহ্বা লকলক করে, অথচ এই ভাইরাসটি এসে বোঝালো কত অল্পতেই জীবন চলে যায় বেশ স্বচ্ছন্দে। দেখালো বিশ্বের অধিকাংশ নাগরিকের থেকে কতটা বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলেছি। চেনালো এই নাগরিক সভ্যতার যারা ভিত্তি হয়েও দাঁড়িয়ে আছেন একদম নীচের সিঁড়িতে, তাঁদের, ও তাঁদের দুরবস্থার প্রকৃত চিত্র। ভাইরাস এসেছে, চলেও যাবে, কিন্তু এই যে অভিজ্ঞতা, এই উপলব্ধি, এটুকুই সত্য হয়ে থাকবে এই বিপর্যয় পেরিয়েও। কার্ল ইয়ুং এর কথায় – ‘‘There is no coming to consciousness without pain.’’
তবুও কিছু মানুষ এখনও স্বার্থপরতা ও ক্ষমতার দম্ভ প্রদর্শনে বিন্দুমাত্র পিছপা নয়। বড় বড় লোকেরা যখন এই কোভিড-১৯ কে কেন্দ্রে রেখে জিওপলিটিক্যাল যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে, প্রকৃতিতে অন্যদিকে নিঃশব্দে না-জানি কতকিছুই ঘটে যাচ্ছে। আকাশ বাতাস পরিচ্ছন্ন হচ্ছে, কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমছে। সিঙ্গাপুরের রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া,রাধাচূড়া,পলাশ,জারুল
আরও পড়ুন: ত্রাণ নিয়ে বিক্ষোভ, বাদুড়িয়ায় জনতা-পুলিশ খণ্ডযুদ্ধ, মাথা ফাটল পুলিশের
মায়ের দুধে জল মেশানোর কোনও ক্ষমা হয় বুঝি? দৃশ্যান্তরে তোমাদের দেহ ভাসছে পৃথিবীর সব জলের শরীরে। তন্ত্রে বিশৃঙ্খলা দেখে রাগে ফুঁসছে গ্রিক দেবী গায়া। বেসুরো বেজেছে সব তার। পিশাচি রূপে সমস্ত শূন্য করে, নতুন জন্ম দেবে। জেনেসিস, হয়তো আবার! মূকের জন্য রেশমি আদর বুনছে। অনিবার্য সংস্কার চলছে এখন, সবাই চুপ। আস্ফালন বন্ধ করো। নতশিরে বসো। স্তুতিগান শুরু হোক। কান পেতে রাখো যদি― সহস্র হাহাকারের মধ্যেই শুনবে মৃদু ভেসে আসা এক অলৌকিক নারীর গাথা ললিতে বাঁধা, সবুজ ভোরে।
সঞ্চালিকা আচার্য, সিঙ্গাপুর।