নিউ সাউথ ওয়েলস এই মুহূর্তে আরোগ্য এবং গৃহবন্দি জীবন থেকে মুক্তির পথে।
স্বামী আর পাঁচ বছরের পুত্রসন্তানকে নিয়ে প্যারাম্যাটাতে বসবাস। সিডনি সংলগ্ন সবচেয়ে বড় শহর প্যারাম্যাটা। সিডনি শহরের বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্রে অফিস, সপ্তাহান্তে টুকটাক বেড়াতে যাওয়া— এই ছিল আমাদের গত এক বছর বা তার কিছু বেশি সময়ের দিনলিপি। অফিস, বাড়ি আর ছেলের ডেকেয়ার বা স্কুলের মাঝে ছুটতে ছুটতে কী ভাবে যে একটা বছর কেটে গিয়েছে, বিশেষ বুঝতে পারিনি। কোভিড-১৯-এর আকস্মিক আঘাত দেখিয়ে দিল সেই অবিরাম জীবন-ব্যস্ততা কী ভাবে মুহূর্তে থমকে যেতে পারে।
অতিমারির সামান্য আঁচ আমরা পেতে শুরু করি চলতি বছরের শুরুর দিকে। সূত্রপাত আমার কর্মস্থল। এক সহকর্মী চিনে গিয়েছিলেন চৈনিক নববর্ষের ছুটি কাটাতে। এ দিকে কাজের ব্যাপারে তাঁকে আমাদের বিশেষ প্রয়োজন। ছুটি কাটিয়ে যে দিন তাঁর অফিসে ফিরে আসার কথা, তার বেশ কয়েক দিন পরও দেখতে পেলাম না সেই সহকর্মীকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চিন থেকে ফিরেছেন বলে তাঁকে বিধিসম্মত ১৪ দিনের স্বতন্ত্রীকরণ কাটিয়ে অফিস আসতে হবে। তবে তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন এবং বাড়ি থেকে কাজ করছেন। অথচ একই সময়ে আমার অন্য এক সহকর্মী ভারতবর্ষ থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরলেন। পথে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া অতিক্রম করে— তাঁকে এ রকম কোন বিধি মেনে চলতে বলা হয়নি সিডনি বিমানবন্দরে। জানা গেল, কিছু মুষ্টিমেয় দেশের ক্ষেত্রেই এই বিশেষ সাবধান বার্তা অনুসরণ করতে বলেছে এ দেশের প্রশাসন। এক বার খুব সাধারণ প্রয়োজনে এখানকার দীর্ঘপরিচিত চিকিৎসককে দেখাতে গিয়ে, তাঁকে জিজ্ঞাসা করি, কী পরিস্থিতি এ দেশে? তিনি আশ্বস্ত করলেন, বিশেষ চিন্তার কিছু নেই। খুব কঠিন কোন উপসর্গ বা সাম্প্রতিক বিদেশভ্রমণের ব্যাপার না থাকলে করোনাভাইরাস নিয়ে ভাবার প্রয়োজনও নেই। সব মিলিয়ে মনে হল, এই ঢেউ বহু দূরের, আমাদের ওপর বিশেষ কোন প্রভাব পড়বে না।
ভুল ভাঙতে সময় লাগল ঠিক এক সপ্তাহ। দক্ষিণ গোলার্ধের এই সদা প্রাণোচ্ছল শহরটির ছবি বদলাতে শুরু করল খুব দ্রুত। ধীরে ধীরে নেমে এল এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার আবহ। অফিসগুলোতে কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল, যে কোনও দিন কর্মীদের বলা হতে পারে আগামী কাল থেকেই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাড়ি থেকে কাজ করতে হতে পারে। প্রতি দিন ল্যাপটপ বাড়ি নিয়ে যাওয়া-সহ অন্যান্য সব রকমের প্রস্তুতি যেন থাকে। স্কুল থেকে সরকারি ভাবে জানিয়ে দেওয়া হল, যে কোনও দিন এক বা দুই ঘণ্টার আগাম ঘোষণাতে মা-বাবারা যেন বাচ্চাদের বাড়ি নিয়ে যেতে প্রস্তুত থাকেন। নানা রকম বিভ্রান্তিকর খবর এবং গুজব শোনা যেতে লাগল। দীর্ঘ দিন গৃহবন্দি জীবনের জন্য তৈরি হতে শুরু করলাম। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, খাবার মজুত করতে লাগলাম। খবরে শোনা টয়লেট পেপার নিয়ে খণ্ডযুদ্ধ দেখলাম একেবারে নিজের চোখের সামনে। তবে শুধু টয়লেট পেপারই নয়, হাত ধোয়ার সাবান, জীবাণুনাশক তরল বা টিস্যু, এমনকি বাসন পরিষ্কার করার সাবান এবং ডিসওয়াশারের ট্যাবলেটও উধাও হয়ে যেতে দেখলাম ভোজবাজির মতন। হাত ধোয়ার সাবান বেশ ক’দিন ধরে না পেয়ে তার বদলে একদিন কার্ট-এ তুলে নিলাম পেল্লায় সাইজের লিকুইড বডি সোপ। সহজ যুক্তিতে জল আর সাবান দিয়ে হাত ধোয়াটাই তো মুখ্য। অন্য এক জন মহিলা ক্রেতা হঠাৎ এক অযাচিত প্রশ্ন করে বসলেন, আমি কী ভাবে ভেবে নিলাম যে হ্যান্ডওয়াশের কাজ বডিওয়াশ করতে পারবে? কোনও মতে সৌজন্যমূলক উত্তর দিয়ে বাঁচলাম! স্যানিটাইজার দোকানে পাওয়া আর ঈশ্বরের দর্শন তখন প্রায় সমগোত্রীয়। সহায়তা পেলাম অফিস থেকে। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিচালনা-সংক্রান্ত বিভাগে অফিসকর্মীরা ফাঁকা স্যানিটাইজারের বোতল নিয়ে গেলে, সেগুলো ভরে দেওয়া হবে বলে বিজ্ঞপ্তি পড়ল অফিসে। এই ছোট্ট পদক্ষেপটার জন্য অফিসের কত জন যে উপকৃত হলেন, তা বলবার কথা নয়!
আরও পড়ুন: কী ভাবে করোনা-যুদ্ধে জয়ী হল দক্ষিণ কোরিয়া?
ওষুধের দোকানে বাচ্চাদের হাঁচি-কাশি-জ্বরের ওষুধের মারাত্মক আকাল। নিরুপায় হয়ে ডাক্তারবাবুর সাহায্য নিলাম। ওঁর লেখা প্রেসক্রিপসনে পেলাম ওষুধ। কারণ বিনা প্রেসক্রিপসনে ওষুধের তাক তখন শূন্য। ভারতীয় মুদিখানার দোকানগুলোতে জিনিসপত্র হু হু করে শেষ হতে শুরু করল। অর্ডার দেওয়ার পরের দিনই যেখানে জিনিসপত্র পৌঁছে যায় বাড়ির দোরগোড়ায়, সেখানে আনুমানিক দুই থেকে তিন সপ্তাহ পরে জিনিস পাওয়া যাবে বলে জানানো হল। অর্ডার দিয়ে তখন শুধু প্রার্থনা, আমাদের ডেলিভারির তারিখ পর্যন্ত যেন কিছু জিনিস অবশিষ্ট থাকে দোকানে !
যাঁরা অস্ট্রেলিয়ায় সময় কাটিয়েছেন, তাঁরা এ রকম জনমানবশূন্য শহরকে চেনেন না।
অবশেষে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের এবং বেশির ভাগ অফিস থেকে বলে দেওয়া হল, বাড়ি থেকে কাজ করতে। স্কুল এবং স্কুল-পরবর্তী ডেকেয়ার তখনও খোলা। কিন্তু বাচ্চাদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত মা-বাবাদের উপরেই ছেড়ে দেওয়া হল। অবিলম্বে ছেলেকে স্কুল পাঠানো বন্ধ করলাম। তার পরের সপ্তাহেই শুরু হল স্কুলের অনলাইন ক্লাস। স্কুলের এক অতি জনপ্রিয় খুদেকে ক্লাশের বদলে ল্যাপটপের সামনে বসিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় নিপীড়ন বোধকরি আর হয় না।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর থেকে চেন্নাই, দেশের নানা প্রান্তে আটকে বাঙালিরা
এ দেশের অন্যান্য স্টেটের তুলনায় আমাদের স্টেট নিউ সাউথ ওয়েলশ তখন করোনা-আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যার নিরিখে একদম ওপরে। প্রতি দিনের খবর যেন বিভীষিকাময় বুলেটিন। এরই মধ্যে বৃদ্ধাবাসের বয়স্ক আবাসিক ও আবাসিককর্মীদের অসুস্থতা ও মৃত্যুর খবর আসতে থাকল। একটি স্কুলে এক তরুণ ছাত্রের সংক্রমণ ধরা পড়তে রাতারাতি স্কুলটি বন্ধ করে দেওয়া হল। অতিপ্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া বাইরে না বেরনোর অনুরোধে যখন বিশেষ সুফল হল না, তখন কড়া পদক্ষেপ করা শুরু করল প্রশাসন। এক সময় অতিপ্রয়োজনীয় কাজের তালিকা প্রকাশ করা হল। তার বাইরে অন্য কিছু কাজে বেরনোর যথার্থতা প্রমাণ করতে না পারলে, হাতেনাতে বড় অঙ্কের জরিমানা বা কারাদণ্ড অথবা দুটোই হবে বলে জানানো হল। রাস্তায় দেখা গেল, পুলিশ এবং প্রচুর আধাপুলিশ সাহায্যকর্মী, যাঁরা পথচারীদের জিজ্ঞাসা করছেন, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন? দুইয়ের বেশি লোককে একসঙ্গে রাস্তায় না বেরনোও বাধ্যতামূলক করা হল। সুপারমার্কেট এবং ডাক্তারখানা ছাড়া প্রায় সব দোকান বন্ধ করে দেওয়া হল। রেস্তরাঁগুলি খোলা রইল কেবল খাবার সরবরাহ করার জন্য। খেলার মাঠের কিছুটা অংশ খোলা রইল। সর্বত্র বিধিসম্মত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা বাধ্যতামূলক করা হল।
প্রায় তিন সপ্তাহ এই কঠিন নিয়ম চলার পর এ রাজ্যে সংক্রমণের হার লক্ষণীয় ভাবে কমতে থাকল। সামান্য হলেও স্বস্তি পেলেন সকলে। সুপারমার্কেটে জিনিসপত্র স্বাভাবিক ভাবে পাওয়া যেতে লাগল। অস্ট্রেলিয়ার অন্য কয়েকটি স্টেটের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও নিউ সাউথ ওয়েলস এই মুহূর্তে আরোগ্য এবং গৃহবন্দি জীবন থেকে মুক্তির পথে। সরকার এবং প্রশাসন আর্থিক সাহায্য থেকে মৌলিক পরিকাঠামো বজায় রাখা— সব রকম প্রকল্প নিয়েছে অতি অল্প সময়ে। তবে কোনও কিছুই হয়তো এত সহজে নির্ভুল ও নিখুঁত হয় না। এত কিছুর পরেও এ দেশে বহু মানুষ বিপাকে পড়েছেন। যাঁরা অনিশ্চয়তা মাথায় নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। প্রচুর বিদেশি আটকে পড়ে গিয়েছেন। তাঁরা অপেক্ষায় রয়েছেন নিজের দেশে ফেরার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ত্রাণের এই বিপুল ঋণ একপ্রকার অপরিশোধতুল্য।
এই পরিস্থিতি সাময়িক। পৃথিবী এক দিন সেরে উঠবেই।
কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে যেন বদলাতে চলেছে সব কিছুই। এই মুহূর্তে নিজের বিপদের চেয়েও বেশি দুশ্চিন্তা জাগাচ্ছে কাছে-দূরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা প্রিয়জনদের কথা। কলকাতার মা-বাবা, পরিবার, সুদূর মার্কিন দেশে সদ্য মা হওয়া প্রিয় বান্ধবী এবং আনন্দবাজারে পড়া অগণিত অচেনা মানুষ, যাঁরা নানা রকম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন।
সিডনির অফিসপাড়াতে এক অতিপরিচিত দৃশ্য হল, সকালের কফি ও ব্রেকি (ব্রেকফাস্ট) সহযোগে অফিসযাত্রীদের নিত্য আড্ডা। এবং ততোধিক পরিচিত দৃশ্য হল, অফিসের পরে পানশালার খোশগল্প কিংবা সপ্তাহান্তে সমুদ্রসৈকত ভ্রমণ। অবিশ্বাস্য হলেও কর্মব্যস্ততা ও কর্মবিরতির এই চেনা দৃশ্য আজ অন্তর্হিত। যাঁরা এ দেশে এক দশকেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন, তাঁরাও এ রকম জনমানবশূন্য শহর ও সমুদ্রসৈকতকে চেনেন না।
তবে মনের জোর রাখতেই হবে। এই ভেবে যে, এই বিরতি অল্পের জন্য, এই পরিস্থিতি সাময়িক। পৃথিবী এক দিন সেরে উঠবেই। অতিগ্রাসী মানবজাতিকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে মানবজীবনের। সম্মান করতে হবে প্রকৃতিকে। শিখতে হবে নতুন জীবনযাত্রা।
এবং শেষ হবে এই অবসাদের অবকাশ।
সকলের জন্য রইল সুস্থতার শুভেচ্ছা।
মৌমিতা দে, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
ছবি: পত্রলেখকের সৌজন্যে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)