বিপদ ঘটবার আগে ঈশ্বর বিপদগ্রস্তের মস্তিষ্ক বিকল করে দেন। এ রাজ্যে করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সম্ভাব্য রোগীর প্রতি কিছু মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত আচরণ সেই বহুচর্চিত প্রবচনটি মনে করিয়ে দিল। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার এক জন অসুস্থ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে স্বাস্থ্যভবনের কর্তাদের নির্দেশ সত্ত্বেও কোনও মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করানো গেল না। সৌজন্যে করোনাভাইরাসের আতঙ্ক। একই জেলার গাইঘাটায় গ্রামের এক যুবক সামান্য দুর্বলতার শিকার হয়েছিলেন। তাঁকে করোনাভাইরাসের শিকার বলে বিধান দেওয়া হয়। গ্রামে একঘরে হয়ে পড়েন পরিবারসহ যুবক। জল এবং খাবার সংগ্রহে তাঁদের বাধা দেওয়া হচ্ছিল। পড়শি বা প্রশাসনের সাহায্য না পেয়ে আত্মঘাতী হন তিনি। করোনাভাইরাসে মৃতের শবদেহ নিরাপত্তার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কলকাতার নিমতলা শ্মশানে দাহ করতে প্রবল বাধা দিয়েছেন এলাকার কিছু বাসিন্দা এবং ডোম। অ্যাম্বুলেন্সের কোনও কোনও ড্রাইভার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে বহন করতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এই সব ঘটনা কোন সর্বনাশের ইঙ্গিত দেয়?
কোভিড-১৯’এর চেয়ে অনেক বেশি ছোঁয়াচে রোগ: আতঙ্ক। ডাক্তারের বদলে চোখে দেখেই ডায়াগনিসিস সেরে ফেলছেন স্থানীয় সবজান্তা দাদা। হতভাগ্যকে একঘরে করবার বিধান ডাইনিপ্রথাকে মনে করিয়ে দেয়। বিপর্যয়ের সময় মানুষের আসল রূপ ফুটে ওঠে। আমরা কি এখনও গুহা থেকে বেরোতে পারলাম না? না কি, অন্য অন্য প্রশ্নে মহানুভবতা দেখালেও নিজের এবং স্ত্রী-পুত্রের জীবনরক্ষার প্রশ্নে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ই শ্রেষ্ঠ মতবাদ?
করোনা-বিপদ কিছু দিন পরে চলে যাবে। কিন্তু অমানবিকতার বিভিন্ন মুখ সমাজে যে ফাটল সৃষ্টি করবে, তা বোধহয় সহজে মিলিয়ে যাওয়ার নয়।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি
শ্রীরামপুর, হুগলি
ধনতন্ত্র ও বিপদ
‘নিয়তির পরিহাস’ (১-৪) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে এক নির্মম সত্য আমাদের সকলের সামনে অত্যন্ত সঠিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আর্থিক শক্তিতে বলীয়ান পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা উন্নত দেশ আমেরিকার এমন করুণ পরিণতি আজ সমগ্র বিশ্ববাসীকে অসংখ্য জটিল কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে বাধ্য করেছে। একটু সতর্কতা অবলম্বন, ‘পারস্পরিক আস্থা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই মানুষের শক্তি’। একে মূলধন করে সকলকে সঙ্গে নিয়ে এগোতে পারলে, আমরা ভবিষ্যতে অবশ্যই এই ধরনের সভ্যতার সঙ্কট অনেকখানি প্রতিহত করতে সক্ষম হব।
‘বিধাতা’ শব্দের অর্থ ‘বিধান কর্তা’। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রনায়ক বা বিধাতার ভূমিকা কতটা বাস্তবানুকূল, সেটাই বিবেচনা করা দরকার। ‘শাসকের অবিমৃশ্যকারিতায়’ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা-আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আমেরিকার অহঙ্কারী প্রেসিডেন্ট করোনা সংক্রমণের শুরুতে ‘চিনের ভাইরাস’ বলে ‘বিদেশবিদ্বেষে ঘৃতাহুতি’ দিয়ে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করে হাততালি কুড়োতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। প্রথম দিকে অনুরূপ পথে এগিয়ে ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানির মতো ধনতন্ত্র-পূজারিরা অধিকাংশই আজকে দিশাহীন। মৃত্যুর মিছিল চলছে সেখানে।
অন্য দিকে ৯ কোটি ৭১ লক্ষের দেশ ভিয়েতনামে কাউকে প্রাণ হারাতে হয়নি। ছোট্ট দেশ কিউবা নিজের দেশের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে অন্য দেশের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চিন উহান প্রদেশের বিপর্যয় সামলে গোটা দেশটাকে প্রায় সুরক্ষিত করে ফেলেছে। আমেরিকাকেও সাহায্য করতে তারা প্রস্তুত। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো ছোট্ট দেশও শুধু জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং রোগ নির্ণয় করার উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের রক্ষা করেছে।
তা ছাড়া করোনাভাইরাসের আক্রমণ প্রতিহত করার পর যে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন গোটা বিশ্ব হবে, তা থেকে নিজের দেশকে বাঁচাতে কোন কোন দেশ সক্ষম হবে, তার একটা আনুমানিক আভাসও অর্থনৈতিক ভাষ্যকারেরা উপস্থাপন করেছেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে মূলত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সঙ্গে, যে সকল দেশে ব্যাঙ্ক, বিমা, যোগাযোগ, পরিবহণ ইত্যাদিতে সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ শক্তিশালী, সে দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করার ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই চিন কিংবা ভারত বিপর্যয় সামলে নিতে পারবে। অথচ ধনতন্ত্র-দর্শন পরিচালিত দেশগুলির বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা অনেকের তুলনায় বেশি।
এ বার সময় এসেছে, নিজেদের ভাবনাকে কলুষমুক্ত করে, আগামী পৃথিবীকে মানুষসহ প্রকৃতি-সৃষ্ট অন্য প্রাণীদের বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও পরিকল্পনা নেওয়ার। পরমাণু গবেষণার উন্নতি করে যে সভ্যতাকে সুরক্ষিত করা সম্ভব নয়, সেটা এ বার প্রমাণিত হয়েছে। আবার ভোগবাদী দর্শন বা বাজার অর্থনীতিও এমন এক সর্বগ্রাসী ক্ষুধার জন্ম দেয়, যা মানুষকে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে না। এরা সমরাস্ত্রের বাজারে মুনাফা বেশি দেখলে তার উপর বিনিয়োগ-গবেষণা বৃদ্ধি করবে। মানুষ ও অন্য প্রাণীদের সুরক্ষিত করার উদ্যোগ উপেক্ষিত হবে।
রতন রায়চৌধুরী
কলকাতা-১১৪
শুধু তর্কাতর্কি?
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশে লকডাউন। এর মধ্যেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই লকডাউনকে উপেক্ষা করে মানুষ দোকান, বাজারে ভিড় করছেন। অর্থাৎ লকডাউন থাকলেও পুরোপুরি ‘লোকডাউন’ হচ্ছে না এক শ্রেণির অতি খামখেয়ালি, অসচেতন মানুষের জন্য। এ অবস্থায় আমাদের রাজ্যে রেশন বণ্টনকে কেন্দ্র করে কোথাও রাজনৈতিক দলাদলি, কোথাও সঠিক পরিমাণে বণ্টনে ত্রুটি, কোথাও রেশনের প্রতীক্ষায় মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলেও, রেশন ডিলার তখনও ঘুমন্ত। টিভিতে দেখছি, এগুলো কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বণ্টন ব্যবস্থাকে কিভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা যায়, সে বিষয়ে সম্যক আলোচনার পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা শুধু দোষারোপের কাদা ছুড়ে যাচ্ছেন। ভেবেছিলাম, এই বিপর্যয়ের সময় অন্তত রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক কমবে। কিন্তু, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।
অরুণ মালাকার
কলকাতা-১০৩
গণতন্ত্র!
গণতন্ত্রের ব্যবহার যে কী বিচিত্র হতে পারে, তার নিদর্শন এই ভারতে চারিদিকে ছড়িয়ে। নিজামুদ্দিনে ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া থেকে ধর্মপ্রচারকদের আসা যদি সরকার আটকে দিত, তা হলে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে, যারা দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষার দায়িত্ব পালন করি— রে-রে করে বলে উঠতাম না, মোদী সরকার আসার পর ভারতে এখন সংখ্যালঘুদের ধর্ম পালনেরও অধিকার নেই?
এই কিছু দিন আগেও ভারতে যখন করোনাভাইরাসের আক্রমণ এতটা প্রকট হয়ে উঠেনি, তখন থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার দেশের মানুষ ও রাজ্য সরকারগুলিকে করোনার ভয়াবহতা নিয়ে সচেতন করেছেন, প্রচার চালিয়েছেন। এই প্রচারকে বিরোধী বহু নেতা, দেশের অর্থনৈতিক ব্যর্থতাকে ঢাকার এক অপপ্রচার বলে অভিহিত করেন। আর আজ যখন শিয়রে করোনার গরম নিঃশ্বাস অনুভূত হচ্ছে, তখন এটা করেনি বলে আঙুল তোলা হচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে?
অর্থাৎ গণতন্ত্রের নামে আমরা শুধু সরকারের সমালোচনা করব, গণতন্ত্রের অপব্যবহার চালিয়ে যাব। তাতে দেশের কিছু হোক বা না হোক, অসুস্থ রাজনীতির শ্রীবৃদ্ধি তো ঘটবে।
মিহির কানুনগো
কলকাতা-৮১
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
ভ্রম সংশোধন
‘‘অ্যাম্বুল্যান্সে রোগীর সঙ্গী ডাক্তারই’’ শীর্ষক সংবাদে (৭-৪, পৃ ৩) বেলেঘাটা আইডি’র করোনা-চিকিৎসক দলে এক চিকিৎসকের নাম শ্রেয়া ঘোষ লেখা হয়েছে। ওনার নাম খেয়া মুখোপাধ্যায়। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।