প্যারিস। ছবি: লেখকের নিজস্ব।
আমি এক ভারতীয় তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় ফ্রান্স শাখায় কর্মরত। প্যারিসের যে জায়গাটায় এখন বসে আছি সেটা যেন এখন গোটা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রয়েছে। এটা প্যারিসের দক্ষিণে একটা জমজমাট জায়গা। আসলে জমজমাট ছিল কিছু দিন আগেও, এখন যেন চার দিকে শ্মসানের নিস্তব্ধতা। যে মানুষটা আগের সপ্তাহেও নিজের চাকরি-প্রেম-সম্মান বাঁচাতে ব্যস্ত ছিলেন, আজ তিনি শুধুই নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
অ্যাপার্টমেন্টে যেখানে আমি বসে রয়েছি সামনে একটা কাচের দরজা। প্রতিদিন নিয়ম করে দিনের একটা সময় এই দরজা খুলে সুন্দর বারান্দাটায় বসতাম। দরজাটাও প্রায় পাঁচ দিন আর খোলা হয়নি। রেলিংয়ে একটু একটু করে ধুলো জমছে। এই বারান্দার পরেই চওড়া রাস্তা। দক্ষিণ প্যারিস এবং শহরতলীর মধ্যে মূল রাস্তা এটা। কয়েক সপ্তাহ আগেও যেখানে সর্বক্ষণ গাড়ি, বাইক, সাইকেল এমনকি পদচারীদের ভিড় লেগে থাকতো। সিগন্যাল লাল হলে সারি সারি গাড়ির লাইন পড়ে যেত। সামনেই ব্যস্ত রেল স্টেশন। সেখানেও দিনের বেশির ভাগ সময় মানুষের ভিড় থাকতো, আজ সব ফাঁকা। সামনের এই গোটা রাস্তা জুড়েই একের পর এক রেস্তোরাঁ, ছোট বড়-খাবারের দোকান। সন্ধ্যা হলেই গমগম করতো এলাকাটা। আর এখন সব নিস্তব্ধ। সারাদিনই দেখে মনে হয় রাত দেড়টা বাজে, হয় তো বা আরও গভীর। দু একটা গাড়িও যাচ্ছে তবে তা শুধুই অ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ি।
এই মুহূর্তে রাস্তায় যে দু’ এক জনকে দেখা যাচ্ছে তাঁদের মুখ ঢাকা মাস্কে। মানুষ চাইছে মানুষের থেকে দূরে থাকতে। জানলার বাইরে তাকালেই মনে হচ্ছে হলিউডের কোনও সায়েন্স ফিকশনের সিনেমা দেখছি।
আরও পড়ুন: লকডাউনে ঘরবন্দি সৃজিত-মিথিলা কোথায় ‘ঘুরে এলেন’?
ফরাসি সরকার গোটা দেশে যুদ্ধকালীন সতর্কতা জারি করেছে। মুদিখানা আর ওষুধের দোকান ছাড়া সব বন্ধ। সেখানেও কয়েক ঘন্টা লাইন দিলে তবে এক প্যাকেট পাউরুটি পাওয়া যাচ্ছে। খাবার কেনা বা ডাক্তার দেখানর জরুরি প্রয়োজন না থাকলে বাইরে বেরোতে পারছেন না। আর বেরোলেও সরকারের দেওয়া একটি ফর্ম ফিলআপ করে সঙ্গে রাখতে হচ্ছে। রাস্তায় টহলরত পুলিশ কর্মীরা দেখতে চাইছেন। তাঁরা সন্তোষজনক উত্তর না পেলে ১৩৫ ইউরো (প্রায় ১১ হাজার টাকা) জমিরমানা এমনকি জেলও হতে পারে।
সকালে আমার ঘরের ঠিক নিচে এক বছর দশেকের ছেলেকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলেন এক মহিলা। আজ সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত বাইরে ওই দু’টি প্রাণীর দেখাই পেয়েছি। দু’জনেরই মুখে সাদা মাস্ক আর চোখে আতঙ্ক। অ্যাপার্টমেন্টের কর্মচারীরা ছুটিতে চলে গিয়েছেন। প্যারিসের মতো শহরের বেশিরভাগ হোটেল আর তার বেশিরভাগ ঘর খালি পড়ে রয়েছে। এমনকি হোটেল রুম থেকে অতিথিরা বেরিয়ে গেলে নাকি দরজা বন্ধ করার লোকও নেই, দিনের পর দিন খোলা পড়ে আছে।
আরও পড়ুন: দেশের সব থেকে ধনী দেবতার মন্দিরে কাজ হারালেন ১৩০০ কর্মী
ফ্রান্সের থেকে পাশের ইতালির অবস্থা আরও খারাপ। সেখানে নাকি কবর দেওয়ার লোক পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। ইতালিতে এক একদিনে হাজারের কাছাকাছি লোক মারা গেছে। যতদিন চিনে এ রকম হচ্ছিল, খবর পাচ্ছিলাম উহান প্রদেশ উজাড় হয়ে যাচ্ছে, ততদিন ইউরোপে বসে মানুষ সহানুভূতি জানানো ছাড়া আর কিছুই করিনি। হয়ত তাই আজ ইউরোপের এই অবস্থা। মাত্র একমাসের ব্যবধানে। এখন আমাদের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মারণরোগ।
তবে আমার মনে হয় ইতালি যে ভুল করেছে ভারত তা করেনি। সংবাদমাধ্যম, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে সচেতনতা ছড়িয়ে দিয়েছে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ভারতে যদি আর দু-তিন সপ্তাহ ঘরবন্দি থাকতে পারে ইতালি বা ফ্রান্স হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। ইরান, ইতালি, ফ্রান্স পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে অনেক দেরিতে করেছে। ভারত যদি দু’ সপ্তাহ ধৈর্য দেখাতে পারে, তা হলে তার পর হয়তো আর ঘরবন্দি হয়ে থাকতে হবে না। না হলে পরে হয়তো আর সাবধান হয়েও কোনও লাভ হবে না।
আরও পড়ুন: করোনার মাঝে হঠাৎ এমন উপহার পেয়ে চোখে জল ডেলিভারি বয়ের
আমার মনে হয় আমরা যদি আগামী দু’ সপ্তাহ এই তিনটি জিনিস মেনে চলি তবে ভারত ফ্রান্স হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যেতে পারে-
এক, ঘরের বাইরে বেরনো বন্ধ। আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশী কেউ কারো বাড়ি যাবে না, ডাকবেও না। সব সময় ভিড় এড়িয়ে চলি, এমনকি ধর্মীয় স্থানও। দু’ সপ্তাহ সেদ্ধ ভাত খেয়েই চালিয়ে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করি। চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ যদি বাড়িতে থাকে তাহলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিরিয়ানি মশলা কিনতে না বেরোনোর প্রতিজ্ঞা করি।
দুই, সাধারণ হাইজিন মেনে চলি। খাবার আগে বা এবং ঘন্টায় অন্তত একবার করে সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুয়ে ফেলি। নাকে, মুখে হাত যথাসম্ভব কম দিই।
তিন, "আমি একা মানলে কী হবে? অন্যরা তো মানছে না" বা "এখানে সংক্রমণ নেই। বা আমার কিছু হবে না"-এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ আপনার মাধ্যমে যদি এক জনও সংক্রমিত হন তবে তিনি আপনার পরিবারের কেউ হতে পারেন। যেহেতু তাঁদের সঙ্গেই আপনি দিনের বেশিরভাগ সময়টা কাটাচ্ছেন। আপনিই তাঁদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো? বয়স্ক মানুষ ছাড়াও যাদের হাইপ্রেসার, সুগার, হার্টের অসুখ, কিডনি, ক্যান্সার বা অন্য কোনও ক্রনিক রোগ আছে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলে তাঁদেরও মৃত্যুর সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
আর কিছু দিন এই কয়েকটা বিষয় মেনে চললেই হয়তো পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বভাবিক হয়ে যাবে। আপনার হয়তো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুব বেশি, করোনার সংস্পর্শে এলেও শেষ পর্যন্ত আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু সংক্রমিত অবস্থায় ১৪ দিনের মধ্যে আপনি কারও সংস্পর্শে এলে তাঁর ক্ষতি হতেও পারে। এটুকু মেনে চললে আমরা নিরাপদ থাকব।
সৌরভ মুখোপাধ্যায়,প্যারিস, ফ্রান্স
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)