‘উৎসবে ফিরুন, মমতা-বার্তায় প্রশ্ন’ (১০-৯) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। যখন রাজ্য জুড়ে তিলোত্তমার নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে শোকের আবহ চলছে, তখন মুখ্যমন্ত্রীর উৎসবে ফেরার আহ্বান যেন ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’র মতো। কেউ ভাবতে পারছেন না— মা, মাটি, মানুষের সরকার এতটা অসংবেদনশীল হতে পারে। হাসপাতালের পরিষেবা যাতে বিঘ্নিত না হয়, তা দেখা অবশ্যই মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন করছেন, তা বিচার করার দায়িত্বও তো ছিল তাঁরই। অথচ তিনি বললেন— অনুরোধ করব, পুজোতে ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন। শোকের আবহে এই আবেদন কতটা মানবিক আর কতটা প্রচ্ছন্ন হুমকি— তা রাজ্যের মানুষকে নিশ্চয়ই ভাবিত করবে।
এই প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আরও যা বলেছেন— প্রতি দিন রাতে রাস্তায় মাইক লাগালে অনেক বয়স্ক মানুষের ঘুমের অসুবিধা হয়। রাতে মাইক বাজানো যাবে না, ইত্যাদি। মুখ্যমন্ত্রী কি জানেন এখনও পাড়ায় পাড়ায় জলসা থেকে শুরু করে, রাজনৈতিক জনসভা, বিভিন্ন উৎসব আর অনুষ্ঠানে তারস্বরে গভীর রাত পর্যন্ত মাইক বাজে? প্রশাসন কি এই সবের বিরুদ্ধে কোনও দিন সক্রিয় ভাবে ব্যবস্থা করেছে? বরং দেখা গেছে প্রতিবাদী মানুষদের আক্রান্ত হতে।
তিলোত্তমার মা বলছেন তাঁর ঘরের আলো নিবে গেছে। আমরা পারব কি অন্ধকারে ঘিরে থাকা তাঁর মনের ভিতরটাকে উৎসবের আলোয় ভরিয়ে দিতে?
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
মৃত্যুদণ্ডের যুক্তি
অচিন চক্রবর্তীর ‘ঘৃণার আগুন, জ্বলুক ...’ (৩-৯) শীর্ষক প্রবন্ধের সঙ্গে সহমত হয়েও দু’একটি কথার সংযোজন। পোলিশ চিত্র পরিচালক ক্রিস্তফ কিসলস্কি তাঁর আ শর্ট ফিল্ম অ্যাবাউট কিলিং ছবিতে দেখিয়েছিলেন এক জন অবসাদগ্রস্ত ও দিগ্ভ্রান্ত তরুণ অকারণে, অত্যন্ত নির্মম ভাবে এক প্রৌঢ় ট্যাক্সিচালককে হত্যা করে। অতঃপর ততোধিক নিষ্ঠুর ভাবে হত্যাকারীকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে রাষ্ট্র। পরিচালক এক জন আইনজীবীর মুখ দিয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন, আইন মানবজাতির কল্যাণের জন্য তৈরি হয়েছে, তাই সময়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে তা নিয়ত পরিবর্তনশীল হওয়া উচিত।
মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি রয়েছে। কিন্তু যে মানুষ ধর্ষণ বা হত্যার মতো অপরাধের শিকার হলেন, তাঁর পরিজনের পক্ষে মৃত্যুদণ্ড রদ করার দাবি মেনে নেওয়া প্রায় অসম্ভব। যদিও রাজীব গান্ধীর হত্যাকারী নলিনী মুরুগনকে ক্ষমা করেছিলেন সনিয়া গান্ধী। নলিনীর শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে দেওয়ার সুপারিশও করেছিলেন। তবুও মনে হয়, যন্ত্রণাহীন মৃত্যুর মতো মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার দাবি তোলার মতো মানসিক পরিপক্বতা থেকে ভারতবাসী এখনও অনেক দূরে।
চন্দন চট্টোপাধ্যায়, ভদ্রকালী, হুগলি
পচনের পরে
অচিন চক্রবর্তীর প্রবন্ধটি পড়লাম। বর্তমানের এই উত্তাল সময়ে প্রাণদণ্ডের যৌক্তিকতা নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই। আর জি কর কাণ্ডে এক তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যা একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র, সুনিপুণ ভাবে ঘটানো নৃশংস কার্যাবলি। কাজের জায়গায়, নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে কী করে সংঘটিত হতে পারে এই চরম দুর্ঘটনা? এই সময় জিশু খ্রিস্টের বাণী “পাপকে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়,” বা গান্ধীবাদী হয়ে অহিংসার পথ অনুসরণের কথা বলার কোনও জায়গা নেই। পরম অহিংস মানুষও এই ঘটনায় নির্বিকার থাকতে পারবেন না। শরীরের কোনও অংশে পচন ধরলে যেমন সেই অংশ কেটে ফেলা হয়, তেমন সাংঘাতিক অপরাধের আসামিকেও ছেঁটে ফেলতে হয় সমাজ থেকে। এক রোগ হলেও সব রোগীর ক্ষেত্রে একই ওষুধ কাজ করে না।
মেয়েটি তাঁর কাজের জায়গায়, কর্মরত অবস্থায় (বিশ্রামের সময়) নির্যাতিত, অপমানিত ও নিহত হয়েছে। এই অপরাধের বিচার মহামান্য আদালত করবেন। কী শাস্তি হবে, সেটা তাঁদের উপর নির্ভর করছে। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ভেবে তাঁরা রায় দেবেন না।
অর্চনা ভট্টাচার্য, চুঁচুড়া, হুগলি
পিছনে কারা
সম্প্রতি আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত মহিলা চিকিৎসকের উপর নৃশংস অত্যাচার ও খুনের ঘটনায় বিশ্বব্যাপী আলোড়ন পড়েছে। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে অনেকে কেবলমাত্র ধৃত সিভিক ভলান্টিয়ারের ফাঁসি, এনকাউন্টার প্রভৃতি শাস্তির দাবিতে সরব। প্রশ্ন হল, এ রকম এক ঘৃণ্য অপরাধের পরে সমস্ত তথ্য ও মৃতদেহ লোপাট করার পিছনে কে বা কারা, তা চিহ্নিত করা হবে না কি? একমাত্র অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আওয়াজ না তুলে, কারা এই অপরাধ করাল, তা চিহ্নিত করার দাবি উঠবে, এবং তাদের নাম জনসমক্ষে আনা হবে, এই কামনা করি।
নিকুঞ্জ বিহারী ঘড়াই, কলকাতা-৯৯
ক্ষুদ্রের নীতি
সেমন্তী ঘোষের প্রবন্ধ ‘নিজের গলাটা ছাড়তে হবে’ (৩১-৮) অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে রাজনীতি যে আসলে কী, সে কথাটা শাসক বা বিরোধী দল ইচ্ছে করে গুলিয়ে দিতে চায়। যেন রাজনীতি শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর একচেটিয়া অধিকার। আর জি করের সাম্প্রতিক ধর্ষণ-খুন কাণ্ড আমাদের একটি বিরাট ঝাঁকুনি দিতে সক্ষম হয়েছে। ‘গয়ংগচ্ছ’ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করেছে। তাই একে অবশ্যই ‘জনজাগরণ’ বলা যেতে পারে। সর্বস্তরের মানুষের এই সচেতনতাকেই প্রকৃতপক্ষে সঠিক রাজনীতি বলা যায়।
রাজনীতি হওয়া উচিত ছিল সর্বজন-হিতকর নীতি। অথচ, বর্তমানে শাসক অথবা বিরোধী স্ব স্ব দলের নীতিকেই রাজনীতি বলে প্রচার করছে। এতে শাসকের লক্ষ্য থাকে যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতা ধরে রাখার নীতি। আর বিরোধী দলের উদ্দেশ্য থাকে সমাজে ঘটা অনাচারের সুযোগ নিয়ে শাসকের বিরোধিতা, নিজের দলের ক্ষমতা বৃদ্ধি। দেখা যায়, সে ক্ষেত্রে সব শাসকই ক্ষমতার অধিকারী হয়ে যে কোনও ধরনের বিরোধিতায় অসহিষ্ণু হয়ে পড়ে এবং অমিত বিক্রমে তার প্রতিরোধ করে পুলিশকে দলীয় স্তরে নামিয়ে আনে।
এমনটা আমরা ইতিপূর্বে বামফ্রন্ট আমলেও ঘটতে দেখেছি। এতে সরকারের দাঁত-নখ বিকট ভাবে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। সরকার সর্বদা চায়, যে কোনও বিরোধিতাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে দাগিয়ে দিতে। এতে নাগরিক আন্দোলনকে লঘু করে দেওয়া যায়। কারণ, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনে শাসকের সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়ে যায়।
আসলে, শাসক আর বিরোধী, দু’পক্ষেরই বর্তমান কর্মপদ্ধতি হয়ে দাঁড়িয়েছে গদি ধরে রাখা, অথবা গদি দখল। এই ক্ষুদ্র নীতি বৃহৎ রাজনীতিকে গ্রাস করে আমাদের দেশে দাপিয়ে বিচরণ করছে। এই জন্য শাসক দল দেশের প্রশাসনকেও তার দলের উন্নতির জন্য কাজে লাগায়। বিরোধীদের উপর চালায় দমনপীড়ন। কিন্তু মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন, যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের হিত সাধনের লক্ষ্যে চালিত হয়, সেটিই আসল রাজনীতি। আমাদের উচিত এই জনজাগরণের মাধ্যমে আর জি কর কাণ্ডের সঠিক ও দ্রুত বিচার প্রার্থনা। সেই সঙ্গে, ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসা বর্জ্য, ওষুধ বাইরে চালান-করা সহ যে সব দুর্নীতি উন্মোচিত হয়েছে, সেই সবেরই অবিলম্বে অবসান চাই। মনে রাখা দরকার, আর জি কর একটা নমুনা মাত্র। এমন দুর্নীতি প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ঘটে চলেছে।
তপন কুমার দাস, কলকাতা-১২২