রাজতন্ত্র ভাল জিনিস। প্রজার কাছ থেকে শর্তহীন আনুগত্য লাভ করা যায়। বংশানুক্রমে সিংহাসনে বসা যায়। যিনি রাজা হবেন তিনি জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে জেনে যান কাদের শাসন করা তাঁর জন্মসিদ্ধ অধিকার। প্রজারাও বর্তমান দণ্ডমুণ্ডের কর্তার সঙ্গে হবু কর্তাকেও চিনে ফেলে। গণতন্ত্রে ব্যাপারটা সহজ নয়। এক জন মানুষকে নিজের যোগ্যতায় শাসকের স্থান দখল করতে হয়। যত দিন তিনি নিজে জেতার সঙ্গে অনুগামীদের জিতিয়ে আনবেন, তত দিন তিনি পদে থাকবেন। ব্যর্থ হলে তাঁর জায়গা নেওয়ার জন্য অন্য জন তৈরি আছেন।
আমাদের দেশ খাতায়-কলমে গণতান্ত্রিক হলেও কয়েক শতকের সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণা ছেড়ে বেরোতে পারেনি। তাই দু’-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থায় পুরুষানুক্রমে নেতৃত্বের বন্দোবস্তে বিশ্বাস করে। তাদের কর্মী, সমর্থক, ভোটাররাও এই ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেস অতীতে বছর বছর সভাপতি নির্বাচন করত। এই ব্যবস্থা আটকে গেল ইন্দিরা গান্ধীতে এসে। তিনি অদ্ভুত ক্যারিসমায় দেশের নাগরিকদের আস্থা অর্জন করলেন। গত পঞ্চাশ বছর দলে এমন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, গান্ধী পরিবারের সদস্য ছাড়া বাকি কাউকে কেউ মানবে না। বরং সকলে পরিবারের সুনজরে থেকে ক্ষমতার ভাগ পেতে চান। ভাগ্যের পরিহাস, পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম দেশবাসী তো দূর স্থান, দলের লোকের মন জয় করার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। পরিণতি, সর্বত্র হার আর হার। ভোটপ্রাপ্তির হার কমতে কমতে তলানিতে পৌঁছেছে।
রাজতন্ত্রের বিপদ হল, কোনও অযোগ্য রাজাকে পরিবর্তন করার উপায় থাকে না। হয় তিনি বহিঃশত্রুর আক্রমণে পরাজিত হন, নয়তো সেনাপতি বা মন্ত্রীর অভ্যুত্থানে রাজ্যচ্যুত হন। সিংহাসনহারা রাজারা এই অবস্থাতেও জলসাঘরের বিশ্বম্ভর রায়ের মতো নিজের ছদ্ম-আভিজাত্য ভুলতে না পেরে ধনেপ্রাণে ডুবে যান।
পার্থ নন্দী, শেওড়াফুলি, হুগলি
নতুন ফ্রন্ট
সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল দেখে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দুর্দশা প্রকট হল। ২০১৪ সালের লোকসভার ফলাফল দেখে মনে হয়েছিল, স্বাধীনতার পরে কংগ্রেস দলটার আর রাজনৈতিক ময়দানে না থেকে, সংসদীয় রাজনীতির থেকে দূরে থাকাই উচিত। দেশের ২৯টি রাজ্যের মধ্যে জাতীয় কংগ্রেস মাত্র ৪৪টা আসনে জয়লাভ করে, যা ছিল ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে কংগ্রেস দলের সব থেকে বড় বিপর্যয়। সংসদে ৫৪৩টা আসনের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ৪৪টা আসন দখল করে, যা ২০০৯ সালে ছিল ২০৬।
কেন দেশের জনগণ কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করছে? আমার মনে হয়, একটা দল জনগণের মনে স্থান পায় তার নীতি ও কাজের মধ্যে দিয়ে। স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নেতার জন্য একটা দলের অস্তিত্ব টিকে থাকে। এক জন জাতীয় নেতার মুখ, আর রাজ্যে দলীয় সংগঠন ও জনসংযোগ, এই দুটো যে কোনও রাজনৈতিক দলের অস্ত্র। নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প বর্তমানে রাজনীতিতে নেই বললেই চলে। রাহুল গান্ধী বা প্রিয়ঙ্কা গান্ধী বঢরাকে দেশের মানুষ এখনও গ্রহণ করতে পারছেন না। কংগ্রেসের রাজ্য নেতাদের মধ্যেও তেমন নেতা নেই যাকে রাজ্যবাসী গ্রহণ করবেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে বিজেপির জয় কিন্তু এসেছিল নরেন্দ্র মোদীর মুখ দেখেই। তিনি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। বিজেপি আসার পরে দেশের বড় কোনও উন্নয়ন হয়নি, দেশের মানুষ খুব সুখে আছেন সেটাও নয়, তবুও বিজেপি ভোট পাচ্ছে। কেন? একটাই উত্তর নরেন্দ্র মোদী, যার বিকল্প দেশের মানুষ পাচ্ছেন না এখনও। দ্বিতীয় কারণ, বিরোধী ভোট ভাগ। কংগ্রেসের যোগ্য রাজ্য নেতাদের দলত্যাগ ও আঞ্চলিক দল গঠন কংগ্রেসকে রক্তশূন্য করছে।
কংগ্রেস দলের ভবিষ্যৎ কোন নেতার হাতে দিলে দলটা আবার বেঁচে উঠতে পারে, তা হাই কমান্ড এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না। এ বছর পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফল কংগ্রেসকে হয়তো আবার ভাঙবে। ‘কংগ্রেস’ দলটা ভাঙতে ভাঙতে এখন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। তাই ‘জাতীয় কংগ্রেস ফ্রন্ট’ নাম দিয়ে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে-যাওয়া দলগুলি যদি একটা ফ্রন্ট তৈরি করে, এবং নতুন নেতৃত্ব সামনে আনে, তা হলে নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প নেতা হয়তো দেশবাসী খুঁজে নেবেন।
পার্থময় চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
জিয়নকাঠি
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে দলটির নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে, সেই কংগ্রেস দলটি আজ তার রাজনৈতিক অস্তিত্ব এবং গুরুত্ব প্রায় হারাতে বসেছে। পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হল যে, মাত্র দু’টি রাজ্য (রাজস্থান ও ছত্তীসগঢ়) বাদে অন্যান্য রাজ্যে কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন। যে উত্তরপ্রদেশ একদা কংগ্রেসের দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসাবে পরিগণিত হত, সেখানে এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৪০৩টি আসনের মধ্যে শুধুমাত্র দু’টি আসনে জয়ী হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ৯০ শতাংশেরও বেশি আসনে কংগ্রেস প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে! ফলে নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্ন ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ বাস্তবায়িত হতে বেশ কয়েক কদম এগিয়েছে। কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে বিজেপি-বিরোধী জোট গঠন পরোক্ষ ভাবে মোদীর স্বপ্নটিকেই সত্যি হতে সাহায্য করছে।
কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ অবস্থাও ভাল নয়। বিগত দু’টি লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী দলের তকমা পেতে ব্যর্থতা, একের পর এক বিধানসভা নির্বাচনে পরাজয় সত্ত্বেও নেতৃত্বের রাশ গান্ধী পরিবারের হাতে রয়ে গিয়েছে। এবং রাহুল গান্ধীর কর্মপদ্ধতির কারণে বেশ কিছু প্রবীণ ও প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের বিদ্রোহ ও প্রথম সারির নেতাদের দলত্যাগ কংগ্রেসকে জর্জরিত করেছে।
ভারতের রাজনীতিতে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলের উত্থান অবশ্যই বিশেষ বার্তা বয়ে আনে, সেই সব রাজ্য বা অঞ্চলের দাবিগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। কিন্তু সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলির উপস্থিতি এবং সুস্থ প্রতিযোগিতা কাম্য। সুবিশাল ও বৈচিত্রময় ভারতকে শাসন করতে হলে আরও বিস্তৃত এবং গভীর দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন, যেটা আঞ্চলিক দলগুলির নিকট আশা করা চলে না। এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠিত সর্বভারতীয় দল বলতে দু’টি, বিজেপি এবং কংগ্রেস। সেই কারণে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের মতো ঐতিহ্যশালী দলটির রাজনৈতিক অস্তিত্ব বা গুরুত্ব হারানো ভারতের কাছে অবশ্যই এক বিপদের সঙ্কেত! ২০০৪ সালে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া গান্ধী যেমন তাঁর একটি ‘মাস্টারস্ট্রোক’-এ মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করে সমস্ত বিরোধী দলকে চুপ করিয়ে দিয়েছিলেন, তেমনই আশা করা যায় এ বারও তিনি কোনও কৌশল উদ্ভাবন করবেন, যাতে কংগ্রেস এই ঘোর দুর্দশা থেকে পুনরুজ্জীবিত হয়।
অমিত কুমার চৌধুরী, কলকাতা-৭৫
দাবিদার
এক জন আইআইটি-র ইঞ্জিনিয়ার, আইআরএস, সফল শাসনকর্তা ও বর্তমানে নিজের রাজ্য ছাড়া অন্য আর একটি রাজ্যেও ইতিমধ্যেই যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন, সঙ্গে রয়েছে হিন্দি বলয়ে আধিপত্য। আর এক জনের মধ্যমানের শিক্ষা, অন্য রাজ্যে দাগ ফেলার তেমন কোনও প্রমাণ নেই। পাশের রাজ্যে আর এক জন আছেন, যাঁর ভাবমূর্তির স্বচ্ছতা, রাজ্য চালনায় দৃঢ়তার জন্য যোগ্য শাসকরূপে পরিগণিত হন, তবে নিজে কখনও প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার হওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেননি। প্রশ্ন হল, দেশের বিবেকবান মানুষ আজ শাসকবিরোধী মুখ এবং দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে এঁদের মধ্যে কাকে বেছে নেবেন?
সুব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা-১০৪