Mid Day Meal

সম্পাদক সমীপেষু: শিশুর আহার

যারা আমাদের দেশের ভবিষ্যতের নাগরিক, এবং যাদের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য প্রতি দিন পুষ্টিকর খাবারের একান্ত প্রয়োজন, তাদের দুপুরে পেট ভরে খাওয়ার জন্য মাত্র সাড়ে পাঁচ টাকার মতো বরাদ্দ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২২ ০৬:০৩
Share:

‘দুপুরের পাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ১ টাকারও কম!’ (৯-১০) শীর্ষক প্রতিবেদন প্রসঙ্গে বলতে চাই, এই বরাদ্দ হাস্যকর। শিশুস্বাস্থ্যকে পঙ্গু করার নামান্তর এই বরাদ্দ। সম্প্রতি শুনলাম, জনৈক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে আনাজের বাজারে দেখেই এক দোকানদার হাঁক ছাড়েন, “সাড়ে তিন টাকায় বাসি-পচা আনাজ ছাড়া আর কী পাবেন!” প্রায় সব দোকানদারই জানেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪ টাকা ৯৭ পয়সা শিশুপ্রতি বরাদ্দ। যে বিদ্যালয়ে ৫০ জনের মতো ছাত্র, সেখানে গ্যাসের জন্য দিনে ৭০-৭৫ টাকা খরচ হয়ে যায়। গ্যাসের খরচ বাদ দিলে শিশুর জন্য মাথাপিছু খরচ দাঁড়ায় সাড়ে তিন টাকা মতো। সেই পয়সায় যে ভাল, টাটকা আনাজপাতি হয় না, দোকানদাররা জানেন।

Advertisement

দীর্ঘ দিনের বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবির পর কেন্দ্রীয় সরকার শিশুপ্রতি বরাদ্দ ৪৮ পয়সা বাড়িয়ে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা করেছে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে— কেন্দ্রীয় সরকারের একটি টেকনিক্যাল উচ্চশিক্ষার কলেজে, যেখানে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পাশ করে ঢুকতে হয়, সেখানে ছাত্রদের দুপুর ও রাতের মিল বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার কিছু অনুদান দেয়। সঙ্গে ছাত্রকে দিতে হয় ১২০ টাকা প্রতি দিন, দু’বেলা খাবার খরচ বাবদ। তবুও সে খাবারের যা মান, তা না খেয়ে বেশির ভাগ ছাত্র বাইরে থেকে কিনে খায়।

পাশাপাশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা, যারা আমাদের দেশের ভবিষ্যতের নাগরিক, এবং যাদের যথাযথ বৃদ্ধির জন্য প্রতি দিন পুষ্টিকর খাবারের একান্ত প্রয়োজন, তাদের দুপুরে পেট ভরে খাওয়ার জন্য মাত্র সাড়ে পাঁচ টাকার মতো বরাদ্দ। কল্পনা করা যায়! ভারতের এক জন নাগরিক হিসেবে এই পরিসংখ্যানের চেয়ে লজ্জাকর আর কিছু মনে হতে পারে না। শিশুর অভিভাবক হিসেবে আমি কিছু স্কুলে গিয়ে দেখেছি, যে চাল শিশুদের খাওয়ানো হচ্ছে, তা রেশনের দু’টাকা কেজি চালের থেকেও নিম্নমানের।

Advertisement

এই সামান্য পরিমাণ টাকার মধ্যে প্রতি মাসে চার-পাঁচ দিন ডিম, ডাল, সয়াবিন, খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা। মিড-ডে মিল দফতর থেকে মাসে মাসে ‘অফিশিয়াল ভিজ়িট’ হয়। স্কুলে এসে তাঁদের কী গালভরা কথা— এই কোম্পানির নুন, ওই কোম্পানির সর্ষের তেল, অমুক কোম্পানির মশলায় রান্না করতে হবে। তাঁরা ঠিকই বলেন। বাচ্চাদের খাবার ভাল তেল-মশলায় রান্না করাই উচিত। কিন্তু বরাদ্দ না বাড়ালে কী করে তা সম্ভব হবে?

সর্বোপরি, রান্নার কাজ যাঁরা করেন, তাঁদের সাম্মানিক সামান্য। এক জন কর্মী সারা দিন স্কুলে রান্না করে হয়তো মাত্র ৫০ টাকা পান। সেই টাকায় তাঁরই বা চলবে কী করে, সেটাও ভাবা হয় না।

তিলোত্তমা রূপকথা, ধুবুলিয়া, নদিয়া

আর প্রাতরাশ?

শিশুর পরিপূরক পুষ্টির উৎস হিসেবে বিবেচিত, মিড-ডে মিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের প্রতি কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রকের মনোভাব বাস্তবে যে কতটা নিরাশাজনক, ‘দুপুরের পাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ১ টাকারও কম’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি সেটাই প্রতিপন্ন করে।

ভারত সরকারের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় প্রকল্পে পুষ্টি সহায়তার সংজ্ঞায় রয়েছে, প্রাথমিক শ্রেণির শিশুর জন্য দৈনিক অন্তত ১২ গ্রাম ও ৪৫০ ক্যালরি, আর উচ্চ প্রাথমিক শ্রেণির জন্য ২০ গ্রাম ও ৭০০ ক্যালরি ধার্য করতে হবে। প্রশ্ন হল, মিড-ডে মিল খাতে কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দ সঙ্কোচনের এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কী ভাবে হবে? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও দু’বছরের বেশি সময় কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক বরাদ্দ বাড়ায়নি। এই বছর ১ অক্টোবর থেকে এই খাতে বরাদ্দ যৎসামান্য বেড়েছে। প্রাথমিক স্তরে মাথাপিছু মাত্র ৪৮ পয়সা বেড়ে এ বারে মোট হয়েছে ৫ টাকা ৪৫ পয়সা, এবং উচ্চ প্রাথমিকে মাথাপিছু ৭২ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৮ টাকা ১৭ পয়সা। কেন্দ্র ও রাজ্য ৬০:৪০ অনুপাতে এই অর্থ দেবে।

দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্যের দাম বাজারে চরমে উঠলেও দেখা যাচ্ছে, রান্নার চাল বাদে জ্বালানি-সহ যাবতীয় ভোজন সামগ্রীর খরচ এই বরাদ্দের মধ্যেই রয়েছে। একটি পোলট্রি ডিমের দাম যেখানে ৫ টাকারও বেশি, সেখানে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক শ্রেণিতে এমন বৃদ্ধি কি উপহাসের নামান্তর নয়? আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়— এই প্রকল্প চালু করার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যালয়ে ভর্তির সংখ্যা বৃদ্ধি করা। যদি এই প্রকল্পে সরকারি অর্থ-জোগানের বিষয়টি ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়, তবে এর প্রভাব কি শিক্ষার সঙ্কটকেও বহু গুণ বাড়িয়ে দেবে না?

এই প্রসঙ্গে আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় যোগ করা যায়। ২০১৮ সালে, সরকার-নিযুক্ত একটি কমিটি সমীক্ষায় দেখিয়েছিল, সরকারি স্কুলে ৩৮ শতাংশেরও বেশি শিশু সকালের খাবার না খেয়েই ক্লাসে উপস্থিত হয়, এবং মধ্যাহ্নভোজ প্রকল্পের অধীনে পরিবেশিত খাবার তাদের দিনের প্রথম খাবার। কমিটি তখন স্কুলে প্রাতরাশ পরিবেশনের সুপারিশ করেছিল। এ ছাড়া, ২০২০ সালে নতুন শিক্ষা নীতিও (এনইপি) শিশুদের প্রাতরাশের প্রয়োজনের কথা বলে। সেই সময় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানও সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মিড-ডে মিল প্রকল্পের অধীনে প্রাতরাশ চালু করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে সরকারের। দুর্ভাগ্যের বিষয়, মিড-ডে মিলের নাম বদলে ‘প্রধানমন্ত্রী পোষণ প্রকল্প’ করা হলেও, প্রাতরাশকে অন্তর্ভুক্ত করা হল না। এমন মূল্যবান প্রস্তাবটি এখন বিশ বাঁও জলে! অথচ, ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া-সহ বিশ্বের বহু উন্নয়নশীল দেশে স্কুলে শিশুর প্রাতরাশ চালু আছে। শিশুর প্রয়োজনীয় খাদ্য-সংস্থানের জন্য অর্থ বরাদ্দে যদি জোর দেওয়া না হয়, এ দেশের ১১.৮০ কোটি শিশু তথা শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ কী ভাবে সুরক্ষিত হবে?

পৃথ্বীশ মজুমদার, কোন্নগর, হুগলি

ক্ষুধার গহ্বর

সম্পাদকীয় ‘এতই দরাজ’ (১৭-১০) পড়লাম। প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে মিড-ডে মিলের জন্য বরাদ্দ বেড়েছে অতি সামান্য। আর কোনও বরাদ্দই নেই নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকার বুঝেছে, নবম শ্রেণিতে উঠলেই পড়ুয়াদের পেটে আর খিদে থাকে না। স্কুলের এক পাশে থাকা রান্নাঘরের গন্ধ শুঁকেই পড়াশোনা করতে হবে নবম-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের। দেশ এই জন্যই ক্ষুধা-গহ্বরে চলে যাচ্ছে। প্রতি বছর ১৪ অক্টোবর ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’-এর ক্ষুধা-সূচক সমীক্ষা প্রকাশিত হচ্ছে, আর তাতে ভারত ক্রমশ তলানিতে চলে যাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ তা দেখে হয়তো করুণার হাসি হাসছে। ২০২১ সালে ক্ষুধা-সূচক সমীক্ষায় ১৩৫টি দেশের মধ্যে ভারতের ঠাঁই হয়েছিল ১০১ নম্বরে। এ-বছর ১২১টি দেশে সমীক্ষায় ভারত ১০৭ নম্বরে।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক মাপা হয় চারটি বিষয়কে সামনে রেখে— সামগ্রিক অপুষ্টি, পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের বয়স অনুপাতে উচ্চতা, ওজন, এবং পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের মৃত্যুর হার। মনে রাখতে হবে, এই সমীক্ষা পাঁচ বছর বয়সের কম শিশুদের নিয়েই হয়। তাতেই ভারতের এই হাল। যদি এই ক্ষুধা সূচক সমীক্ষা পাঁচ বছরের বেশি বয়সিদের মধ্যে হয়, তবে ভারতের দুরবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা আন্দাজ করলে শিউরে উঠতে হয়।

ভারতে মধ্যবিত্তদের ঘরেও প্রতি একশো জনে ১৪ জন শিশু, এবং দরিদ্র ঘরে প্রতি একশো জনে ২৯ জন শিশু অপুষ্টি নিয়েই জন্মাচ্ছে। স্কুলে গিয়ে তারা মিড-ডে মিল খেয়ে পুষ্টি পাবে কী করে, সেখানেও কার্পণ্য চলছে। স্কুল বেশি বরাদ্দ নিতে বাড়তি ছাত্রছাত্রী এখন দেখাতে পারে না। ছাত্রছাত্রীদের নাম নথিবদ্ধ করা থাকে। তার উপর, যাঁরা রান্না করেন, তাঁরাও তো খান।

সর্বোপরি উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েরাও প্রায়শই মিড-ডে মিলের খাবার লাইনে বসে যায়। ‘খিদে পেয়েছে’ বললে শিশুদের উঠিয়ে দেওয়া যায় কি? এই বাজারে সরকারের বরাদ্দ টাকায় সুষম আহার আকাশকুসুম কল্পনামাত্র।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়, এক্তেশ্বর, বাঁকুড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement