Central Budget Session 2025

সম্পাদক সমীপেষু: উচ্চবিত্তের বাজেট

আসলে মোদী-অর্থনীতি, একটু অন্য ধাতের। উনি হয়তো জানেন যে বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা যাঁদের রোজগার, তাঁরা কখনওই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পড়েন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৬:৫৩
Share:

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায় ‘তিন শতাংশের বাজেট’ (৩-২) শীর্ষক প্রবন্ধে কঠোর সত্য কথা বলেছেন। ঠিকই বলেছেন আয়ের হিসাব অনুযায়ী মধ্যবিত্তের কোনও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কিন্তু যাঁদের আয় নগণ্য তাঁদের কথা সে ভাবে পেলাম না। আমি বলছি বেসরকারি সংস্থা থেকে অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ নাগরিকদের কথা, যাঁদের মাসিক পেনশন এক থেকে দু’হাজার টাকা। অথচ ‘ইপিএস-৯৫’ নামে যে কমিটি তৈরি হয়েছিল তার সুপারিশ অনুযায়ী প্রত্যেক পেনশনভোগী প্রবীণ নাগরিকদের অন্তত মাসিক ৭৫০০ টাকা করে দেওয়ার কথা।

Advertisement

কিন্তু নির্মলা সীতারামন বোধ হয় এই কারণে প্রবীণ নাগরিকদের কিছু দেননি, কারণ তাঁরা জনসংখ্যার মাত্র পাঁচ শতাংশের মতো। নরেন্দ্র মোদী নিজে প্রবীণ হয়েও, প্রবীণ নাগরিকদের দুরবস্থার কথা চিন্তা করেননি। রাজা যদি চিন্তা না করেন তা হলে মন্ত্রীর তো কিছু করার নেই।

আসলে মোদী-অর্থনীতি, একটু অন্য ধাতের। উনি হয়তো জানেন যে বাৎসরিক ১২ লক্ষ টাকা যাঁদের রোজগার, তাঁরা কখনওই মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে পড়েন না। তাঁরা ধনী না হলেও, উচ্চবিত্ত তো বটেই। আয়কর শূন্য করে তাঁদের পকেট ভরালে কেবলমাত্র ৩ শতাংশ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো হবে। তাতে কি বাজারে চাহিদা বাড়বে? বাড়বে না। আর চাহিদা না বাড়লে জিডিপি যে কমে এ তো অর্থনীতির গোড়ার কথা। ১৪০ কোটি মানুষের দেশে ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হয় যে দেশে, সে দেশে কী করে বাজারে চাহিদা বাড়বে? এই সংখ্যক মানুষকে যদি ছেড়ে রাখা হয় তা হলে বাকি ৬০ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র তিন শতাংশ আয়করদাতা। আবার ওই ৬০ কোটি মানুষের মধ্যেও ক্রয়ক্ষমতা ৫ শতাংশের মতো। তা হলে মোট ক্রয়ক্ষমতা দেখা যাচ্ছে, সারা দেশে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষের আছে। সুতরাং এটা বলা যায় যে, এই বাজেট গরিবদের জন্যও নয়, আবার মধ্যবিত্তদের জন্যও নয়, এই বাজেট হল শুধুমাত্র ধনী এবং উচ্চবিত্ত মানুষদের জন্য।

Advertisement

কমল চৌধুরী, কলকাতা-১৪০

শুধুই বঞ্চনা

সীমন্তিনী মুখোপাধ্যায়ের ‘তিন শতাংশের বাজেট’ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, নির্মলা সীতারামন দেশের বিনিয়োগকারীদের প্রসঙ্গে বলেছেন, “তাঁদের শক্তি কতখানি তা কি তাঁরা নিজেরাই জানেন না? প্রাণ খুলে বিনিয়োগ করতে এত দ্বিধা কেন তাঁদের?” বাস্তবে মুনাফার নিশ্চিত সম্ভাবনা না দেখলে বিনিয়োগকারীদের যত শক্তিই থাকুক তাঁরা বিনিয়োগ করেন না, তা যতই তাঁদের সরকার করছাড় দিক। ২০১৯-এ কর্পোরেট করের হার বিজেপি সরকার ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করেছিল ২২ শতাংশ৷ সরকারের দাবি ছিল এর ফলে সাশ্রয় হওয়া অংশতে লগ্নি বাড়াবেন তাঁরা। বাস্তবে তা কিন্তু হয়নি৷ অথচ দীর্ঘ দিন ধরে পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিশেষজ্ঞরাও দাবি করছিলেন জনগণের হাতে আরও অর্থ তুলে দিতে অতিধনীদের উপর সম্পদ কর চাপানো হোক। কিন্তু সরকার সম্পদ কর চাপানো দূরের কথা, কর্পোরেট করের পরিমাণটুকুও বাড়াল না। বরং তা ব্যক্তিগত করদাতাদের সর্বোচ্চ হারের থেকে অনেক কমই রেখে দেওয়া হল। পরিবর্তে সরকার জনসংখ্যার অতি ক্ষুদ্র অংশের করছাড় দিয়েই দায়িত্ব সারল। তা হলে কি বুঝতে হবে? কর্পোরেট মহলকে তুষ্ট রাখাই কি তাদের উপর কর না চাপানোর কারণ?

বাস্তবে দেশের যে বাকি ৯০ শতাংশ সাধারণ মানুষ, যাঁরা বাজারের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ক্রেতা, যাঁদের রোজগার কম, আয়করের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই, যাঁদের হাতে অর্থের পরিমাণ বাড়লেই একমাত্র অর্থনীতি সত্যি সত্যিই চাঙ্গা হতে পারত, তাঁদের কেনার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য এই বাজেটে সরকারের তেমন কোনও পদক্ষেপই চোখে পড়ল না। উপরন্তু কর ছাড় দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে ১ লক্ষ কোটি টাকা রাজস্ব সরকারের কম আয় হচ্ছে তা এই বঞ্চিত জনগণের ঘাড়ের উপরই চাপিয়েছে সরকার। এই টাকা জোগাড় করতে কেন্দ্রীয় সাহায্যে চলা সরকারি প্রকল্পে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা খরচ ছাঁটাই করেছে। রাজ্যগুলির জন্য অর্থ কমিশনের অনুদান প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা কমিয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি বরাদ্দ যে ছিটেফোঁটাটুকু জুটত সেটুকুতেও এ বার টান পড়বে।

কর্মহীন অর্থাৎ বেকারদের জন্য বাজেট কিছুই দিল না। সরকার যতই মাঝারি ও ছোট সংস্থাগুলিকে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলুক, প্রযুক্তির অসাধারণ উন্নতির ধ্বজাবাহী বর্তমান সময়ে বড় শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পাল্লা দেওয়া এই সংস্থাগুলির পক্ষে কতটুকু সম্ভব? অন্য দিকে, কর্পোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা বিপুল অঙ্কে বাড়লেও এই সংস্থাগুলি এক দিকে যেমন নতুন কর্মী নিয়োগের পরিবর্তে কৃত্রিম মেধা এবং রোবট ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে, মানবকর্মী নিয়োগ করতেও তাদের যেমন অনীহা, তেমনই তাদের কর্মীদের সামান্য বেতন বাড়াতেও তারা রাজি হচ্ছে না।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই বাজেটের লক্ষ্য সরকারের কোষাগার ভরানো নয়, নাগরিকের পকেট ভরানো। সেই নাগরিক তা হলে কারা? দেশের ৯০ ভাগ মানুষ কি তা হলে সেই নাগরিক নন? তাঁদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য বাজেটে কোনও পদক্ষেপ কই? অথচ এই প্রধানমন্ত্রীই এক দিন বলেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’। সবার পাশে থেকে সবার বিকাশ ঘটানো। তিনি তা হলে সে দিন দেশের মানুষকে এমন কথা বলেছিলেন কেন? সরকারি নীতিতে আর্থিক বৈষম্য আজ আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। কর্পোরেট মুনাফা গত ১৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। তা সত্ত্বেও তাদের উপর ‘করের চাপ’ বাড়াননি প্রধানমন্ত্রী। সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করা ছাড়া সরকারের কি আর কিছু করার নেই?

সমর মিত্র, কলকাতা-১৩

ফাঁকি দিলেন

‘তিন শতাংশের বাজেট’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে বলি, একে ঠিক তিন শতাংশের বাজেট বললে কিন্তু ভুলই হবে। এটা তো সমগ্র দেশবাসীর বাজেট। তবে এর মধ্য দিয়ে ‘সবকা বিকাশ’ হবে, না কি অধিকাংশের ‘বিনাশ’ হবে, সেটা কিন্তু ভিন্ন আলোচনার বিষয়।

অপেক্ষা করলেই দেখা যাবে, আজ আয়করে ছাড় দিয়ে এই খাতে যে কম রাজস্বের সংস্থান করা হল তা গরিব নিম্নবিত্তদের অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও নীচে নামিয়ে দিয়ে ঠিক পুষিয়ে নেওয়া হবে। তাই তো ১০০ দিনের কাজের ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো হল না। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে কোনও সুস্পষ্ট পদক্ষেপ দেখা গেল না। দেখা গেল না কর্মসংস্থান বাড়ানোর, বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। রেলযাত্রীদের জীবনের এবং যাপনের নিরাপত্তা কিংবা দুরবস্থা দূরীকরণের প্রশ্নে তো দেখছি মুখে কুলুপ এঁটেছে কেন্দ্রীয় বাজেট। বাজেটের আগেই জীবনদায়ী এবং বহুল ব্যবহৃত বহু ওষুধের দাম বাড়িয়ে বাজেটে সেই ওষুধের দাম কিছুটা কমিয়ে দেওয়ার যে চালাকি দেখা গেল, তার পর কি একে কোনও ভাবেই জনমুখী বাজেট হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়?

মধ্যবিত্তের প্রত্যাশা পূরণের কথাও যদি বলা হয় সেখানেও অনেক ফাঁক, অনেক ফাঁকি। ৩৩ শতাংশ মধ্যবিত্তের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশকে কিছুটা স্বস্তি দিয়ে তারই জয়ধ্বনি হল, তা নিয়ে টেবিল চাপড়ানোও চলল। ‘জ্ঞান’ (গরিব, যুবা, অন্নদাতা, নারী) নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের পক্ষ থেকে যত বড় বড় কথাই বলা হোক না কেন, জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করলে দেখা যাবে এঁরাও এই বাজেটে উপেক্ষিত। আয়করে ছাড় দিয়ে ভোগব্যয় কতখানি বাড়বে জানি না, যদি বাড়েও তার ফসল ঘরে তুলবে এ দেশের বৃহৎ পুঁজির মালিকরা। যাঁরা তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারের মূল চালিকাশক্তি।

গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement