নরেন্দ্র মোদী সরকার ২৮ অগস্ট, ২০১৭ সালে দেউলিয়া বিধি এনে দাবি করেছিল, এর ফলে ব্যাঙ্কগুলি তাদের বকেয়া ঋণ আদায়ে অনেক সুবিধা পাবে। সরকারের মতে, যে সব ঋণখেলাপি সংস্থা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করছে না, বা করতে পারছে না, তাদের দেউলিয়া ঘোষণা করার দাবি নিয়ে ব্যাঙ্কগুলি আদালতে যাবে। তার পর ওই সংস্থা নিলামে তুলে তারা বকেয়া পাওনা উদ্ধার করতে পারবে। সে দাবি যে অন্তঃসারশূন্য, তা দেখা যাচ্ছে প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রতিবেদনে (‘দেউলিয়া বিধিতে ব্যাঙ্কের আয় স্বল্পই, উদ্বিগ্ন কেন্দ্র’, ২১-৬)। ভিডিয়োকন-এর কাছে এসবিআই, আইডিবিআই ব্যাঙ্ক-সহ বেশ কয়েকটি ব্যাঙ্কের মিলিত পাওনা ছিল প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ঋণ শোধ করতে না পারায় ব্যাঙ্ককর্তারা আদালতের মাধ্যমে ভিডিয়োকনকে দেউলিয়া ঘোষণা করে, তা বেচে দিয়ে টাকা উদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। বেদান্ত গোষ্ঠী ২,৯০০ কোটি টাকায় ভিডিয়োকন কেনার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে। ৪২ হাজার কোটি টাকার উপর লোকসান হলেও ব্যাঙ্ককর্তারা তাতেই রাজি ।
শিবা ইন্ডাস্ট্রিজ়ের কাছে আইডিবিআই ব্যাঙ্ক-সহ একগুচ্ছ ব্যাঙ্কের প্রায় ৪,৮৬৩ কোটি টাকা বকেয়া ছিল। ব্যাঙ্ককর্তারা ৯৩ শতাংশের বেশি পাওনা টাকা ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছেন। দেউলিয়া বিধি প্রয়োগ করে ব্যাঙ্কগুলি এযাবৎ গড়ে মাত্র ২০ শতাংশ বকেয়া উদ্ধার করতে পেরেছে।
এ ভাবেই ব্যাঙ্কশিল্প দুর্বল হয়ে পড়ছে। দাওয়াই হিসেবে কেন্দ্র তার রাজস্ব থেকে ব্যাঙ্কে পুঁজি জোগাবে। বলা বাহুল্য, এই রাজস্ব হল সাধারণ মানুষের করের টাকা। এই টাকা দিয়ে ব্যাঙ্কগুলিকে সবল করে ব্যক্তি মালিকদের কাছে বেচে দেওয়ার আয়োজন চলছে সরকারের পক্ষ থেকে। কারা কিনবে এই ব্যাঙ্ক? কিনবেন বড় বড় শিল্পপতিরা, যাঁরা অনেকেই ঋণ বকেয়া রেখেছিলেন। ধনকুবেরদের স্বার্থরক্ষাকারী সরকারি নীতিই ব্যাঙ্কগুলিকে এই দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে। এর প্রতিরোধে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। ঋণ আদায়ে কঠোর পদক্ষেপ করতে বাধ্য করতে হবে সরকারকে।
গৌরীশঙ্কর দাস, সাধারণ সম্পাদক, ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ় ইউনিটি ফোরাম
ক্ষতি গ্রাহকের
কোটিপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করতে চান না, অনেকে বিদেশে পালিয়ে যান। ব্যাঙ্কগুলি যদি বকেয়া টাকার মাত্র ৭ শতাংশের বিনিময়ে ঋণ মকুব করে দেয়, তা হলে ভবিষ্যতে শিল্পপতিরা ঋণ শোধ করতেই চাইবেন না। অনাদায়ি ঋণের জন্য ব্যাঙ্কগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দেউলিয়াও হতে পারে। ব্যাঙ্ক উঠে গেলে সেই ক্ষতি সাধারণ গ্রাহকের। কংগ্রেস, ইউপিএ বা বিজেপি জমানায় ব্যাঙ্কে অনাদায়ি বড় ঋণগ্রহীতাদের তালিকা সংসদে পেশ করার জন্য বার বার দাবি উঠলেও, কোনও সরকারই তাতে কান দেয়নি। কারণটা সহজেই অনুমেয়। শিল্পপতিদের উপর চাপ সৃষ্টি করলে পার্টি ফান্ডে টাকা জোগাবে কে? এখন প্রশ্ন জাগে, ব্যাঙ্কের মোটা অঙ্কের ঋণ নামমাত্র টাকায় মিটিয়ে নেওয়ার নীতি তথা পদ্ধতি সম্পর্কে সরকারের অবস্থান কী? এ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদদের অভিমতই বা কী ?
কুমার শেখর সেনগুপ্ত, কোন্নগর, হুগলি
আলস্য নয়
আশা করেছিলাম, এক জন দায়িত্ববান বাজার-বিশেষজ্ঞ হিসেবে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ঝুঁকি নিয়েও আলোকপাত করবেন অমিতাভ গুপ্ত (‘টাকা জমাতেও আলস্য’, ২০-৬)। কিন্তু তিনি তা বোধ হয় এড়িয়ে গেলেন। পরিসংখ্যান বলছে যে, বিগত তিন বছরে ইকুইটি-নির্ভর ‘এসআইপি’গুলির ৫০% ফান্ড বাৎসরিক ১৩% থেকে ২৩% ক্ষতি প্রদান করেছে। এমনকি ঋণপত্র-নির্ভর এসআইপি, যেগুলিকে তুলনামূলক ভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়, তার অধিকাংশই বিগত তিন বছর ধরে লগ্নিকারীদের ক্রমশই ক্ষতি প্রদান করে চলেছে। ফান্ড হাউসগুলি সরাসরি বিনিয়োগের জন্য একাধিক ব্যবস্থা করে দিয়েছে। তথাপি এখনও মোট লগ্নিকারীদের মাত্র ৫% সরাসরি বিনিয়োগ করে থাকেন। স্বভাবতই মধ্যস্থতাকারী অধিক ঝুঁকিসম্পন্ন ফান্ড বিক্রি করে দেন, যদি তাঁর বেশি কমিশন মেলে, যা অধিকাংশ সময়েই বিনিয়োগকারীর স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যায়। আরও উল্লেখ করি যে, বর্তমানে বাজারে এসআইপি-র মাধ্যমে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিনিয়োগের ব্যবস্থা রয়েছে। পরিশেষে বলতেই হয়, আলস্য নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘যুক্তিপূর্ণ ভীতি’ বিনিয়োগকারীর কাছে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের অনীহার কারণ।
অনুপ কুমার সাহা, কল্যাণী, নদিয়া
চাই কাণ্ডজ্ঞান
তপেশের কাণ্ডজ্ঞানের উপর পিসিমার ভরসা নেই, কিন্তু মিউচুয়াল ফান্ড-এর চুক্তিপত্রের ‘ফাইন প্রিন্ট’ সম্বন্ধে কাণ্ডজ্ঞানের তেমন পরিচয় দেননি অমিতাভ গুপ্ত। পিসিমা কোন ভরসায় এসআইপি-র অঙ্ক কাটার ‘স্ট্যান্ডিং ইনস্ট্রাকশন’ দিয়ে দিলেন তাঁর ব্যাঙ্কারকে? নিবন্ধ পড়ে স্পষ্ট মালুম হচ্ছে, ব্যাঙ্ক-পোস্ট অফিসের কম সুদের হার, আর আটপৌরে ব্যবস্থা নিয়ে বিহেভিয়রাল ইকনমিক্সের কোনও ছাত্র ভালই শিকার পেয়েছে পিসিমাকে। পিসিমা সরল মনে বিশ্বাস করেছেন যে, এই বিনিয়োগে ঝুঁকি নেই বললেই চলে। যেটুকু আছে, তা সামলাবে মিউচুয়াল ফান্ডের কর্তারা আর তিনি শুয়েবসে ডিভিডেন্ড পেয়ে যাবেন। তিনি কি এক বারও খোঁজ নিয়েছেন, এখন বাজারে কে কেমন রিটার্ন দিচ্ছে? এই টাকা শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করে, সেখান থেকে লাভ করে তবেই ভাল ডিভিডেন্ড দেওয়া সম্ভব। বাজারে তো এমন সুসংবাদ নেই। বরং খারাপ খবর আছে। সংবাদপত্র পড়লে যে কেউ জানতে পারবেন, ব্যবসায়ীদের বিশাল ঋণ অনাদায়ি, তাঁরা নিজেদের কৌশলে দেউলিয়া ঘোষণা করছেন। দেউলিয়া বিধি প্রয়োগ করেও খেলাপি ঋণের সামান্য বকেয়া উদ্ধার করা যাচ্ছে। বাকিটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ক্ষতি, আমানতকারী গ্রাহকের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি। তাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আমানতে সুদের হার বাড়াতে পারছে না।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সুদের হার কম। কিন্তু কেন কম, তা বোঝানো হয়নি। খোলসা করে বলা হয়নি মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগের ঝুঁকির বিষয়। শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক ‘সেবি’ বিনিয়োগকারীকে ঝুঁকির কথা জানানো বাধ্যতামূলক করেছে। এত দিন তা সাধারণ ভাবে বোঝানো হত। এ বছর থেকে চালু হওয়া নিয়ম অনুসারে, প্রতি ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে বোঝাতে হবে। ভাবতে হবে, ‘সেবি’ কেন এই উদ্যোগ করল? বাজার নিশ্চয়ই খারাপ, ঝুঁকির ব্যাপার বেশ অস্পষ্ট। পিসিমা কি জানেন, তাঁর বিনিয়োগে ঝুঁকির মাত্রা কোন পর্যায়ে আছে— নিচু ঝুঁকি, নিচু থেকে মাঝারি, মাঝারি, মাঝারি থেকে উচ্চ, উচ্চ, না কি অতি উচ্চ? পিসিমা বলতেই পারেন, এই অঙ্ক কষার জন্য মিউচুয়াল ফান্ডের মাইনে-করা বিশারদ আছেন। তা হলে প্রশ্ন, সেবি বা রাষ্ট্রের তরফে ঝুঁকি বোঝাতে ‘রিস্ক-ও-মিটার’ চালু করতে হল কেন? নিবন্ধে এই সতর্কীকরণের ব্যাপার আশা করেছিলাম।
আধুনিক প্যাকেজিং-এ পণ্যের তথ্য সম্বন্ধে বিস্তারিত লেখা থাকে। তাদের ওয়েবসাইটে অন্য গ্রাহকদের ‘রিভিউ’ পর্যালোচনা করা যায়। মিউচুয়াল ফান্ডের ব্যাপারেও ঝুঁকির তথ্য প্রদানে স্বচ্ছ হতে হবে। তপেশ বা তার পিসিমাকে বিনিয়োগের আগে এই সতর্কবার্তাগুলি যাচাই করতে হবে, যেমনটা জিনিস কিনতে গিয়ে করতে হয়। এই বাজারে দেখা যাচ্ছে, ধনকুবেরদের সম্পদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বটে, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে, মধ্যবিত্তের সংখ্যা কমে নিম্ন-মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। পিসিমা বা তপেশ এই বাজারে ধনকুবের হবেন, সে আশা কোথায়? তা ছাড়া কুবেরের কাছে ধন ক্রমাগত জমা হয়ে যদি বিনিয়োগ না হয়, তবে ধনকুবেরেরও ভবিষ্যৎ নেই। শিবুদা এমন অনেক কিছু লুকিয়ে গিয়েছেন।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি