পথের সঙ্গী: সিউড়ি-বোলপুর রাস্তায় সাইকেলে যাত্রা। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
এএকটি চিঠি থেকে জানা গিয়েছিল চুরি গিয়েছে সাইকেল। কিন্তু মর্মস্পর্শী সেই চিঠি পড়ে কেউই আর ‘চোর’কে দোষারোপ করতে পারেননি।
রাজস্থানে কাজ করতে যাওয়া এক শ্রমিক একটি বাড়ির সামনে থেকে নিয়ে নিয়েছিলেন সেই সাইকেলটি। সেই কাজের জন্য ক্ষমা চেয়ে তিনিই রেখে গিয়েছিলেন সেই চিঠিটি। তাতে তিনি লিখেছিলেন, বাধ্য হয়েই তিনি এই কাজ করছেন। তাঁর প্রতিবন্ধী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে উত্তরপ্রদেশের গ্রামে নিজের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার আর কোনও উপায় তিনি পাননি। তাই গর্হিত কাজ জেনেও নিয়ে গিয়েছেন সাইকেলটি।
লকডাউন চলাকালীন সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই চিঠি এবং সাইকেল চুরির খবর। কেবল ওই শ্রমিকের খবরই নয়, লকডাউন চলাকালীন ঘরে ফিরতে মরিয়া শ্রমিকদের অনেকেরই ভরসা হয়েছে সাইকেল। দু’চাকার বাহন আর মনের, শরীরের জোরকে সম্বল করে দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে গিয়েছেন অজস্র মানুষ। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বীরভূমের বাসিন্দাও। আশপাশের রাজ্য বিহার, ঝাড়খণ্ড থেকে একাধিক শ্রমিক সাইকেলে ফিরেছেন নিজের জেলায়। অনেকে যেটুকু সম্বল ছিল, তা বেচে সাইকেল কিনে পাড়ি দিয়েছেন একশো কিলোমিটারেরও বেশি পথ।
নিজের গাঁ-গঞ্জ থেকে অন্য রাজ্যে, জেলায় কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের এ ভাবে ফেরার ছবি আমরা সকলেই দেখেছি। তাঁরা বাড়ি ফেরার আর কোনও উপায় যখন পাননি, তখন সাইকেলটুকুই তাঁদের ভরসা হয়ে উঠেছিল। কেবল বাড়ি ফিরতে চাওয়া শ্রমিকেরাই নন, লকডাউন চলার সময় যখন গণপরিবহণের চলাচল বন্ধ ছিল, তখন জরুরি পরিষেবায় কাজ করা অনেক কর্মী কাজে গিয়েছেন সাইকেলে চড়েই। কারণ সবার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করা কখনওই সম্ভব নয়। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন নিরাপত্তারক্ষী, এটিএমের কর্মী, সাফাইকর্মী, তেমনই রয়েছেন স্বাস্থ্য-পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত অজস্র মানুষ, যেমন হাসপাতালের কর্মী, ওষুধ দোকানের কর্মীরা। তাই বলা যায়, যে পরিকাঠামো নিয়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি, সেই পরিকাঠামোর একটা অঙ্গ ছিল সাইকেল।
শহরে তেমন না হলেও, সাইকেল দৈনন্দিন জীবনযাপনে গ্রাম-মফস্সলে ভরসা বহু দিনই। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের পড়তে যাওয়া থেকে শুরু করে, ক্ষুদ্র চাষি বা ব্যবসায়ীর নিজের রোজগারের কাজে যাওয়া— সব ক্ষেত্রেই সাইকেলের গুরুত্ব অপরিসীম। তা খেয়াল করেই সরকারি প্রকল্পেও পড়ুয়াদের সাইকেল দেওয়া হয়। তবে করোনা-ভাইরাস উদ্ভুত পরিস্থিতি আমাদের সাইকেলের সেই গুরুত্ব আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আজ, ৩ জুন, বিশ্ব বাইসাইকেল দিবসে আমাদের সেই গুরুত্বের কথাই স্মরণ করে নেওয়া দরকার। তা দরকার দুনিয়ার বদলে যাওয়া বাস্তবতার দিকে খেয়াল রেখেই।
দেশজুড়ে এখন ধীরে ধীরে লকডাউন তোলার কথা ভাবা হচ্ছে। সেই মতো পদক্ষেপ করছে রাজ্য, কেন্দ্র দুই সরকারই। ধীরে ধীরে খোলা হচ্ছে অফিস-কাছারি। ভিড় বাড়ছে রাস্তায়। করোনাভাইরাসের কোনও প্রতিষেধক অবশ্য এখনও বেরোয়নি। অথচ অনন্তকাল এই বন্দিদশা চলতেও পারে না অর্থনীতির স্বার্থেই। রোজকার কাজে রাস্তায় বেরোলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বারবার বলা হচ্ছে সরকারের তরফে। বলছেন চিকিৎসকেরাও। কিন্তু গণপরিবহণ যেখানে প্রয়োজনের তুলনায় এমনিতেই অপ্রতুল সেখানে এই দূরত্ব বজায় রাখা আদৌ সম্ভব কি না সেই প্রশ্ন উঠছে। আর অফিস খুললেও গণপরিবহণ স্বাভাবিক হয়নি এখনও। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কীভাবে বাইরে যাতায়াত করা সম্ভব তা নিয়ে উদ্বেগ একটা আছেই।
এই পরিস্থিতিতেই সাইকেলের গুরুত্ব অনুভূত হচ্ছে বারবার। অল্প দূরত্ব, যা এমনিতে কেউ বাসে বা অন্য কোনও ভাবে গেলেও সাইকেলে তা একটু সময় নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেই সব ক্ষেত্রে মুশকিল আসান হয়ে উঠতে পারে সাইকেল। একা যাওয়া যায় বলে এখানে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা সহজ। আর সাইকেল চালালে উপরি পাওনা শরীরচর্চা হয়ে যাওয়া, সুস্থ থাকতে যার কথা বারবার বলছেন চিকিৎসকেরা।
কেবল স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখাই নয়, সাইকেলের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অত্যন্ত কম। তাই ব্যবহারকারীর আর্থিক সাশ্রয়ের পক্ষেও তা খুবই উপযোগী। ছোট ছোট দূরত্বে বাসে বা অন্য কোনও মাধ্যমে যেতে দৈনন্দিন যা খরচ হয়, রোজ সাইকেলে সেই দূরত্ব গেলে দীর্ঘমেয়াদে সঞ্চয় হবে প্রচুর।
সাইকেল আরও একটা বিষয়ের জন্য এই পরিস্থিতিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, তা হল পরিবেশ। লকডাউন চলাকালীন গাড়ি কম চলায় পরিবেশে দূষণের মাত্রা কমে অনেকটাই। তার সুফল আমরা অনুভব করেছি প্রত্যেকেই। বুঝতে পেরেছি, হাওয়া-বাতাস হয়ে উঠেছে অনেক বেশি স্বচ্ছ। গাছে ফিরে এসেছে পাখিদের ঝাঁক। লকডাউন ওঠার পর সাইকেল ব্যবহার যদি কিছুটাও বাড়ে তা হলেও সেই পরিবেশ খানিকটা হলেও রক্ষা পাবে।
সাইকেলের এই প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছে গোটা বিশ্বই। আমেরিকা ও ইওরোপে লকডাউন চলাকালীনও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস হিসেবে খোলা ছিল সমস্ত সাইকেলের দোকান। গত বছরের মার্চে ইওরোপে সাইকেলের যা বিক্রি হয়েছিল, এ বছর তা বেড়েছে ৫০ শতাংশ। প্যারিস, নিউ ইয়র্কের মতো প্রথম বিশ্বের উন্নত শহরের সাইকেল চলাচলের রাস্তা বাড়ানো হচ্ছে।
আজ, বিশ্ব বাইসাইকেল দিবসে তাই নিজেদের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের স্বাস্থ্যের কথা ভেবেই সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানোর উপরে জোর দেওয়া উচিত। গ্রামবাংলায় সাইকেলের চল রয়েছে এমনিতেই। তা আরও বাড়ালে যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যায়, দূষণ কমানো যায়, তা হলে করোনা-পরবর্তী সুস্থ সমাজ গড়তে তা সহায়ক হবে অনেকটাই।