ডেনমার্কের ফারো দ্বীপের স্বশাসিত অঞ্চলের বাসিন্দারা গ্রীষ্মকালে উত্তর অতলান্তিক সাগরের তীরে ভাসিয়া আসা ‘পাইলট তিমি’ শিকার করিয়া তাহার মাংস ভক্ষণ করিয়া থাকেন। ইহা তাঁহাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। তাঁহারা এই আচারকে পুণ্যদায়ী জ্ঞানে পালন করেন। মানুষের বিশ্বাস বড় বিচিত্র। অনেক সময়েই নিছক যুক্তি দিয়া তাহার মোকাবিলা করা যায় না। ডেনমার্কের স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তারা সেই সত্যটি জানেন। তাঁহারা প্রথাটি বন্ধ করিবার কোনও নির্দেশ দেন নাই, স্থানীয় মানুষের ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনও কথা বলেন নাই। বরং উল্লেখ করিয়াছেন যে, ডেনমার্ক বা ব্রিটেনকে এখন যদি বলা হয় বেকন খাওয়া বন্ধ করিয়া দিতে, তাহা হইলে তাহাদের প্রাতরাশের তালিকা হইতে যেমন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বাদ পড়িবে, ফারো দ্বীপের বাসিন্দাদের এই মাংস খাইতে বারণ করাও তাহারই সমান। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্তারা একটি সহজ সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছেন: এ কালে পাইলট তিমির মাংস খাওয়া শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ, সমুদ্রের জলে দূষণ ভয়ানক ভাবে বাড়িয়াছে, তাহার প্রকোপ পড়িয়াছে সামুদ্রিক প্রাণীর উপরেও। তিমির মাংসে এখন নানা ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ জমা হইতেছে, যাহা মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক। এই অবস্থায় স্বাস্থ্য অধিকর্তা দ্বীপের বাসিন্দাদের পাইলট তিমি ভক্ষণের ঐতিহ্য বর্জন করিতে আর্জি জানাইয়াছেন— অন্য কোনও কারণে নহে, স্বাস্থ্যরক্ষার তাগিদে।
ইহাতে অবশ্য তর্ক মিটে নাই। ডেনমার্কের মৎস্য মন্ত্রকের কর্তারা বলিয়াছেন, সামুদ্রিক প্রাণী ও প্রাণিজ বস্তুই ফারো দ্বীপের বাসিন্দাদের জীবনযাপনের একটি মূল উপায়, তাহা বন্ধ করিলে দীর্ঘ কালের প্রথার অপমান হইবে। কিন্তু ঘটনা হইল, সামাজিকতার তাড়নায় মানুষ অনেক সময় এমন অনেক কাজ করে, যাহা তাহার পক্ষে ভাল নহে। মানুষ এমন করে, কারণ সে গতানুগতিক। সমাজ বহু কাল রীতি মানিয়া আসিতেছে, সেই রীতিকে উপেক্ষা করিবার সাহস বা মানসিকতা তাহার নাই। এমনকি আপন ভাল-মন্দের কথাও ভাবে না, ভাবিতে চাহে না, হয়তো ভাবিতে পারে না। দলছুট হইবার ভয় এমনই প্রবল যে, সুতরাং ঐতিহ্যের দোহাই দিয়া সে সমষ্টির সীমায় আপন আচরণকে সীমিত রাখে।
কিন্তু পৃথিবী পাল্টাইতেছে। প্রকৃতি পাল্টাইতেছে। এবং দ্রুত গতিতে পাল্টাইতেছে। এই পাল্টানোর দায় মানুষেরই। কারণ প্রকৃতির উপর যথেচ্ছাচার সে-ই করিয়াছে। প্রকৃতির যত ক্ষণ সেই অত্যাচার বরদাস্ত করিবার ক্ষমতা ছিল, করিয়াছে। এখন প্রকৃতি বিরূপ। বিপদসঙ্কেতগুলি প্রবল হইতে প্রবলতর। তবু মানুষ কখনও অগ্রগতির দোহাই দিয়া, কখনও ঐতিহ্যের ধুয়া তুলিয়া, কখনও বা নিছক সুবিধার অজুহাত খাড়া করিয়া প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করিয়া চলিতেছে। গড্ডলিকা প্রবাহের বাহিরে গিয়া সচেতন ব্যতিক্রম ঘটানো তাহার অভ্যাসে নাই। কিন্তু সেই চেতনা এখন বিশেষ আবশ্যক। মানুষের বোঝা দরকার যে, নিজেকে রক্ষা করিতে হইলে প্রকৃতিকে রক্ষা করিতে হইবে, প্রকৃতির যত্ন লইতে হইবে। সমুদ্র দূষিত করিয়া, সেই দূষিত সমুদ্রের বিষাক্ত তিমির মাংস খাইয়া ঐতিহ্যকে বাঁচাইতে চাহিলে মানুষ নিজেকে সুস্থ ভাবে বাঁচাইয়া রাখিতে পারিবে না।