পথপ্রদর্শক: অমর্ত্য সেনের সঙ্গে শান্তিনিকেতনে কৌশিক বসু।
লেখাপড়ার দুনিয়ায় এখন যাঁদের সঙ্গে দেখা হয় নিয়মিত, তাঁদের সঙ্গে আমার একটা মস্ত ফারাক আছে— আমি ছোটবেলায় লেখাপড়ায় একেবারেই ভাল ছিলাম না। ক্লাসের মাঝারি সারির ছাত্র, বড় জোর। ক্লাস এইটে পড়ার সময় এক বার ফোর্থ হলাম— বাবা, কেশবচন্দ্র বসু, বেজায় খুশি। স্কুলজীবনে সেটাই আমার সেরা রেজ়াল্ট! একটাই জিনিসে ঝোঁক ছিল। রিজ়নিং। যুক্তি। এখন মনে হয়, যুক্তির প্রতি সেই টান তৈরি হয়েছিল বাবার থেকে।
বাবা ভয়ানক ব্যস্ত। রাতে খাবার টেবিলে যেটুকু কথা হত, তাতে দুটো দিক চোখে পড়ার মতো ছিল— এক, তাঁর রসবোধ; দুই, তাঁর যুক্তি ব্যবহার করার ক্ষমতা। তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। স্কুলে জ্যামিতির প্রথম পরীক্ষাতেই ফেল করলাম। বাবা তখন বিধানসভায় স্পিকার। রাতে বাড়ি ফিরে রেজ়াল্ট দেখে বললেন, জ্যামিতিতে ফেল করলি! জ্যামিতি তো শুধু যুক্তি দিয়েই পারা যায়। এক মাস মতো আমায় জ্যামিতি পড়ালেন বাবা। তখন লেখাপড়ার সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্কই ছিল না। সন্ধেবেলা বই নিয়ে যেতাম। নিজে আগে দেখে নিতেন একটু। তার পর একেবারে এঁকে-টেঁকে স্বতঃসিদ্ধ থেকে উপপাদ্য কী ভাবে আসে, বুঝিয়ে তৈরি করে দিলেন আমায়। তার পর থেকে জ্যামিতিই একমাত্র বিষয় হল, যাতে আমি সাধারণত ক্লাসে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেতাম। বাবার থেকে আর একটা জিনিস পেয়েছি আমি— সংশয়বাদ। প্রতি মঙ্গলবার কালী মন্দিরে যেতেন তিনি। মাঝে মাঝে বলতেন, কিছুই বিশ্বাস করি না, কিন্তু রিস্ক নিতে ইচ্ছে করে না! পরে দেখেছি, ব্লেইজ় পাস্কাল প্রায় একই কথা বলেছিলেন।
আমি ঘোর সংশয়বাদী। কোনও কিছুই নিশ্চিত, সেটা বিশ্বাস করতে পারি না। এখানে এক জনের কথা না বললেই নয়। আমারই বয়সি একটি ছেলে, পার্থ— স্কুলের শেষ দিকে আলাপ। সে আমায় বলল, তুই বার্ট্রান্ড রাসেল পড়। সেই বয়সে রাসেলের লেখা আমায় সম্পূর্ণ নতুন করে গড়ে দিয়েছিল। রাসেলের কাছ থেকে শিখলাম, সব কিছুকেই প্রশ্ন করা যায়, করা উচিত। প্রশ্নের অতীত কিচ্ছু নয়। সে সব পড়ে স্কুলে— সেন্ট জ়েভিয়ার্সে— মর্যাল সায়েন্স ক্লাসে একটা রচনায় বিয়ে নামক প্রতিষ্ঠানের তুমুল সমালোচনা করলাম। শিক্ষক আমায় প্রিন্সিপালের অফিসে নিয়ে গেলেন, খুব করে বোঝালেন আমার ভাবনাচিন্তায় দোষ আছে!
অমর্ত্যদা
দিল্লিতে পড়তে গেলাম। খুবই আনন্দ করে পড়লাম, মানে কিছুই পড়লাম না। সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করলাম। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় তখন কলকাতার মতো ছিল না, সেখানে অনেকেই ফার্স্ট ডিভিশন পেত। আমি পেলাম না। ক্লাসে সবচেয়ে ঝকঝকে ছেলেটি ছিল নিলয় দত্ত। অসমের ছেলে। সে পড়তে পড়তেই নকশাল হয়ে গেল। আমাদের সময় সেন্ট স্টিফেন্স থেকে ১৬-১৭ জন আন্ডারগ্রাউন্ডে গেল। চার দিকের অসাম্য নিয়ে তাদের যে রাগ, ধৈর্যহীনতা, সেটার প্রতি আমার সহানুভূতি ছিল। কিন্তু, ওদের বিশ্বাস ছিল ভারতে বিপ্লব এসে গিয়েছে, লং মার্চ হবে, তার পরই সব বদলে যাবে— আমি মনে করতাম, এই ভাবনাটা ভুল। ফলে, সেই রাজনীতিতে যাওয়ার কথা কখনও ভাবিনি। তবে, তাঁরা যে রকম পৃথিবী গড়তে চান, সেই পৃথিবীটার কিছু আকর্ষণ আছে ঠিকই। সে রকম পৃথিবী দেখার স্বপ্ন আমারও আছে। কিন্তু, এ কথাটাও আমি মনে রাখি যে তেমন একটা স্বপ্নকে ধাওয়া করেই মানুষ উত্তর কোরিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়নের মতো ভয়ঙ্কর সমাজ তৈরি করেছিল। বহু ধনতান্ত্রিক সমাজে যতখানি অসাম্য আছে, ওই একনায়কতন্ত্রগুলোয় অসাম্যের মাত্রা তার চেয়ে বেশি। আরও বেশি সাম্যের দুনিয়া তৈরির স্বপ্ন বেঁচে থাকুক, কিন্তু সেই দুনিয়ায় পৌঁছনোর প্ল্যান, ব্লু-প্রিন্টও তৈরি হোক। সেটা এখনও হয়নি।
১৯৭২ সালে লন্ডনে গিয়েছিলাম দু’বছর লন্ডন স্কুলে মাস্টার্স করে লিঙ্কনস ইন্-এ ব্যারিস্টারি পড়ব বলে। দু’বছর অমর্ত্যদার ক্লাস করে সিদ্ধান্ত করলাম, অর্থনীতি পড়ব। বাবা-মা মনে খানিক আঘাত পেয়েছিলেন নিশ্চয়। কিন্তু বাবা বলেছিলেন, হয়তো ঠিকই করলি। ল’ইয়ার হয়ে গোটা জীবন কুড়িটা মক্কেলের জন্য কাজ করবি। লেখাপড়ার জগতে থাকলে তোর কাজের জন্য গোটা দুনিয়া খুলে যেতে পারে। অমর্ত্যদা তখন যে অর্থনীতির চর্চা করতেন, আমায় ঠিক সেটাই টানে— লজিক, ইকনমিক থিয়োরি। দর্শনের সঙ্গে মিলিয়ে পড়াতেন অমর্ত্যদা। জমজমাট ক্লাস। তাঁর সেই সময়কার কিছু লেকচার এখনও মনে আছে। পরীক্ষায় বেশ ভাল রেজ়াল্ট করলাম— ১২০ জনের ক্লাসে প্রথম তিন জনের মধ্যে ছিলাম। জীবনে কখনও এত ভাল রেজ়াল্ট করিনি। ঠিক করলাম, অমর্ত্যদা যদি গাইড হতে রাজি হন, তবেই পিএইচ ডি করব। নিমরাজি হলেন তিনি। আমিও কাজ আরম্ভ করলাম তাঁর কাছে।
হিউম, সংশয়বাদ, মার্ক্স
আমি এখনও যে খুব বেশি পড়ি, তা নয়। তবে, দর্শনের বই পড়ি। যে দার্শনিকের সঙ্গে আমি নিজের মতের সবচেয়ে বেশি মিল খুঁজে পাই, তিনি ডেভিড হিউম। রাসেল নন, রুসো নন, অ্যাডাম স্মিথ নন— হিউম। চিন্তার ক্ষেত্রে হিউমের সঙ্গে যে মিলগুলো পাই— বলব না যে হিউম পড়ে আমার চিন্তাগুলো সে দিকে গিয়েছে— কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি, আমার ভাবনা যেখানে গেল, হিউমও ঠিক সেটাই বলছেন। আমার বহু লেখাতেও হিউমের কথা আসে এখন। হিউমের সংশয়বাদ আমায় আকৃষ্ট করে। ঈশ্বরের প্রসঙ্গেই যেমন। তিনি নাস্তিক বটে, কিন্তু নরম গোছের নাস্তিক। বলছেন, দুনিয়ায় রহস্য অপার, নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল। তবে, প্রথাগত ধারণা যাকে ঈশ্বর বলে চেনে, সে রকম কিছু নেই। সে রকম পরম দয়াবান, পরম শক্তিমান কোনও অস্তিত্বের উপস্থিতির সঙ্গে এই দুনিয়ার মিল নেই— সে রকম কেউ থাকলে দুনিয়ায় এত দুঃখ-কষ্ট থাকত না। আমি নিজেও এই কথাটায় বিশ্বাস করি। আর একটা জায়গা হল কজ়ালিটি। কার্যকারণবাদ। এটা করলে ওটা হয়, এই ধারণা। লন্ডনে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন থেকেই আমার বিশ্বাস যে এ রকম কার্যকারণবাদ প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব। রোজ রাত পোহালে সূর্য ওঠে বলে কালকেও উঠবে, নিশ্চিত ভাবে সেটা প্রমাণ করা অসম্ভব। শেষ অবধি ওটা বিশ্বাসের প্রশ্ন। পরে দেখলাম, হিউমও ঠিক এ রকম কথাই বলেছেন। এখানে একটা কথা স্পষ্ট বলি— আমি এটা বলছি না যে দুনিয়ায় কজ়ালিটি নেই। বরং, আমি বিশ্বাস করি, পৃথিবীটা কার্যকারণবাদ দিয়েই চলে। কিন্তু, সেই সম্পর্কটা সম্পূর্ণ ভাবে আবিষ্কার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কজ়ালিটি আছে, এটা আমরা বিশ্বাস করে নিই, এই মাত্র।
আমার জীবনের একটা অংশ কেটেছে উন্নয়নের নীতি নির্ধারণের কাজে। কজ়ালিটিতে যদি বিশ্বাস না করি, নীতি নির্ধারণের কাজ করব কী ভাবে? আমি মনে করি, ইনটিউশন— বাংলায় যাকে বলে স্বজ্ঞা— তার একটা মস্ত ভূমিকা আছে। এই স্বজ্ঞা আমরা অর্জন করেছি বিবর্তন থেকে— প্রজন্মান্তরে অর্জিত অভিজ্ঞতায়। এখন র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোল ট্রায়ালের প্রচুর কাজ হচ্ছে। সে কাজটা এই গোত্রের— একের পর এক এক্সপেরিমেন্ট থেকে শিখতে শিখতে একটা ধারণা তৈরি করে নেওয়া যে এটা করলে ওটা ঘটতে পারে। ঘটবেই, সে নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু, ঘটবার সম্ভাবনা যথেষ্ট। বিজ্ঞানের পথে যতটা জানা যায়, তার সঙ্গে স্বজ্ঞা ব্যবহার করে এগোতে হবে।
অর্থনীতির দর্শনের ক্ষেত্রে স্ট্যানলি জেভনস, জন স্টুয়ার্ট মিল, অ্যাডাম স্মিথ— অনেকেরই প্রভাব পড়েছে আমার চিন্তায়। এক জনের অর্থনৈতিক চিন্তাকে আমি যথেষ্ট ঠিক বলে গ্রহণ করতে পারিনি, কিন্তু তাঁর দার্শনিক অবস্থানের প্রভাব অনস্বীকার্য— তিনি কার্ল মার্ক্স। ভবিষ্যৎ কোন পথে চলবে, মার্ক্স অতীতকে দেখে সে বিষয়ে নিশ্চিত হচ্ছেন। অথচ, এই দাবির পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ মার্ক্স কখনও দিতে পারেননি। পুঁজিবাদ চলবে এবং এক সময় তাকে ভেঙে ফেলে কমিউনিজ়ম আসবে, এই নিশ্চয়তার সঙ্গে একমত হতে পারা আমার পক্ষে অসম্ভব। যেটা আমাকে আকর্ষণ করে, সেটা হল তাঁর বক্তব্য— প্রত্যেকে নিজের ক্ষমতা অনুসারে দেবে, আর নিজের প্রয়োজন অনুসারে নেবে। অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ একটা কথা। এ রকম একটা পৃথিবীই তো চাই। কিন্তু সেখানে কী করে পৌঁছনো যায়, তার কোনও জানা পথ নেই। আমি মনে করি, তাঁর অর্থনীতির ভাবনায় গলদ রয়েছে। কিন্তু, তাঁর লক্ষ্যগুলো এতই মহান যে কী ভাবে তাতে পৌঁছনো যায়, সে পথ খোঁজা উচিত।
রবীন্দ্রনাথ, গাঁধী, নেহরু
ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র পড়ে বড় হয়েছি, পড়তে ভীষণ ভাল লাগত। এবং রবীন্দ্রনাথ লেখক ও শিল্পী হিসেবে কতটা বড়, সেটা অনুভব করতে পারতাম। সাহিত্য পড়তে ভাল লাগত। কিন্তু, জীবনদর্শন হিসেবে যেটা মূলত টানল, সেটা হল তাঁর আন্তর্জাতিকতাবাদ। ধর্ম, জাতিগত পরিচয়, দেশের গণ্ডি— সব কিছু পেরিয়েও যে একটা বৃহত্তর মানবতা আছে, এই কথাটা আমায় গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছে। জাপানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের ওপর যে বক্তৃতাগুলি দেন, তা আমায় আশ্চর্য ভাবে ছোঁয়। কিংবা, গীতাঞ্জলি। জওহরলাল নেহরু ঠিক এখানে এসেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মিশে যান। মনে হয়, নেহরু বৌদ্ধিক দিক থেকে গাঁধীর চেয়ে রবীন্দ্রনাথেরই কাছাকাছি ছিলেন। তাঁর আন্তর্জাতিকতা আর মানবতাবোধের দিক দিয়ে। নেহরু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়মিত চিঠি লিখতেন। এক চিঠিতে লিখেছিলেন, দেশ গঠন করা জরুরি, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, আসলে সবটাই পুরো পৃথিবীর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য। খুব রাবীন্দ্রিক একটা অবস্থান। দেশ কী ভাবে তৈরি হবে, সেই চিন্তার মধ্যে এমন উদারতা, প্রসারতা আমায় মুগ্ধ করে। আজকের দিনে আমাদের দেশে যে নৈতিক অবনতি হয়েছে, তাতে এই কথাগুলো খুব বেশি করে মনে পড়ে।
সাক্ষাৎকার ও অনুলিখন: অমিতাভ গুপ্ত