শত বার দেখিতে হয় নাই। এক বারে না পারিলেও চৌদ্দ মাসের মধ্যে ষষ্ঠ চেষ্টায় কর্নাটকে কংগ্রেস-জনতা দল (সেকুলার) জোট সরকারকে ফেলিতে সক্ষম হইল বিজেপি। আস্থা ভোটের ফলাফল কী হইবে, সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না। অপেক্ষা ছিল শুধু এই কুনাট্যে কবে যবনিকা পড়িবে, তাহার। বিধায়ক কেনা-বেচার অভিযোগ, রিসর্ট রাজনীতি, মামলা, পাল্টা মামলার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করিয়া শেষ অবধি মঙ্গলবার আস্থা ভোটে হারিয়া গেল এইচ ডি কুমারস্বামীর নেতৃত্বাধীন সরকার। দুর্জনে বলিবে, এ হেন ঘটনাক্রমের পরিসমাপ্তিতে কর্নাটকের বিজেপি নেতা বি এস ইয়েদুরাপ্পার মন্তব্য ‘গণতন্ত্রের জয় হইল’ রসিকতার ন্যায় শুনাইতেছে। অমলিন রসিকতা নহে। এই জোট সরকার গঠনের সময়কার স্মৃতি এখনও সম্পূর্ণ মুছিয়া যায় নাই। যথেষ্ট বিধায়ক না থাকা সত্ত্বেও ইয়েদুরাপ্পার সরকার টিকাইয়া রাখিবার মরিয়া প্রচেষ্টা, এবং কংগ্রেস-জেডি(এস) বিধায়কদের ভিন্রাজ্যের রিসর্টে লুকাইয়া রাখিবার বাধ্যবাধকতাও গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ ছিল না। রাজ্যপাল বাজুভাই বালার ভূমিকা লইয়াও প্রশ্ন উঠিয়াছিল, যে প্রশ্ন প্রকৃত প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় সরকারের— কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন শাসক দলের প্রতি। অবশ্য, শুধু কর্নাটকই নহে, ২০১৬ সালের উত্তরাখণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ; ২০১৭-র গোয়া, মণিপুর, বিহার; ২০১৮ সালের মেঘালয়— প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাজ্যপালের বকলমে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়িয়াছিল। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত জনাদেশকে গ্রাহ্য না করিবার প্রবণতাটি এই আমলে বিপজ্জনক রকম বেশি, সন্দেহ নাই।
প্রশ্ন উঠিতেছে, অতঃপর কোন রাজ্য— রাজস্থান? মধ্যপ্রদেশ? এই রাজ্যগুলিতে কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নামমাত্র। জনাকয়েক বিধায়ক দল ছাড়িলেই সরকার পড়িয়া যাইতে পারে। অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, তাহাই অবশ্যম্ভাবী। আশঙ্কাটি তীব্রতর হইতেছে, কারণ গত তিন-চার বৎসরে বিজেপির অবস্থানে স্পষ্ট, জনাদেশের প্রতি তাহাদের আস্থা নাই। যে কোনও প্রকারে রাজ্যের দখল লওয়াই তাহাদের লক্ষ্য। এক দেশ, এক রাজনৈতিক দল! গোটা দেশে প্রশ্নাতীত আধিপত্য অর্জনের বাসনা কোনও রাজনৈতিক দলের থাকিতেই পারে। কিন্তু, সেই বাসনা চরিতার্থ করিতে ঘোড়া কেনাবেচার শর্টকাট পথ লইলে মুশকিল। তাহাতে গণতন্ত্রের আব্রু রক্ষা হয় না। দুর্জনে বলিবে, গণতন্ত্রের সম্মানরক্ষায় গেরুয়া শিবিরের তেমন আগ্রহ নাই— দখল লওয়াই উদ্দেশ্য। কাহারও কংগ্রেস আমলের কথাও মনে পড়িতে পারে, যখন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করিয়া নির্বাচিত সরকার ফেলিয়া দেওয়ার চল হইয়াছিল। সেই প্রবণতার ফল কংগ্রেসের পক্ষে শেষ পর্যন্ত ভাল হয় নাই, বিজেপি শুধু এইটুকু স্মরণে রাখিতে পারে।
তবে, গত কয়েক বৎসরে বিজেপি যে ভারতের রাজ্য রাজনীতির চরিত্র পাল্টাইয়া দিতে পারিয়াছে, তাহা সংশয়াতীত। কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলি এই বাস্তবকে স্বীকার করিয়া নিজেদের রণনীতি স্থির করিলেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিবে। রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প, ফলে নূতন পথ খুলিতে শেখা এই রণাঙ্গনে অস্তিত্বরক্ষার অন্যতম আয়ুধ। কী ভাবে জোট ধরিয়া রাখিতে হয়, তাহা শিখিতে হইবে। অনস্বীকার্য যে এই মুহূর্তে টাকার জোর বিজেপির তুল্য আর কোনও দলের নাই। কিন্তু, খেলাটি শুধুই টাকার, বলিলে তাহার জটিলতাকে লঘু করিয়া দেখা হয়। দলের অন্তর্দ্বন্দ্বও সামলাইতে শিখিতে হইবে। রাজস্থানে যেমন অশোক গহলৌত আর সচিন পাইলটের সংঘাত সরকারের অস্তিত্বকে বিপন্নতর করিতেছে। কী ভাবে এই অভ্যন্তরীণ সংঘাত সামলাইয়া ঘোড়া কেনাবেচার খেলায় নিজেদের সরকার বাঁচাইয়া রাখিতে হয়, বিরোধী দলগুলি না শিখিলে বিজেপির বিজয়রথের গতি অব্যাহত থাকারই সম্ভাবনা।