রাজদ্রোহী পলিনাইসিসের মৃতদেহ পড়ে আছে। সমাধিস্থ হবে না। রাজ্যের নিয়ম, বিদ্রোহীর মৃতদেহের প্রতি কোনও রকম করুণা বা সম্মান প্রদর্শন করা যাবে না। ছোট বোন ইসমেনে ভীত। বড় বোন আন্তিগোনে অশান্ত। তাঁর ঘুম নেই, স্বস্তি নেই। ভাইকে সে সমাধি দেবেই। শাসক ক্রেয়ন কেবল জানে রাষ্ট্র। আন্তিগোনে বোঝে পরিবার, তার ছোট ছোট মধুর সম্পর্ক। দুইয়ের বিরোধ বহু আলোচিত। দু’পক্ষেরই যুক্তি আছে, যুক্তির অভাবও আছে। গ্রিক নাট্যকার সোফোক্লিসের ‘আন্তিগোনে’র সেই চিরন্তন বিরোধকেই আধুনিক প্রেক্ষিতে, নতুন মোড়কে তুলে ধরেছেন ইংল্যান্ডবাসী পাকিস্তানি লেখিকা কামিলা শামসি (ছবিতে)।
তাঁর হোম ফায়ার উপন্যাস আসলে এমনই অনাথ তিন ব্রিটিশ-মুসলিম ভাইবোনের গল্প। বড় বোন ইসমা; ছোট ভাই পারভেজ় আর বোন আনিকা যমজ। পারভেজ় লন্ডন ছেড়ে এক দিন সিরিয়ায় চলে যায় ‘ইসলামিক স্টেট’ গঠনের খোয়াব নিয়ে। ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ সেই ভাইয়ের ব্যাপারে ইসমা সমঝোতার পথে হাঁটে। কিন্তু আনিকা ভাইকে আবার পরিবারে ফিরিয়ে আনতে চায়। আন্তিগোনের মতো আনিকাও ভাইয়ের জন্য যে কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত। এই ভাবে দুই কাহিনিতেই “এক সাহসী তরুণী প্রশাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। হ্যাঁ, সে কিছু করতে পারে না। কিন্তু নিষ্ঠুর শাসককে মানবতার পাঠ দিয়ে যায়।” আর সেই পাঠদানের স্বীকৃতি স্বরূপ কামিলা এই বছরের ‘উইমেনস প্রাইজ় ফর ফিকশন’ পেলেন। এই পুরস্কার ইংল্যান্ডের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার, যার জন্য মনোনীত হতে পারে বিশ্বের যে কোনও দেশের মহিলা ঔপন্যাসিক দ্বারা ইংরেজিতে লেখা ও ইংল্যান্ডে প্রকাশিত উপন্যাস। ‘রাষ্ট্রপতি পুরস্কার’-সহ আরও বেশ কিছু পুরস্কার কামিলা ইতিমধ্যেই পেয়ে গিয়েছেন।
পাকিস্তানে সাম্প্রতিক কালের মহিলা ঔপন্যাসিকদের যদি প্রথম পাঁচ জনের নাম করতে হয় তবে মোনি মহসিন, ফাতিমা ভুট্টো, শাকিলা আবদুল্লাহ, ওয়াপসি সিধোয়াদের সঙ্গে কামিলার নামও উঠে আসবে অনায়াসে। এঁরা অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও মেয়েদের লেখাকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। কামিলার পুরস্কার সেই সাফল্যের মুকুটে এক নতুন পালক।
কামিলার জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের করাচিতে, ১৯৭৩ সালে। সেখানেই গ্রামার স্কুলে পড়েন তিনি। বড় হয়ে আমেরিকায় যান পড়াশোনা করতে। এখন থাকেন ইংল্যান্ডে। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী, সাহিত্য সমালোচক, ইতিহাসবিদ। তাঁর প্রভাব কামিলার চরিত্রে যথেষ্ট। হোম ফায়ার কামিলার সপ্তম উপন্যাস, যা আসলে ৯/১১-র পর পশ্চিমি পটভূমিতে মানুষের ‘আত্মপরিচয়, আনুগত্যের দ্বন্দ্ব, ভালবাসা ও রাজনীতি’র নতুন ভাষাকে ঠিক ভাবে পড়তে এবং ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই কামিলা তাঁর প্রথম উপন্যাস ইন দ্য সিটি বাই দ্য সান লিখে যথেষ্ট সাফল্য পান। তাঁর সল্ট অ্যান্ড স্যাফ্রন, বার্ন্ট শ্যাডোজ়, আ গড ইন এভরি স্টোন ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় রচনা।
বিষয়ের দিক থেকে হোম ফায়ার রীতিমতো ব্যতিক্রমী। কাশ্মীরি কবি আগা শাহিদ আলির কাব্যরসে আপ্লুত কামিলা আসলে তাঁর রচনায় সামনে আনতে চেয়েছেন কখনও উত্তর দিতে না পারা সেই প্রশ্নকে: যখন তোমার আত্মপরিচয় চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন তোমাকে সমষ্টি ও ব্যক্তির মধ্যে থেকে এক জনকে বেছে নিতে হবে। তুমি কাকে বাছবে?
শাসক ক্রেয়নের আধুনিক রূপ হিসেবে তাঁর উপন্যাসে কামিলা এনেছেন ব্রিটিশ মুসলিম হোম সেক্রেটারিকে। যে চরিত্র সহজেই মনে করিয়ে দেবে বাস্তবের টেরেসা মে’কে, যিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ওই একই পদে ছিলেন এবং কয়েক দিন আগেই বলেছেন, “দ্বৈত নাগরিকত্ব যাঁদের আছে, তাঁদের কাছ থেকে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়া উচিত।” কামিলা নিজে একই সঙ্গে ব্রিটেন এবং পাকিস্তানের নাগরিক বলে এই বিদ্বেষের ব্যাপারটি বোঝেন। তাই স্পষ্টই বলেছেন, “এই নাগরিকত্ব নিয়ে কী চলছে, আমি ভালই বুঝি। এ-ও জানি, খুব সহজেই আমাকে ফাঁদে ফেলা যায়।”
সামরিক একনায়কতন্ত্রের মধ্যে বড় হওয়া কামিলা শামসি দেখেছেন কেমন করে চরমপন্থা আমাদের ‘মাথার মধ্যে ঢুকে যায়’। তিনি যথার্থই বলেছেন, “আমার মনে হয়, আমরা খুব ভয়ঙ্কর এক সময়ে বাস করছি। আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পথের দিকে নজর রাখতে হবে এবং আশান্বিত হওয়ার কারণ খুঁজে বার করতে হবে।” হোম ফায়ার কামিলার সেই খোঁজ। এক দিকে পশ্চিমের দেশগুলির তীব্র বিদ্বেষ, অন্য দিকে ব্রিটিশ পরিবারে জন্ম নেওয়া ‘আই এস’ হত্যাকারী ‘জিহাদি জন’-এর নাম সমস্ত মিডিয়ায়।
আন্তিগোনে ক্রেয়নকে বলেছিল, “নিহত মানুষটা কোনও খলনায়ক নয়, সে এক জন ভাই।” আজও কাশ্মীরে, সিরিয়ায়, প্যালেস্তাইনে, আমেরিকার স্কুলগুলিতে, আফগানিস্তানে যারা মৃত্যুকে মাটির বুকে নামিয়ে আনার ‘দায়িত্ব’ নিয়ে চলেছে, তারাও কারও না কারও ছেলে অথবা ভাই। ক্রেয়ন শাসক, তাকে ‘রাষ্ট্র’ রক্ষা করতে হয়। সেই রাষ্ট্রের আইন যারা ভাঙে, তারা শাসকের কাছে স্বাভাবিক ভাবেই ‘ডাকাতের দল’। আন্তিগোনে প্রশ্ন তোলে, যে ঐশ্বরিক জগতে দেশপ্রেম এবং মূল্যবোধের মূল্য আছে, “কে বলতে পারে এই পৃথিবীতে যা অপরাধ, সেখানে তা গুণ নয়?” যে বিশ্ব ভাইয়ের হাতে হননাস্ত্র তুলে দেয় অথবা তাকে হত্যা করে, সেখানে এই তর্ক তো চলতেই থাকবে। আবার রাষ্ট্রকেও চলতে হবে তার নিয়ম মেনে। হোম ফায়ার সেই ভাই, সেই সন্ত্রাসীকে সহোদরা ও শাসকের নিরিখে দেখতে চেয়েছে।
‘বিবিসি রেডিয়ো ফর টু ডে’র সম্পাদক সারা স্যান্ডস তাই বলেছেন, “একটি রাজনৈতিক কাহিনিকে এই ভাবে মানবিক করে তুলে এই উপন্যাস দেখিয়েছে, সত্যিই সাহিত্য কী করতে পারে।” কামিলা শামসিকে অভিনন্দন। তাঁর আনিকা আন্তিগোনের প্রশ্নটিকে আজকের ভাষায় পেশ করতে পেরেছে।