পঞ্চায়েত এবং দুর্নীতি যেন একে অপরের পরিপূরক। প্রস্ফুটিত পুষ্প যেমন মধুলোভী পতঙ্গকে আকৃষ্ট করে, পঞ্চায়েতও কার্যত তেমন করিয়া দুর্নীতির জন্য আপন দুয়ার খুলিয়া দেয়। অন্তত বঙ্গভূমে ইহা অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য। বামপন্থী শাসকেরা ইহার বীজ রোপণ করিয়া চৌত্রিশ বছর যাবৎ তাহাকে পরিপুষ্ট করিয়াছিলেন। অঙ্কুর হইতে বৃক্ষ পর্যন্ত তাঁহাদেরই দান। দশক কাল হইল তৃণমূল রাজ্যপাটে বসিয়া সেই সকল বৃক্ষকে আরও পল্লবিত করিয়া তুলিয়াছে। সময়ের দাবিতে বদলও ঘটিয়াছে দুর্নীতির আঙ্গিক এবং প্রকরণে। স্থানীয় নেতাদের উদ্ধত দুরাচার দেখিলে মনে হয়, এই সব অপকর্মে রাশ টানিতে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলীয় নেতৃত্ব উভয়েরই শিথিলতা রহিয়াছে। হয় তাঁহারা সত্যই অপারগ, নতুবা কোথাও প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ের ফাঁক গলিয়া দুষ্কর্মকারীরা নিজেদের আধিপত্য কায়েম করিতেছে। প্রকৃত কারণ যাহাই হউক, পরিণাম একই এবং ভুক্তভোগী নিচুতলার সাধারণ মানুষ। নিষ্ফল মাথা কুটিয়া তাঁহাদের দিন যায়! আমপানের ক্ষতিপূরণ কেন্দ্র করিয়া বঞ্চনার গুচ্ছ গুচ্ছ অভিযোগ যে ভাবে প্রকাশ্যে আসিয়াছে, তাহাতে বিষয়টি আরও এক বার প্রকট হইল। ইহাও ইতিমধ্যে চর্চিত যে, দুর্যোগ-বিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে পঞ্চায়েত কর্তারা অনেকেই ক্ষতিপূরণের টাকা নিজেদের পকেটে ভরিয়াছেন, তাঁহাদের স্বজন-বান্ধবদের নামে বরাদ্দ করিয়া দিয়াছেন। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের ভাগ্যে কানাকড়িও জুটে নাই। লক্ষণীয় হইল, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগের সারবত্তা মানিয়া লইয়াছেন এবং ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণের ‘মামেকং শরণং ব্রজ’ উপদেশের ন্যায় আমপান-দুর্গতদের আশ্বস্ত করিয়া তাঁহার উপর আস্থা রাখিতে বলিয়াছেন।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিজ্ঞ রাজনীতিক। দলধর্ম হইতে রাজধর্মকে কখন পৃথক করিয়া দেখাইতে হয়, তিনি তাহা জানেন। খবরে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই বেশ কয়েক জন পঞ্চায়েত-পদাধিকারীকে তৃণমূল শো-কজ় করিয়াছে। প্রশ্ন হইল, ইহাই কি যথেষ্ট? আরও গুরুতর প্রশ্ন হইল, নিজ দলের পঞ্চায়েত নেতাদের এই দুর্মতি কি দলের সর্বাধিনায়িকার অজানা ছিল? যুক্তি বলিবে, না। কারণ গত লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপির নির্বাচনী সাফল্যের ময়নাতদন্ত করিতে বসিয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়াছিলেন, পঞ্চায়েত ও পুরসভায় বড় সংখ্যক জনপ্রতিনিধির দুর্নীতির শিকড় কত গভীরে গিয়াছে। জনগণের নিকট হইতে কাজের বিনিময়ে ‘কাটমানি’ আদায়ের সত্য উন্মোচিত হইবার পরে তিনি তখন টাকা ফেরতের অভিযানও চালু করিয়াছিলেন। তাহার পরেও পঞ্চায়েতে অধিষ্ঠিত শাসককুলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ অসততার ‘স্বধর্ম’ হইতে বিচ্যুত হন নাই।
বিষয়টি উদ্বেগজনক। শাসকের বেশে শোষকেরা যদি অবাধ বিচরণের পরিসর পায়, গণতন্ত্র পরাভূত হইতে বাধ্য। দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ স্তরীয় নেতারা ও জনপ্রতিনিধিরা যখন অন্যায়ে এই ভাবে লিপ্ত হন, তাঁহাদের আইনানুগ শাস্তিদানে কোনওরূপ দোলাচল বা বিলম্ব ঘটিলে তাহা কিন্তু শাসকবর্গের অক্ষমতা, দুর্বলতা বা প্রশ্রয়ের মতো বিবিধ সন্দেহের পথ প্রশস্ত করিয়া দেয়। অতীতে কাটমানি ফেরতের সময়ও অভিযুক্তদের জন্য কেবল দলীয় ভর্ৎসনাকেই সমাধান সাব্যস্ত হইয়াছিল। এ বার আমপানের ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রেও কি তাহারই পুনরাবৃত্তি দেখিতে হইবে? অপরাধ নির্দিষ্ট হওয়ার পরেও অভিযুক্ত কোনও জনপ্রতিনিধিকে এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয় নাই। শুধু টাকা ফিরাইয়া দায় সারিলেই পাপক্ষালন হয় না। ইহা কোনও এক বার টাকার নয়ছয় নহে, ইহা এক পরিব্যাপ্ত বিষাক্ত দুর্নীতির পরিবেশ, যাহা মানুষের নাভিশ্বাস উঠাইতেছে। আজিকার এই বিক্ষোভ কেবল গত কয়েক মাসের প্রতিফলন নহে— অনেক দিনের জমা ক্ষোভের বিস্ফোরণ। রাজ্য প্রশাসককে কথাটি মনে রাখিতে হইবে।