অল্পবয়সি একটি মেয়ের আত্মহত্যা সম্প্রতি আমাদের সবাইকে, স্তম্ভিত করেছে। শেষ কবে আমাদের খবরের কাগজ, টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও আত্মহত্যা নিয়ে দিনের পর দিন খবর হয়েছে, এত তোলপাড় হয়েছে, তা মনে পড়ছে না। সংবাদমাধ্যমের নিশ্চয়ই মনে হয়েছে এ ঘটনা এতটাই ‘সংবাদযোগ্য’, নইলে এ যুগে যখন আমাদের মনোযোগের সীমা কমতে কমতে সেকেন্ড পনেরোয় এসে ঠেকেছে, তখন তিন-চার দিন বা তারও বেশি সময় ধরে এই আত্মহত্যার খবর গুরুত্ব পাবে কেন?
মেয়েটিকে যে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে খুঁজে পাওয়া যায়, তার অনুপুঙ্খ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল সংবাদপত্র ও টিভিতে। এই ধরনের সংবাদ পরিবেশন গোপনীয়তাকে মর্যাদা দেওয়ার সমস্ত নিয়ম লঙ্ঘন করেছে; একটি আত্মহত্যার ঘটনাকে যে ভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া উচিত, ভেঙেছে সেই নিয়মও। মেয়েটি একটি দীর্ঘ লেখা লিখে রেখে গিয়েছিল, সেখানে ওর মনের উদ্বেগ আর যন্ত্রণার কথা লেখা ছিল। সংবাদমাধ্যমকে এই লেখাটা নিশ্চয়ই পুলিশই দিয়ে থাকবে। এটাও সংবেদনশীলতার নয়, সংবেদনহীনতার নমুনা। সংবাদমাধ্যম একেবারে প্রথম পাতায় সেই লেখার খুঁটিনাটি ছাপিয়ে দিল! মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে যে কিনা এখন মৃত, আমাদের সমাজে তার আর গুরুত্ব কিসের? তাই তার মনের একেবারে ভিতরের, একদম ব্যক্তিগত ভাবনাগুলোও অন্যের জীবনে গোপনে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতে ভালবাসা এই সমাজের সামনে হাট করে দিলে ক্ষতি কী! খবরের কাগজগুলো মেয়েটির চিঠির প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের মতামত চাইল, তাঁরাও নানান মন্তব্য করে ধন্য করলেন ও হলেন। নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখতে পাওয়ার প্রলোভন আর কে রুখতে পারে! বিশেষজ্ঞরা এ ভাবেই নৈতিক সীমা লঙ্ঘন করলেন, যে মানুষটাকে কোনও দিন দেখেনইনি, তাঁর রোগ ধরতে নেমে পড়লেন।
মেয়েটিকে তো বাঁচিয়ে রাখতে পারলামই না, আর মৃত্যুর পরেও আমরা প্রত্যেকে ছিনিমিনি খেললাম তার ও তার মা-বাবার সমস্ত অধিকার নিয়ে— যাঁদের কষ্ট ও যন্ত্রণার কথা আমরা কল্পনাও করতে পারব না।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সম্পর্কে যেটা বলার মতো বিষয় তা হল, আত্মহত্যার রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে প্রাথমিক নীতি ও নিয়মকানুনগুলো মেনে চলার কোনও ধারণাই তাদের নেই। অথচ এই নিয়মনীতিগুলো কিন্তু অপরিচিত নয়। আত্মহত্যার রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে গোড়ার নীতিই হল:
১) আত্মহত্যার প্রকরণ (মেথডলজি) বিষয়ে খুঁটিনাটি তথ্য না দেওয়া। এই নীতি স্পষ্টতই লঙ্ঘিত হয়েছে। কী ভাবে কেউ আত্মহত্যা করেছে তার বিশদ ও খুল্লমখুল্লা বিবরণ একই রকম আচরণ (ইমিটেশনাল বিহেভিয়র) উস্কে দিয়েছে সেই পাঠক বা দর্শকের মধ্যে, যাঁর মধ্যেও হয়তো আত্মহননের বা নিজের ক্ষতি করার স্পৃহা লুকিয়ে আছে— এমন উদাহরণ বা প্রমাণও আছে। এ এক ধরনের ছোঁয়াচে প্রবণতা।
২) আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটেছে একটি একক ঘটনার সূত্রেই, খবরে এমনটা না বলা। আত্মহত্যা একটি জটিল ঘটনা, এবং প্রায়ই তা মানসিক অসুস্থতা-সহ অন্য বহু কারণের ফলাফল।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনও আত্মহত্যার ঘটনার ক্ষেত্রে একটা সোজাসাপ্টা, একরৈখিক কারণ জানাতে অনিচ্ছুক হলে সাংবাদিকরা বেশ হতাশ হন। জীবনের মতোই আত্মহত্যাও খুব জটিল একটা ঘটনা; গবেষণা বলছে, স্রেফ কোনও একটা কারণে কেউ আত্মহত্যা করেন না, করেন অনেকগুলো উপাদান বা কারণের সম্মিলিত যোগফল হিসেবে। একটাই ঘটনাকে কারণ হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে পরিবেশন করা খবর আসলে আত্মহত্যার অতিসরলীকৃত ও বিভ্রান্তিকর বয়ান।
তা হলে আত্মহত্যার খবর লিখতে গেলে ভাষাটা কেমন হবে? ইংরেজি খবরের ক্ষেত্রে ‘সাকসেসফুল’ শব্দটা প্রায়ই চোখে পড়ে, ওটা একেবারেই লেখা উচিত হবে না। প্রতিটি খবরের সঙ্গে হেল্পলাইন নম্বর দিতে হবে, সঙ্গে এই বার্তাও: আত্মহত্যাপ্রবণ বা অবসাদে আক্রান্ত মানুষদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আছেন কেউ।
আমাদের জীবনে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আত্মহত্যার ঘটনাকে কী ভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে, আত্মহত্যার হার হ্রাস বা বৃদ্ধির উপরে তার একটা সুনির্দিষ্ট প্রভাব পড়ে। সাংবাদিকরা তো বটেই, এই ধরনের ঘটনা কমানোর ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের প্রত্যেককে। যিনি আত্মহত্যা করলেন, তাঁর প্রিয়জন ও পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে এর মতো যন্ত্রণাদায়ক ঘটনা আর কিছুই হতে পারে না। সাংবাদিকদের তাই হতে হবে আরও যত্নশীল। আরও সংবেদী।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ