এক নির্মম বাস্তবের উত্তরাধিকার বহন করছেন জো বাইডেন। অযোগ্য, অহংসর্বস্ব, দুর্নীতিপরায়ণ, বর্ণবিদ্বেষী, নারীবিদ্বেষী, নীতিহীন ও মিথ্যাবাদী এক ব্যক্তি ৭.১ কোটি আমেরিকানের নয়নের মণি ছিলেন। বাইডেনের সঙ্গে তাঁর ভোটের স্বল্প ব্যবধানই বুঝিয়ে দিল, কোভিড ও বিধ্বস্ত অর্থনীতির অনুপস্থিতিতে কতখানি শক্তি নিয়ে ফিরে আসতেন ট্রাম্প। প্রথম একশো দিনে তাই ‘শুশ্রূষা’র ক্ষমতা দেখাতে হবে বাইডেনকে। এমন ক্ষত তৈরি হয়েছে, যেগুলির দ্রুত ‘চিকিৎসা’ দরকার।
বিভক্ত সরকার, যা বিভক্ত জাতিরই প্রতিফলন, তাকে জোড়া দিতে ‘ব্যান্ড-এড’ দরকার বাইডেনের। সেনেট রিপাবলিকানদের হাতে থাকলে তাঁকে হেয় করার সব চেষ্টাই চলবে। কাজ করিয়ে নিতে গেলে ঘোড়া কেনাবেচা বা তোয়াজ করা ছাড়া উপায় নেই বাইডেনের। ৩৬ বছর সেনেটে থাকার সুবাদে এই ভূমিকায় তিনি যথাযথ। কৌশলে কার্যসিদ্ধির ব্যাপারটি প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে বাইডেনের অতীত অভিজ্ঞতা কাজে দেবে।
সমর্থকদের জন্যেও ‘ব্যান্ড-এড’ প্রয়োজন। দলের প্রগতিশীল অংশ, বিশেষত আলেকজ়ান্দ্রিয়া ওকাশিয়ো-কর্তেজ়ের নেতৃত্বে যুব সম্প্রদায় এত দিন চুপ ছিল। কিন্তু তাঁরা মধ্যপন্থী নীতিগুলির সঙ্গে সহমত নন। ফল সমানে সমানে হওয়ায় তাঁরা হয়তো তত পাত্তা পাবেন না, কিন্তু উদ্যোগী শক্তিকে কোণঠাসা করে দিলে ভুল হবে। দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র হতে পারেন কমলা হ্যারিস, যাঁর প্রগতিশীল ও মধ্যপন্থী দুই অবস্থানেই মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। ‘বাইডেন-স্যান্ডার্স যৌথ কর্মী বাহিনী’-র কথা মাথায় রেখেই ক্যাবিনেট সাজানো উচিত। বছরের গোড়ায় প্রগতিশীল-মধ্যপন্থী আপস মঞ্চ তৈরি করে সমবেত হয়েছিলেন সকলে।
কয়েক মাস আগে আমেরিকায় বর্ণ-বিচারের দুরবস্থা নিয়ে বিক্ষোভের পরে এই ‘শুশ্রূষা’র দাবি উঠবেই। ‘ব্যাটলগ্রাউন্ড’ প্রদেশগুলিতে বাইডেনকে এগিয়ে রাখার ক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোট জরুরি ছিল। কালো আমেরিকাও প্রতিদান চাইবে। দুঃখজনক ভাবে, বর্ণবিদ্বেষ ব্যবস্থার মধ্যেই আছে, এবং ব্যবস্থা পাল্টানোর লোক বাইডেন নন। অশ্বেতাঙ্গ মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনই তাঁর বলিষ্ঠতম পদক্ষেপ। মঞ্চে কমলার উপস্থিতি এবং প্রাক্তন বস প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্টের দীর্ঘ ছায়া তাঁর ব্যাপারে আশা বাড়িয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যেতে পারে স্টেসি আব্রামস-এর মতো কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের। রিপাবলিকান ঘাঁটি জর্জিয়ায় ভোট জোগাড়ের জন্য নিরন্তর পরিশ্রম করেছেন আব্রামস।
বিধ্বস্ত অর্থনীতি সারিয়ে তোলার দায়িত্বও নিতে হবে বাইডেনকে। বাজারে চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে তা করা সম্ভব, কিন্তু খরচ করার মতো টাকার সংস্থান করতে সরকারকে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে। এই কাজ করতে রাজনীতিকেরা ভয় পান। পথের কাঁটা হবে বিভক্ত সরকার। বাইডেনের কাজ, রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ সেনেটকে বুঝিয়ে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধির অনুমতি আদায়। অন্যথায়, আমেরিকা ও বিশ্ববাজারে আরও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখার আশঙ্কা আছে। ‘বিগ টেক’ অর্থাৎ আমেরিকার বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির ব্যাপারেও বাইডেনের সুসংহত অবস্থান নেওয়া প্রয়োজন। তার জন্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত ব্যাপার জেনেশুনে নেওয়া দরকার। এখনও পর্যন্ত তেমন আগ্রহ দেখাননি তিনি, অথচ এটাই বিশ্ববাজারের প্রতিযোগিতায় আমেরিকার তুরুপের তাস।
অতিমারির ক্ষেত্রে আমেরিকার দুর্বল উদ্যোগকে মেরামত করাই বাইডেনের আশু কর্তব্য। তিনি একটি কর্মী-দল নিয়োগ করেছেন, কিন্তু ২০২১ সালে টিকার রসদ জোগাড় করাই নতুন চ্যালেঞ্জ। বাইডেনের তৈরি বিশেষজ্ঞ দলের শুধু খুঁটিনাটি, যুক্তি ও তথ্য নিয়ে থাকলেই চলবে না, সন্দেহপ্রবণ এবং অতিমারি-বিধ্বস্ত নাগরিকদের মন জয় করতে সহমর্মীও হতে হবে। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে তাঁরাও মঞ্চে থাকলে জনতার কাছে বার্তা যাবে, জীবন ও জীবিকা দুই-ই বাঁচাতে উদ্যোগী সরকার।
বিদেশনীতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে নিরাময়ের জন্য সঙ্কেত পাঠাবেন বাইডেন। নিবেদিতপ্রাণ কমিটি-সদস্য হিসেবে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি বর্জন করবেন, এবং দুনিয়াকে জানাবেন, কমিটি প্রকল্পগুলিতে আবার ফিরে এসেছে আমেরিকা, যেখানে আছে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং বিপদকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জোট। তবে কাজের কাজ হওয়াও দরকার। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়িত করতে বিকল্প শক্তি সংক্রান্ত প্রকল্পের ব্যাপারে রিপাবলিকান সেনেটরদের বোঝাতে হবে। প্রতিপক্ষকে সামলানোর ক্ষেত্রে বাইডেন কারও পরোয়া করেন না। ভ্লাদিমির পুতিন সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমি আপনার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আপনার আত্মা বলে কিছু আছে বলে মনে হয় না।” শি চিনফিংকে ‘ঠগ’ বলেছিলেন। অনুমান এবং ভয় হয়, সম্ভাবনাময় এককালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে মাঝেমধ্যেই তিনি মনের কথা বলে ফেলবেন! তাঁর টিমের উচিত, কৌশলগত অগ্রগমনের বার্তা দিয়ে প্রেসিডেন্টের বিতর্কহীন বক্তব্য প্রকাশ করা— টেলিপ্রম্পটারে ভারসাম্যের চিত্রনাট্য সাজানো।
ভারতের ক্ষেত্রে স্পষ্ট যে, ভিড়ে ঠাসা স্টেডিয়ামে হাত ধরে চলার ছবি এখনই অন্তত দেখা যাবে না। ভারতের সঙ্গে বন্ধনের সূত্রে কমলা হ্যারিসের প্রভাব থাকবেই। তঁাকে নিয়ে ভারতের মুগ্ধতার শেষ নেই, কিন্তু মোদীর নীতিতে, বিশেষত কাশ্মীর প্রসঙ্গে, তিনি মোটেই মুগ্ধ নন। সুতরাং, নিজের মাতৃভূমি সম্পর্কে খাঁটি ভালবাসাটুকু ছাড়া কমলার বক্তব্য চাঁচাছোলা হবে বলেই মনে হয়। অর্থাৎ, এই প্রশাসন ভূরাজনৈতিক এবং কৌশলগত দিক মাথায় রেখেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করবে। দীর্ঘমেয়াদি ফল অনেকটাই ভাল হবে। অন্তত আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে মোদীর আলিঙ্গন আর ‘দূষিত বায়ু’ সহ্য করতে হবে না, যাতে পরের দিন তাঁর পুত্র এসে কন্ডো কমপ্লেক্স বেচতে পারেন।
এ শুধু আমেরিকার মাথাব্যথা নয়, গোটা বিশ্বেরই, কারণ আমেরিকা এখনও গুরুত্বপূর্ণ। বাইডেন-হ্যারিস যদি প্রথম একশো দিনের কঠিন সময় সফল ভাবে পার করে ফেলতে পারেন, তা হলে বিশ্ব একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবে।
ফ্লেচার স্কুল অব ল অ্যান্ড ডিপ্লোম্যাসি, টাফটস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা