জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রছাত্রীদের উপরে পুলিশের নৃশংস আক্রমণ দেখে শিউরে উঠেছে গোটা দেশ। চোখে আঘাত পেয়ে এক ছাত্র ইতিমধ্যে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন।
ওই ছাত্রছাত্রীদের দোষ কি ছিল? দোষ ছিল এই যে তাঁরা বলেছিলেন, এই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারাকে উলঙ্ঘন করে আনা হয়েছে। তাঁরা ছাত্র, তাঁরা বলেছিলেন সংবিধানের যে ধারা বলে যে কোনও নাগরিককে ধর্মের কারণে বেনাগরিক করা যাবে না, এই আইন সেই ধারাকে নর্দমায় ছুড়ে ফেলেছে। পরিকল্পনা মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু বাদ সাধল এই ছাত্রেরা।
দীর্ঘ ছ’বছর ধরে এক ধর্মের মানুষকে কোণঠাসা করার পরিকল্পনা কিন্তু এক দিনে রচিত হয়নি। একের পর এক ঘটনায় একটি ধর্মের মানুষকে ক্রমশ সমাজের প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। দিনের পর দিন কোণঠাসা হতে-হতে এক জন মানুষ কী করে ? সে কি কুঁকড়ে যায়? নাকি প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে? একটা পশুও তো তাই করে! আপনি যদি একটি বিড়ালকে যদি ক্রমশ কোণঠাসা করেন, সে কি করবে?
কাশ্মীর যেহেতু মুসলমান-প্রধান রাজ্য, যেহেতু সংখ্যাগুরু মানুষ মনে করেন কাশ্মীরের সবাই সন্ত্রাসবাদী, সবাই পাকিস্তানের সমর্থক, সবাইকে গুলি করে দেওয়া উচিত, ওখানে পাকিস্তানের পতাকা উড়ত, তাই কলমের এক খোঁচায় শাসক ৩৭০ ধারা তুলে দিল আর তার পর চার মাস ধরে একটা ভূখণ্ডকে সমস্ত দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে সংসদে দাঁড়িয়ে বেমালুম বলল যে কাশ্মীর ‘শান্ত’ আছে, ‘স্বাভাবিক’ আছে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজিবকে গুম করে দিল, নাজীবের মায়ের কান্না আর হাহাকার সংখ্যাগুরু মানুষের কানে পৌঁছল না, তারা চুপ করে থাকল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাসের পর মাস গৃহবন্দি করে রাখা হল, কিন্তু সংখ্যাগুরু মানুষ কাশ্মীরকে বেড়াতে যাওয়ার জায়গা ছাড়া আর কিছু ভাবেনি, তাই কাশ্মীরিদের সমস্যাকে নিজের সমস্যাও মনে করেনি।
কারও মনে একটাও প্রশ্ন আসেনি যখন বাবরি মসজিদের রায়ে সংখ্যাগুরু মানুষের বিশ্বাসকে প্রশ্রয় দেওয়া হল। কারও এক বারও মনে হয়নি যে এর প্রতিবাদ করা উচিত। দিনের পর দিন গণপিটুনিতে মারা গিয়েছে মানুষ, কারও প্রশ্ন জাগেনি, কারও মনে আখলাখের আর্তনাদ পৌঁছয়নি, তবরেজের কান্না ঢোকেনি। তখনও চুপ করে বসেছিল সংখ্যালঘু মানুষ। ক্যানিংয়ের শাহরুফকে যখন মারা হয়েছিল, তার আর্তনাদও সেই মানুষগুলোর কানে পৌঁছয়নি— তখন কানে ছিল ‘জয় শ্রীরাম’। তাদের বরং মনে হয়েছে যে এত কিছুর পরে মুসলমানদের দায়িত্ব নীরব থাকা, সব মেনে নেওয়া। সব সময়ে একতরফা শান্ত থাকার একতরফা দায় কি শুধু মুসলমানের? আইন, আদালত, সরকার কোথাও কোনও রক্ষাকবচ নেই। কিন্তু শান্তির বাণীও তাঁদেরই দিতে হবে। আসানসোলে ইমদাদুল্লা রশিদির ছেলে সিবগাতুল্লাকে মেরে ফেলা হল, কথা বললেন না এক জন হিন্দু মানুষ, চুপ করে থাকলেন, রাস্তায় নামলেন না, মনে হল না কিছু বলা উচিত। তাই ইমদাদুল্লা রশিদিকেই শান্ত থাকার বার্তা দিতে হল। ছেলের মৃত্যুর শোক বুকে নিয়েও সে দিন দিতে হয়েছিল, আজও
দিতে হয়।
ঝাড়খণ্ডের নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কারা দাঙ্গা করছে তা নাকি পোশাক দেখেই বোঝা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের এক নেতা মন্তব্য করেছেন যে ‘দাড়ি, টুপি, লুঙ্গি’ পড়া মানুষজন দাঙ্গা করছেন। তার মানে কি দাঁড়াল? আসলে এক শ্রেণির মানুষকে দাগিয়ে দেওয়ার এই রাজনীতি খুব সচেতন ভাবে মানুষের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার এই পদ্ধতিটি খেয়াল করা উচিত। সারা ভারতে এই নাগরিকত্বের আইনের বিরুদ্ধে যে লড়াই চলছে, সেখানে কিন্তু কোথাও শুধুমাত্র মুসলমানেরা আন্দোলন করছেন না। স্মৃতি যদি খুব দুর্বল না হয় তা হলে নিশ্চিত মনে পড়বে, কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি যখন কেরল থেকে দাঁড়িয়েছিলেন তখন নির্বাচনী সভায় এই প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে ‘ওই কেন্দ্রে তো সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগুরু’। তখন যেমন নির্বাচন কমিশন আপত্তি জানায়নি, তথাকথিত উদার মানুষজনও কিন্তু কিছু বলেননি। আজ যখন প্রধানমন্ত্রী বা এ রাজ্যের নেতারা এই কথাটা বলেন এবং পাশাপাশি সমস্ত মিডিয়া বেছে-বেছে ছবি দেখাতে শুরু করে, তখন এই সাম্প্রদায়িক বৃত্তটা সম্পূর্ণতা পায়। তার পর যখন সেই ছবি মুঠোফোনের মধ্যে দিয়ে ছড়ায়, তখন এই ‘অপর’ বানানোর প্রক্রিয়াটি আরও ভিতরে ঢোকে। প্রথমে পাড়ায়, তার পর পরিবারে, তার পর আরও গভীরে প্রবেশ করানো হয়।
অনেকে বলতেই পারেন যে মুসলমানেরা তো সত্যি ভাঙচুর করছে, তা হলে এটা বলতে আপত্তি কোথায়? আপত্তি এইখানে যে যখন কেরলে শবরীমালা মন্দিরের রায় বেরনোর পরে দাঙ্গা হয় কিংবা ধর্ষক রামরহিমের মুক্তির দাবিতে হরিয়ানা রাজ্যে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়, তখন কি প্রধানমন্ত্রী বা সরকারি দলের নেতামন্ত্রীদের কাছ থেকে একই রকমের মন্তব্য শোনা যায়? না যায় না, কারণ হিন্দু মননে কোথাও কোনও দিন সংখ্যালঘুর জন্য জায়গা ছিল না। তাই সেই জায়গাটা নিয়েই নেতামন্ত্রীরা খেলা করেন। অথচ এক জন দাঙ্গাবাজের কি কোনও ধর্ম হয়? এটা পড়েই হয়তো চোখ কপালে উঠতে পারে, কিন্তু একটা প্রশ্ন নিজেকে করা কি জরুরি নয় যে সংখ্যালঘু কি সংখ্যাগুরুর দেশে দাঙ্গা করে থাকতে পারবে ? সে কি যথেষ্ট ভয়ে নেই? সে কি যথেষ্ট কুঁকড়ে নেই? তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানোর সমস্ত রকম প্রক্রিয়া যদি রাষ্ট্র করে সে কি চিরকাল চুপ করেই থাকবে? সে কি এক বারও ঘুরে প্রতি আক্রমণ করবে না? আর তা যদি হয় তখন কি ‘গেল গেল’ রব উঠবে? সবাই ‘শান্ত হোন শান্ত হোন’ আওয়াজ তুলবেন? কেন বারবার সংখ্যালঘুর দিকেই আঙুল তোলা হবে? বলা হবে যে এ ভাবে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করা ঠিক নয়, কিন্তু কেউ এক বারও প্রশ্ন তুলবেন না যে সরকার যদি তার নাগরিকদের জীবন ধর্মীয় কারণে ধ্বংস করে তা হলে কি সেটা অন্যায় নয়?
কিন্তু সবের পরেও খেলাটা হঠাৎ পরিকল্পনার বাইরে চলে যায় যখন জামিয়ার ছাত্রদের ওপর আক্রমণটা নেমে আসে। তখন মনে হয় যে এবার প্রত্যেকটি মানুষ হয়তো বুঝবেন, এই লড়াইটা হিন্দু-মুসলমানের নয়। এই লড়াইটা প্রতিটি ভারতীয়ের যাঁরা এই দেশকে ভালবাসেন, যাঁরা চান যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা অটুট থাক, যাঁরা চান যে ধর্মের নামে যে দেশ ভাগ হয়েছে সেই দেশ থেকে যেন আর এক বার ধর্মের কারণে কাউকে বিতাড়িত না হতে হয়। কারণ সচেতন ছাত্রদের কোনও ধর্ম হয় না, তাঁরা হিন্দু-মুসলমান বোঝেন না, তাঁরা বোঝেন তাঁদের সহপাঠী আক্রান্ত, তাই তাঁরা দিন মানেন না, রাত মানেন না, রাস্তায় নেমে পড়েন। কলকাতা যখন এই, দিল্লির ছাত্রেরা রাস্তায় মশাল মিছিল করেন। আর সেখানেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে লড়াইটা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। শাসক ভয় পায়, তাই সে দমন-পীড়ন নামিয়ে আনে। কিন্তু পারবে কি সে এই ছেলেমেয়েদের আটকাতে? পারবে কি সে মুখ চিরতরে বন্ধ করে দিতে?