রেওয়াজ: বালুরঘাটে জামাইষষ্ঠীর পুজো। ফাইল ছবি
একান্নবর্তী পরিবার আজ হাতোগোনা বিষয়। ক্রমশ ছিঁড়ে যাচ্ছে আত্মীয়তার আদি নাড়ি। সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতার চর্চা চলছে অহরহ। তবু কিছু সামাজিক প্রথা বা রীতি এখনও গুরুত্ব হারায়নি। এত ভাঙনের মধ্যেও জামাইষষ্ঠীর মতো প্রথা বেঁধে বেঁধে থাকার কথাই বলে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার রকমফের হয়েছে যুগে যুগে। নারী আর অন্তঃপুরবাসিনী নন। নিজের বাড়ি যা যাওয়ার জন্য তাঁদের এখন আর তেমন কাঠখড় পোড়াতে হয় না। আগে এমনটা ছিল না। তখন জামাইদের ঘনঘন যাতায়াতের রেওয়াজ ছিল না শ্বশুরবাড়িতে। আর সেই আদি কাল থেকেই জামাইষষ্ঠীতে শ্বশুরবাড়ির টান ছিল আলাদা। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বিশেষ দিনগুলিকে বিশেষ মাহাত্ম্যে উদ্যাপন করার চল রয়েছে। জামাইষষ্ঠী তেমনই একটি দিবসের উদ্যাপন, যা আদি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ভাবনা। বৈবাহিক সর্ম্পকে দু’টি অচেনা-অজানা পরিবার সংযুক্ত হয়। এই পারিবারিক বন্ধনকে জামাইষষ্ঠীর মতো অনুষ্ঠান দৃঢ় করে। কন্যাসন্তানের বিয়ের সময় পরিবারের পিতা বা পরিবারের কেউ কন্যা সম্প্রদান করেন। সংস্কার কিংবা রীতি মাফিক এক বছর তাঁর মেয়ের বাড়ি যাওয়া চলে না। এমন সংস্কার হয়তো এখনও আছে। অনেকে মনে করেন, সেই কারণেই মেয়ের বাড়িতে এমন অনুষ্ঠান। সপরিবার মিলনের সুযোগ ঘটাতেই জামাইষষ্ঠীর আয়োজন। এই সময়ে হয়তো এমন অনেক রীতিই অচল। কিন্তু জামাইষষ্ঠী স্বমহিমায় আজও বিরাজমান। জামাইদের কদর চিরন্তন। মা ষষ্ঠী প্রজন্ম-সৃজনের দেবী। এই লোকদেবীর আরাধনাও জামাইষষ্ঠীর সঙ্গে ওতোপ্রোত ভাবে যুক্ত। এই দেবী যেমন মাতৃত্বের প্রতীক, তেমনই শিশুর রক্ষয়িত্রী। দাম্পত্য জীবনকে সুখময় করতে পারস্পরিক শুভেচ্ছা-আর্শীবাদের এই প্রথা এখনও বেশ জনপ্রিয়। কালের গর্ভে অনেক মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। কিন্তু জামাইষষ্ঠীর মতো কিছু অনুষ্ঠান আজও বেঁচেবর্তে রয়েছে।
কর্পোরেট দুনিয়ারও এউ আয়োজনটি নিয়ে চিন্তাভাবনার অন্ত নেই। বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংস্থার এই উৎসবে কোমর বেঁধে নেমে পড়ে। পোশাক থেকে বাসস্থান ও জুয়েলারির দোকান লোভনীয় ছাড় দেয়। প্রতিযোগিতায় হাসফাঁস করে বঙ্গজ সংস্কৃতির সনাতন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। খরচ কুলোতে না পারলে থাকে সহজলভ্য ঋণের হাতছানি। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতি যা আজ হাতের মুঠোয় পরকে আপন করে নেওয়ার সহজাত মানব প্রবৃত্তিকে উৎসাহিত করেছে, সন্দেহ নেই। তবুও যেন কোথায় তাল কেটে যায়। শুরু হয় বিষয় সম্পত্তি নিয়ে চাপানউতোর।
জামাইষষ্ঠী একটি প্রচলিত লোককথা থেকে উৎসারিত। যার সঙ্গে সম্পৃক্ত সামাজিক বন্ধন। আত্মীয়তার নিগড়ে শক্তপোক্ত করে বেঁধে রাখার প্রাচীন প্রথা। আধুনিক যন্ত্রসভ্যতায় জামাইষষ্ঠী তার প্রাচীনত্ব হারালেও আজও তা প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ন তিথিতে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে জামাইষষ্ঠীর উদ্যাপন হয়। একে অরণ্যষষ্ঠী নামেও অভিহিত করা হয়। সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে অরণ্যকে দেবতা জ্ঞানে পূজা করবার চল রয়েছে। প্রাচীন কাল থেকেই মুণিঋষিগণ পারিবারিক আর সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে বিভিন্ন দেবদেবীর পাশাপাশি এমন সব সামাজিক ধর্মীয় উৎসবের প্রচলন করেন।
জামাইষষ্ঠীতে ব্যহৃত বিভিন্ন গাছগাছড়া ও বিভিন্ন মরসুমি ফলের উপচার থেকেই বোঝা যায়, অরণ্য পরিবেশের ভিন্ন তাৎপর্য ছিল। করমচা-সহ পাঁচ সাত রকমের ফল কাঁঠাল পাতার উপর সজ্জিত রাখা হয়। প্রয়োজন হয় দূর্বা ঘাসের আঁটি। যা সবুজ সুন্দর সতেজ জীবনের প্রতীক। ধান দূর্বা জামাইয়ের মাথায় ঠেকিয়ে আর্শীবাদ করা হয়। দীর্ঘ ও সুস্থ জীবন কামনা করা হয়। এখানে ধান হল সমৃদ্ধির প্রতীক। তেল-হলুদ মাখানো মাঙ্গলিক সুতো কবজিতে বেঁধে দেওয়া হয়। কপালে দইয়ের ফোঁটা দেওয়ার চল রয়েছে। আম, জাম, কাঁঠালের মতো মরসুমি ফলে ঘরবাড়ি ম-ম করে। সমস্ত রকম লোভনীয় খাবারের সমারোহ ঘটে। পঞ্চব্যঞ্জনে ভুরিভোজ চলে।
একটি গ্রাম্য প্রবাদ রয়েছে। জামাইয়ের নামে কাটে হাঁস, ঘরশুদ্ধ খাবে মাস। এক সময় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা বিশেষ করে গ্রাম্য জীবনে মাংস খাওয়ার চল বিশেষ উৎসব কিংবা জামাইয়ের মতো সম্মাননীয় অতিথিদের আগমনে ঘটত। সেই ছূতোয় পরিবারের সকলের ভুরিভোজনের সুযোগ আসত। বর্তমান যুগের সঙ্গে যা একেবারেই মিলবে না। অর্থাৎ জামাই আপ্যায়ন কদর সর্বজনবিদিত। যাকে বলে জামাই আদর। লৌকিক দেবী ষষ্ঠীকে কেন্দ্র করেই অরণ্যষষ্ঠী বা জামাইষষ্ঠীর প্রর্বতন।
ষষ্ঠীর কিংবদন্তির উল্লেখ মঙ্গলকাব্যেও রয়েছে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী লিখেছেন,‘দুয়ারে বান্ধিল জাল বেত্র উপনাদে। /ফেড়িয়া চালের খড় জ্বালিল আঁতুরি।/ গো-মুন্ডে থুইয়া দ্বার পূজে ষষ্ঠী বুড়ি।’ ষষ্ঠীকে ঘিরেই আর্বতিত জামাইষষ্ঠীর সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। বঙ্গীয় সমাজের পরম্পরা টিকে আছে স্বমহিমায় সুখসমৃদ্ধির আকুতি নিয়ে।
(লেখক ফাঁসিদেওয়ার নজরুল শতবার্ষিকী বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)