জাইর বোলসোনারো।—ছবি এএফপি।
তিন দশক আগে ব্রাজ়িল গণতন্ত্রের অভিমুখে যাত্রা শুরু করিয়াছিল। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি নূতন প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারোর শপথগ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ত্রিশ বৎসরের গণতান্ত্রিক কেরিয়ারের মধ্যে এই দেশের সর্বাপেক্ষা গুরুতর দক্ষিণায়নটি আরম্ভ হইল। বোলসোনারো কেবল দক্ষিণপন্থী অতি-রক্ষণশীলতার ধ্বজাধারী নহেন, তিনি প্রাক্তন সেনা-জেনারেলও বটে। ব্রাজ়িলের ইতিহাসের যে পর্বে তিনি সেনাবাহিনীর অধিনাকত্ব করিতেন, তখনকার সামরিক কার্যকলাপই বলিয়া দেয় যে কমিউনিজ়ম-এর বিরুদ্ধে দরকারে তিনি আবারও যুদ্ধ শুরু করিতে প্রস্তুত থাকিবেন। বাস্তবিক, নিজের মুখেই নূতন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করিয়াছেন, ব্রাজ়িলের পতাকা যাহাতে কোনও দিন ‘লাল’-এর কাছাকাছিও না যায়, তাহা নিশ্চিত করাই তাঁহার শাসনের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য। কেবল কমিউনিজ়ম-এর প্রতি তীব্র বিরাগই নহে। যে কোনও ‘তথাকথিত’ প্রগতিবাদ বা মুক্তচিন্তার িবরোধী তিনি। নির্বাচনী প্রচারকালে গর্ব করিয়া বলিয়াছিলেন, সমকামী সন্তানের তুলনায় মৃত সন্তানও তাঁহার নিকট অধিক বাঞ্ছিত! বলিয়াছিলেন, ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ নামক অসহিষ্ণুতাকে তিনি দেশ হইতে চিরতরে ত্যাজ্য করিতে চাহেন। তাঁহার এতাদৃশ মতামত যে জনসমাজের একাংশের নিকট অত্যন্ত আকর্ষক হইবে বোঝাই যায়, কিন্তু সেই একাংশ যে দেশের গরিষ্ঠাংশ হইবে, এবং তন্মধ্যে যে যুবা-সম্প্রদায়ের এক বিশাল অংশ অন্তর্ভুক্ত হইবে, এতখানি হয়তো বোলসোনারো নিজেও আশা করেন নাই। ব্রাজ়িল একটি নূতন পর্বে প্রবেশ করিল, সন্দেহ নাই। সন্দেহ নাই যে গত বারের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও দুর্নীতিপ্রবণতাই দেশের মানুষকে এই চরমতার দিকে ঠেলিয়া দিল।
অবশ্য এই বারের প্রচারেই বোঝা গিয়াছে যে বোলসোনারোর গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু প্রশ্নাতীত নয়। প্রচার চলাকালীন তিনি আততায়ীর হাতে ছুরিকাহত হন। বহু মানুষ তাঁহার বিরুদ্ধে উগ্র স্লোগান দিতে শুরু করে। অর্থাৎ পূর্বতন প্রেসিডেন্টের সময়ে শাসক শ্রেণির নানাবিধ দুর্নীতির প্রকাশ, এবং প্রখ্যাত গ্যাসোলিন-ব্যবসায়িক কোম্পানির সহিত বিগত সরকারের অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ যতই দেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষকে তিক্ত করিয়া দিক, বোলসোনারোর মতো অগ্নিবর্ষী দক্ষিণপন্থী নেতাকে স্বীকার করিতেও দেশের বহু নাগরিক নারাজ। মাঝখান হইতে ব্রাজ়িলীয় সমাজ এই বারে যে ভাবে দ্বিমেরুবিভক্ত হইয়া গেল, আগে কখনও তেমনটা দেখা যায় নাই। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো তাঁহার আদর্শপুরুষ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সহযাত্রী। ট্রাম্পের দেশও ইতিমধ্যে স্পষ্ট করিয়া দিয়াছে, ট্রাম্পের সঙ্গে সেই দেশে উগ্র রক্ষণশীলতাই যে সর্বতো ভাবে জয়লাভ করিয়াছে, বলা যাইবে না। বরং ট্রাম্পের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেমন আড়াআড়ি দ্বিধাবিভক্ত হইয়া গিয়াছে, আগে কখনও তাহা দেখা যায় নাই। এই আড়াআড়ি দ্বিধাবিভাজনই নূতন যুগের বৈশিষ্ট্য বলা যায়। দক্ষিণপন্থার প্রবল তরঙ্গ এই দেশগুলিকে ভাসাইবার বদলে দেশের অভ্যন্তরে দুই প্রবল শত্রুপক্ষ নির্মাণ করিয়াছে— যে দুই শিবিরের মধ্যে সামাজিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক দূরত্ব অভূতপূর্ব রকমের বেশি। বিশ্ব যেন এখন এক ভিন্ন অর্থে দ্বিমেরু হইতেছে।