বিজ্ঞজনেরা বলিয়া থাকেন, স্বাভাবিক সময়ে মানুষ যাহা শিখে, সঙ্কটকালে শিখিয়া থাকে তাহা অপেক্ষা অনেক বেশি, এবং দ্রুত। প্রযুক্তি, বিশেষত ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহার এই যুগে মানুষের সঙ্গী, বন্যার ন্যায় তথ্যরাশি প্রতি মুহূর্তে তাহাকে গ্রাস করিতেছে। মানবমস্তিষ্ক এই বিপুল তথ্যভার হইতে নিজ প্রয়োজনটুকু ছাঁকিয়া লয়। মন সেই কিয়দংশ লইয়াই লোফালুফি করিতে থাকে, তাহার আবেগ ও যুক্তিকে যাহা স্পর্শ করে। বিপদের সময় বা দুর্যোগক্ষণে কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। অন্য সময়ে যে তথ্য বা সংবাদকে সে ফিরিয়াও দেখিত না, সঙ্কটকালে সেইগুলিই তাহাকে বিচলিত করিবার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু প্রচারিত সকল তথ্যই সত্য বা প্রমাণিত নহে। নিরুপদ্রব কালেই ভুল-নির্ভুল মিশাইয়া ভূরি ভূরি তথ্যোদ্গম হইতেছে, সঙ্কটকালে তাহার বিস্তার কীরূপ হইবে অনুমান করিতে কষ্ট হয় না। কোভিড-১৯ বিশ্বময় ছড়াইয়া অতিমারি বা ‘প্যানডেমিক’ আখ্যা পাইয়াছে, এই সর্বগ্রাসী তথ্যভারকেও বিশেষজ্ঞগণ নাম দিয়াছেন ‘ইনফোডেমিক’। বর্তমান বিশ্ব ইনফোডেমিক-আক্রান্ত, বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।
সব জীবাণু প্রাণঘাতী নয়, সমস্ত তথ্যই অসত্য নহে। ভুল ও বিকৃত তথ্যগুলিই গুজব বা ফেক নিউজ় হইয়া ছড়াইয়া পড়ে। তথ্য মাত্রেই নির্দিষ্ট রূপ পায় সংবাদ বা বার্তায়; গণমাধ্যম— সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিয়ো, চলচ্চিত্র এবং আজিকার যুগে ইন্টারনেট সেই বার্তাবহ। ইন্টারনেটের হাত ধরিয়া আসিয়াছে সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজমাধ্যম, এই যুগের নাগরিকজীবনের সহিত যাহা প্রায় সমার্থক। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রামের ন্যায় সমাজমাধ্যম পরিসরগুলি শুরু হইয়াছিল বন্ধু-পরিজন ও সমমনস্ক মানুষের যোগাযোগের, অথবা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাবনা বিনিময়ের ক্ষেত্র হিসাবে। অতি দ্রুত তাহা পরিণত হইয়াছে তথ্য তথা সংবাদ পরিবেশন ও প্রচারের মাধ্যমে। বহু নাগরিক দিনের অনেকাংশ সমাজমাধ্যমে অতিবাহিত করেন, দৈনন্দিন রোজনামচা ও অনুভব-অভিজ্ঞতার বয়ানের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ তথ্য ও সংবাদ তাঁহাদের সম্মুখে মুহুর্মুহু আবির্ভূত হয়। এই তথ্যের অনেকাংশ বিভ্রান্তিকর ও অসত্য, কারণ সমাজমাধ্যমে তাৎক্ষণিকতার যত গুরুত্ব, প্রামাণ্যতার তত নহে। করোনায় মৃতের সংখ্যা এত দিনের রেকর্ড ছাড়াইয়া গেল, অমুক স্থানে দাঙ্গা হইয়া গিয়াছে, বন্ধ ফ্ল্যাটে চিত্রতারকার ঝুলন্ত দেহ মিলিয়াছে— শিহরন-জাগানো তথ্য বা খবরটি কত দ্রুত ও অন্য সকলের আগে কোনও সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী নিজের টাইমলাইনে লিখিবেন বা শেয়ার করিবেন, সেই অসম্ভব তাড়ায় তথ্যের সত্যতা ঢাকাচাপা পড়িয়া যায়। আর ঝুলি হইতে বিভ্রান্তির বিড়াল এক বার বাহির হইয়া পড়িলে মুশকিল, নিমেষে তাহা অগণিত মানুষের কাছে পৌঁছাইয়া যায়, জন্ম দেয় উদ্বেগ ও আতঙ্কের। সমাজমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যের অন্ধ অনুসরণে কী হইতে পারে, এক করোনাই দেখাইয়া দিয়াছে। রোগমুক্তির আশায় ভুল ঔষধ বা রাসায়নিক খাইয়া জীবনহানি পর্যন্ত হইয়াছে। সরকারি বা স্বাস্থ্য মন্ত্রকের ঘোষণার নামে ছড়াইয়াছে নকল নির্দেশিকা। হাওয়ায় ঘুরিতেছে অগণিত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, তাহা বিশ্বাস করিলে সামাজিক হইতে আন্তর্জাতিক সকল সম্পর্কের সমীকরণ ধাক্কা খাইতে বাধ্য।
সমাজতাত্ত্বিকরা বলিতেছেন, আমরা বাস করিতেছি ‘পোস্ট ট্রুথ’ বা সত্য-উত্তর কালে, যেখানে যুক্তিগ্রাহ্যতা নহে, আবেগবাহুল্যই আমাদের নিয়ন্ত্রক। সমাজমাধ্যম-সূত্রে ভুল তথ্য যে প্রতিদিন আমাদের প্রভাবিত করিতেছে, তাহার কারণ সেইগুলি আপাত-বিশ্বাসযোগ্যতার মোড়কে আমাদের মনের পক্ষপাত বা সংস্কারের সহিত জড়িত আবেগ উস্কাইয়া দেয়। তখন অতিমারির আবহে ভিন্ধর্মী মানুষের জমায়েত সংক্রান্ত তথ্যও ধর্মবিদ্বেষের রং ছড়াইতে পারে, সীমান্তে সেনা সংঘাতের ঘটনা সুপ্ত জাতিবৈরিতার নিদ্রাভঙ্গ করে। ইহা এক অনন্ত চক্র। অতিমারি কালের নিয়মে চলিয়া গেলেও এই ‘ইনফোডেমিক’ দূর হইবে বলিয়া মনে হয় না, তাহা নিয়ম করিয়া অন্য কোনও রাজনৈতিক সামাজিক বা ধর্মীয় সংঘটন খুঁজিয়া লইবে। ভুল তথ্য ও ভুয়া খবরের জেরে প্রশাসন হইতে নাগরিক সকলেই ভুক্তভোগী। সমাজমাধ্যম সংস্থাগুলি সতর্ক হইয়াছে বটে, তবে অর্থগৃধ্নুতা প্রায়ই তাহাদের কর্মতৎপরতায় অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়। কুতথ্যের অতিমারিকে দমাইতে নীতি ও আইনের কারিগর হইতে শুভবোধসম্পন্ন নাগরিক, সকলকে একত্র হইতেই হইবে।
যৎকিঞ্চিৎ
যে কোনও বৃহৎ বিষয়ের সঙ্গে সাত সংখ্যাটির বা তার গুণিতকের আমে-দুধে যোগাযোগ। সঙ্গীতে সপ্তসুর। সপ্তাহে সাত দিন। চম্পার সাত ভাই। সাত সমুদ্র। রামধনুর সাত রং। সপ্তপদী। রূপকথায় সপ্তডিঙা, সাত রাজার ধন। মহাভারতে সপ্তরথী। সপ্তকাণ্ড রামায়ণ, বনবাস সাত দু’গুণে চোদ্দো বছরের। তেমনই, করোনা-সংক্রমণ পাকড়াও হতে সময় নেয় চোদ্দো দিন, আর রামদেবের ওষুধ তা না কি তা সাত দিনে সারিয়ে দেয়। নিষিদ্ধ সেই ওষুধের উপকরণ যা-ই হোক, অঙ্কটায় ভুল নেই!