অবসাদ এখন থাবা বসাচ্ছে অল্প বয়সেও। প্রতীকী ছবি।
পরিসংখ্যান বলছে, ফি বছর সারা বিশ্বে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নেন। প্রতি তিন সেকেন্ডে এক জন আত্মহত্যার চেষ্টা করেন আর প্রতি চল্লিশ সেকেন্ডে এক জন তাতে সফল হন। আবার, পুরুষদের আত্মহত্যার প্রবণতা মহিলাদের তুলনায় বেশি। সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে বয়স্কদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা বেশি হলেও অল্পবয়সিদের মধ্যেও এই প্রবণতা নিতান্ত নগণ্য নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিশু ও কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে।
সাধারণ ভাবে পাঁচ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে না। আমাদের দেশে ১৫-২৯ বছর বয়সিদের ক্ষেত্রে আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। শৈশব থেকে কৈশোরের মধ্য দিয়ে যৌবনে উপনীত হওয়ার পর্যায়ে নতুন নতুন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। কিশোর বয়সে স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় নতুন বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তৈরি হয় নিজস্ব চিন্তাধারা, দায়িত্বশীলতা।
এই স্বাভাবিক বিকাশ কোনও কারণে ব্যাহত হলেই সমস্যার সূত্রপাত। সে ক্ষেত্রে ছেলে বা মেয়েটি বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সহজ ভাবে মিশতে পারে না। ছোটখাটো সমস্যারও সমাধান না করতে পেরে নিজের উপরে বিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করে। শুরু হতে থাকে মানসিক সমস্যা। এর পাশাপাশি আরও একটি সমস্যাও অল্পবয়সিদের ক্ষেত্রে ইদানীং গুরুতর হয়ে উঠছে। তা হল অতিরিক্ত চাহিদা এবং যেনতেন প্রকারে তা পূরণের চেষ্টা। আর যখনই তা ফলপ্রসূ হচ্ছে না, জন্ম নিচ্ছে হতাশা। পরে তা-ই ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের দিকে।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যার পেছনে কিছু না কিছু মানসিক সমস্যা যুক্ত থাকে। অবসাদ বা ডিপ্রেশনের সমস্যা এগুলির মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়া, ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’, বিভিন্ন ধরনের নেশার প্রবণতা, ব্যক্তিত্বের সমস্যা বা ‘পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার’, ‘স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া’, ‘অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার’ও আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়।
মনে রাখতে হবে, ‘ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার’ মানে কিন্তু শুধু মন খারাপ নয়। এ ক্ষেত্রে মন খারাপের সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা দেখা দেয়। যেমন—শরীরে শক্তি কমে যাওয়া, আগে যে সমস্ত কাজ করতে ভাল লাগত সেগুলিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনোযোগের অভাব, ভুলে যাওয়া, অল্পেতেই রেগে যাওয়া, নিজের উপরে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, নিজেকে দোষী মনে হওয়া, আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করা, ঘুম কমে বা বেড়ে যাওয়া, খিদে কমে বা বেড়ে যাওয়া, ওজন কমে যাওয়া ইত্যাদি।
যে সব কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তিত্ব ঠিক মতো তৈরি হয় না, তারা সহজেই আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে পড়ে। ব্যক্তিত্বের সমস্যা বিভিন্ন রকমের হতে পারে। যেমন—কেউ কেউ অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হয়। তারা আবেগের বশে হঠাৎ করে আত্মহত্যার চেষ্টা করে বসে। এর পাশাপাশি, যে সমস্ত কিশোর-কিশোরীরা নেশায় জড়িয়ে পড়ে তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। নেশার কারণে নিজের ওপর স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় এবং তাতে আত্মহত্যার ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
এ সব ক্ষেত্রে পরিবার বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের একটা বিরাট ভূমিকা থেকে যায়। যে সব পরিবারে বাবা-মায়ের সম্পর্ক ভাল নয় বা তাঁরা আলাদা থাকেন, সেখানে শিশুটির ঠিক মতো বেড়ে উঠতে সমস্যা হতে পারে। বাড়ির লোকজনের অতিরিক্ত শাসন, নিজের মনের কথা বাবা-মায়ের সঙ্গে আলোচনা না করতে পারা ইত্যাদিও কৈশোরের অগ্রগতির পথে অন্তরায় হতে পারে। বাড়ির কারও মানসিক সমস্যা থাকলে বা বাড়িতে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে থাকলে তা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে শিশুর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। পাশাপাশি, বাসস্থান বা স্কুলের পরিবর্তন, পরিবারের কারও বা কোনও বন্ধুর অসুখ বা মৃত্যু, শারীরিক ও মানসিক উৎপীড়ন, যৌন নির্যাতন বা কোনও দুঃসহ স্মৃতি মনে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে যায়, যা পরবর্তীতে কোনও নিদারুণ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে নিয়েই যেতে পারে।
মুশকিলের বিষয় এই যে, অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির ছেলে-মেয়েটির মনের খোঁজ রাখার অবসর পরিজনদের থাকে না। এ থেকেই সব সমস্যার সূত্রপাত। যে সমস্ত শিশু বা কিশোরের মানসিক সমস্যা আছে, তাদের প্রতি আলাদা গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এ ব্যাপারে বাবা-মা, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপযুক্ত সহযোগিতা থাকলে সমস্যা অনেকটাই মিটতে পারে। বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে বাচ্চার সুসম্পর্ক তার জীবনে এগিয়ে চলার পথে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শারীরিক-মানসিক বা যৌন উৎপীড়নের কোনও ঘটনা ঘটলে বা হঠাৎ করে বাচ্চার ব্যবহারে অস্বাভাবিকতা দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া দরকার।
গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, আত্মহত্যাকারী শতকরা প্রায় সত্তর ভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করার ইচ্ছে কারও না কারও কাছে প্রকাশ করেন। এমন কিছুর আভাস পেলে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং দরকার হলে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। যে এক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে, তার আত্মহত্যা করার প্রবণতাও বেশি। তাই সব সময়ে চোখে চোখে রাখা ভাল। সমস্যা অল্প মাত্রায় হলেও বিশেষজ্ঞের কাউন্সেলিং দরকার।
আর পরিশেষে বলি, অনেক সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যার খবর থেকে প্রভাবিত হয়েও অল্পবয়সিরা আত্মহত্যার চেষ্টা করে ফেলে। আত্মহত্যার বিশদ বিবরণে সমস্যা বাড়ে। তাই এ ধরনের খবর প্রকাশের সময়ে যথেষ্ট যত্নশীল হওয়া জরুরি।
লেখক: মনোরোগের চিকিৎসক, বাঁকুড়া সম্মিলনী মেডিক্যাল কলেজ