যে কাজ করিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ এ দেশের সরকার, দেশের সর্বোচ্চ আদালত অবশেষে তাহার দিকে তর্জনীনির্দেশ করিল। রাস্তায় এবং রেলগাড়িতে কী ভাবে শ্রমিকদের বাড়ি আসিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে, তাহার কিছু দিকনির্দেশ দিল। দেশের শাসনবিভাগ কি এতটুকুও লজ্জা বোধ করিতেছে? শ্রমিকদের ঘরে ফিরিবার জন্য যে স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা হইয়াছে, সেইটুকু দেখিলেই লজ্জার কারণ উপলব্ধ হয়। প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প ট্রেন বরাদ্দ। এক জায়গার ট্রেন অন্য জায়গায় গিয়া উপস্থিত। কী করিয়া ট্রেনে আসন মিলিবে, কবে মিলিবে, সে বিষয়ে স্বচ্ছতার কোনও বালাই নাই। ট্রেনে স্থান পাইবার আশায় স্টেশনে জড়ো হইয়া পুলিশের লাঠি জুটিতেছে শ্রমিকদের। সেই সঙ্গে উৎকোচ ও প্রতারণার শিকারও হইতেছেন তাঁহারা। টিকিটের টাকা সরকার দিবে, বিরোধী দল দিবে না কি যাত্রী স্বয়ং, সে বিষয়ে বিভ্রান্তিরও শেষ নাই। কতগুলি আসনে যাত্রী নেওয়া হইবে, রেল একাধিক বার তাহার বিধি বদলাইয়াছে। ট্রেন ছাড়িবার পর তাহার গতিপথ পরিবর্তন হইয়াছে। স্বাভাবিক সময়ের চাইতে তিন-চারগুণ দীর্ঘ হইয়াছে যাত্রা, অথচ পানীয় জল, খাবার মেলে নাই বহু ট্রেনে। ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা নাই, বিনা চিকিৎসায় যাত্রাপথে শিশুমৃত্যুও ঘটিয়াছে। ইহার চাইতে অধিক অব্যবস্থার কল্পনা করা কঠিন। লকডাউনের পূর্বে ভারতীয় রেল দিনে কয়েক সহস্র ট্রেন চালাইত। এখন অল্প কয়টি ট্রেন চালাইতে এত বিড়ম্বনা কেন? রেলকর্তাদের যুক্তি, অধিকাংশ ট্রেন চলিতেছে কয়েকটি নির্দিষ্ট পথে। পূর্ব ভারতের প্রধান স্টেশনগুলিতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিলম্ব হইতেছে। তাই অন্যান্য পথ ঘুরিয়া ট্রেন পাঠানো হইতেছে।
ইহাকে ব্যাখ্যা বলে না, বলে অজুহাত। এত দূর অব্যবস্থার কোনও ব্যাখ্যা থাকিতে পারে না। লকডাউন ঘোষিত হইবার পর এক মাসেরও অধিক সময় মিলিয়াছিল কেন্দ্র, রাজ্য ও রেলের হাতে। ফিরিতে ইচ্ছুক পরিযায়ী শ্রমিকরা কী উপায়ে ফিরিবেন, স্থির করিবার জন্য তাহা যথেষ্ট ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার কি পারিত না, এ বিষয়ে রাজ্যগুলির সহিত যোগাযোগ তৈরি করিয়া একটি নকশা বানাইতে? শ্রমিকরা ফিরিলে কোথায় ফিরিবে, ফিরিবার পর তাহারা কোথায় থাকিবে, যদি ট্রেনই তাহাদের ফিরিবার উপায় হয় তাহা হইলে কত ট্রেন প্রয়োজন, কোন রাজ্য কতগুলি ট্রেন গ্রহণ করিবে, কী শর্তে করিবে— এই সমস্ত স্থির করিতে? অথচ কোনও পরিকল্পনার নিদর্শন দেখা গেল না। বরং ক্রমাগত সিদ্ধান্ত বদল হইল। প্রথমে কেন্দ্র ও রাজ্যের সহমতের প্রস্তাব শোনা গেল। অতঃপর শোনা গেল, গন্তব্য রাজ্যের অনুমতির প্রয়োজন নাই। কেবল শ্রমিকদের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করিবার বিষয়ে অবহেলা নয়, সম্পূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে পরিস্ফুট এক প্রকাণ্ড প্রশাসনিক অদক্ষতা, বাস্তবজ্ঞানের সমূহ অভাব।
বস্তুত, করোনা-সঙ্কটকালের সর্ববৃহৎ প্রশাসনিক ব্যর্থতা হইয়া থাকিল শ্রমিক বিষয়ক অব্যবস্থা। প্রতি স্তরে যে ভাবে শ্রমিকদের অবজ্ঞা ও অবহেলা সহ্য করিতে হইল, তাহা ভারতীয় গণতন্ত্রের লজ্জা। যত শ্রমিক ট্রেনে আসন পাইয়াছেন, তাহার কয়েক গুণ বেশি যাত্রীতালিকায় নাম উঠাইতে ব্যর্থ হইয়াছেন। কবে ট্রেন মিলিবে, তাহাতে আসন মিলিবে কি না, জানিতে পারেন নাই। কেহ কয়েক শত কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটিয়া অতিক্রম করিয়াছেন। কেহ ট্রাকে কিংবা বাসে উদ্ভ্রান্তের মতো যে দিকে পারিয়াছেন যাত্রা করিয়াছেন। অবর্ণনীয় কষ্ট এবং সাধ্যাতীত অর্থব্যয়ে তাঁহারা ঘরে ফিরিতেছেন। অনেকের যাত্রা অর্ধপথেই থামিয়াছে। ট্রেনের ব্যবস্থা যদি হইলই, আর একটু আগে হইলে বহু প্রাণ বাঁচিয়া যাইতে পারিত। শ্রমিক ট্রেন ভারতীয় রেলের ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায় হইয়া থাকিল।