মুখ খোলার উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় থাকা একটি রণকৌশল

এই প্রতিবাদ বাড়াবাড়ি বুঝি?

স্থান কাল পাত্র বদলে নিলে উপরের গল্প থেকে মিটু-র দূরত্ব বেশি নয়! অথচ এই গল্পটার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর মিটু-র প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কি এক? এত দিন পরে কেন, প্রমাণ কই, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার কাছ থেকেই তো সুবিধা নেওয়া হয়েছে, এ বার মওকা বুঝে যে যা খুশি বলে দেবে...।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৮ ০০:১০
Share:

একদা এক গ্রামে এক জমিদার ছিলেন। খুব অত্যাচারী। প্রজারা তাও মুখ বুজে থাকত। প্রতিবাদ করলে লেঠেলরা মারবে, জমিজিরেত যেটুকু আছে কেড়ে নেবে। চণ্ডীমণ্ডপের মাতব্বররাও সবাই জমিদারের অনুগ্রহভোগী। তারা কিচ্ছুটি বলবে না। সে বার ভাল বৃষ্টি হয়নি। খাজনা দিতে প্রাণান্ত হচ্ছে। এক চাষি মুখ ফুটে বলতে গিয়ে বেধড়ক মার খেয়ে গেল। কিন্তু বাড়ি বসে থাকলে তো চলবে না। সেই আবার মাঠে যেতে হল। পালাপার্বণে জো হুজুর বলে জমিদারের কাছেই গিয়ে দাঁড়াতে হল। এমনি করে বেশ অনেক বছর কেটে গেছে। এক দিন হাটে গিয়ে সে শোনে, পাশের গাঁয়ে প্রজারা নাকি বিদ্রোহ শুরু করেছে। পুরনো সব কথা নতুন করে মনে পড়ে গেল তার। জমিদার নির্দিষ্ট দিনে মন্দিরে পুজো দিতে যান একা। চাষি গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। ফাঁক পেলেই বসিয়ে দেবে লাঠির বাড়ি...

Advertisement

স্থান কাল পাত্র বদলে নিলে উপরের গল্প থেকে মিটু-র দূরত্ব বেশি নয়! অথচ এই গল্পটার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আর মিটু-র প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কি এক? এত দিন পরে কেন, প্রমাণ কই, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার কাছ থেকেই তো সুবিধা নেওয়া হয়েছে, এ বার মওকা বুঝে যে যা খুশি বলে দেবে...।

প্রশ্ন, সংশয় সবই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। কিন্তু সঙ্গে উত্তর খোঁজার সদিচ্ছাটা থাকা চাই।

Advertisement

এই মুহূর্তে একটি প্রশ্নকেই সকলে ব্রহ্মাস্ত্র ঠাহরেছেন: ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’ অথচ চোখ থাকলেই দেখতে পেতেন, যে ক’টা অভিযোগ এখনও অবধি সামনে এসেছে, তার মধ্যেই বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে যেখানে ‘ভিকটিম’ আগে মুখ খুলেছেন, কিন্তু ফল হয়নি। বিনতা নন্দা-ই যেমন অলোক নাথের বিরুদ্ধে আগেও বলেছেন, এই ঝড় তখন ওঠেনি। বাকিদের অনেকের জন্যই এত দিন চুপ থাকার প্রথম এবং প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, মুখ খুলে কোনও লাভ হবে বলে তাঁরা মনে করেননি, বরং ক্ষতির আশঙ্কাই ছিল বেশি। কারণ যাঁদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হত, তাঁরা সকলেই ক্ষমতাবান, প্রভাবশালী। এখনও যে লক্ষ লক্ষ মহিলা মুখ খুলছেন না, তার কারণও সেটাই। আজ যাঁরা সরব হয়েছেন, তাঁদের বেশির ভাগই এখন আর অভিযুক্তের সঙ্গে কোনও রকম পেশাগত সম্পর্কে জড়িত নন। সেই নিরাপদ দূরত্বটি অর্জন করেছেন বলেই তাঁরা মুখ খুলতে পারছেন। কেন তাঁরা এই দূরত্বটির জন্য অপেক্ষা করলেন বলে গাল পাড়া মানে আত্মরক্ষার মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা। উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় থাকা একটি রণকৌশল, তাতে লজ্জার কিছু নেই। আর ইতিহাসের গতিতে কোন মুহূর্তটি কোন উতরোলে ফেটে পড়বে, তা অঙ্ক কষে বলা যায় না। ষোড়শ লুইয়ের আমলে ফরাসি বিপ্লব হল কেন, চতুর্দশ লুই-এর সময় সেই বিপ্লব না হওয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে, এমন কথা কেউ বলে না।

আশির দশকের শেষে রূপান বাজাজ যখন কে পি এস গিলের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন, তখন আলোড়ন হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু কোনও মিটু জন্ম নেয়নি। সেই জমি তখন তৈরি ছিল না। অভিযুক্ত হওয়ার পরের বছর গিল পদ্ম-সম্মান পেয়েছিলেন। রুচিকা গিরহোত্র মামলায় দোষী সাব্যস্ত পুলিশ অফিসার এস পি এস রাঠৌর এই সে দিনও সরকারি অনুষ্ঠানের মঞ্চে আসীন ছিলেন। যে দেশের ঐতিহ্য এই, সেখানে কেন তোমরা দ্রুত মুখ খোলোনি, কেন তোমরা থানা-পুলিশ করছ না, কেন রাঘব বোয়ালদের নাম বলছ না— এই সব প্রশ্ন ছোড়াটা একাধারে মূঢ়তা এবং নির্মমতা। মেয়েরা নিজেরাই কাজের জায়গায় যৌন আবেদনকে ব্যবহার করেন এবং সম্মতির ভিত্তিতে রচিত সম্পর্ককে স্বার্থ ফুরোলে নিগ্রহ বলে চালিয়ে দেন— এই তত্ত্বও শোনা যাচ্ছে বারংবার। তত্ত্বপ্রণেতারা ভুলে যাচ্ছেন, তাঁদের বক্তব্যটি আদতে লিঙ্গসম্পর্কের কাহিনিতেই একটি বাড়তি পরত যোগ করছে, ক্ষমতার খেলাকে আরও স্পষ্ট করে চেনাচ্ছে। তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করে ফেলছেন, কর্মক্ষেত্রে যৌনতার বেসাতি অতি প্রচলিত ঘটনা। সেখানে মেয়েরা প্রায়শই বুঝে যান, বস-এর মনোরঞ্জন করতে না পারলে উন্নতি করা শক্ত, আর পারলে খুব সহজ। তার পর তাঁরা স্বেচ্ছায় অথবা বাধ্য হয়ে শর্টকাটটি বেছে নেন। একে সম্মতি না বলে সম্মতির চুক্তি বলাই ঠিক। সামগ্রিক ভাবে এই সিস্টেমটিকে প্রশ্ন না করে শুধু মেয়েদের সুযোগসন্ধানী বলাটা ঠিক কি?

সেই সঙ্গে নিগ্রহের সাক্ষ্যপ্রমাণ কই বলে যাঁরা হাঁপিয়ে উঠছেন, তাঁদের জানিয়ে রাখা যাক, সাক্ষী রেখে নিগ্রহ কেউ করে না বড় একটা। একটা রটনা চালু আছে, আইন শুধু মেয়েদের কথাই শোনে! কথাটা একটি বিকৃতিমাত্র। অভিযোগকারিণীকে প্রাথমিক ভাবে বিশ্বাস করতে বলার অর্থ চোখ বুজে মেনে নেওয়া নয়। অভিযোগ ঠিক ধরে তদন্ত শুরু করা। তাতে যদি অভিযোগ অপ্রমাণ হয়, তা হলে তা-ই। আর যৌন নিগ্রহ মায় ধর্ষণের ক্ষেত্রেও সুপ্রিম কোর্ট একটা কথা বার বার বলে। সাক্ষ্যপ্রমাণের চেয়েও দামি হল অভিযোগকারিণীর বয়ান। তার মানে কি যে কোনও বয়ান অভ্রান্ত বলে ধরা হবে? না। তার মানে হল, বয়ানকে অনুপুঙ্খ বিচার করে তার অন্তর্নিহিত অসঙ্গতি বা সঙ্গতির হদিস পাওয়া যাবে। সেটাই আইন-আদালতের কাজ।

এ বার আসি ভুয়ো অভিযোগের কথায়। মানুষী দোষগুণ যত প্রকার হতে পারে, তা যেমন ছেলেদের মধ্যে আছে, তেমনই মেয়েদের মধ্যে আছে। তৃতীয় লিঙ্গের মধ্যেও আছে। এটাকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে দেখতে শিখলেই অনেক ল্যাঠা চুকে যায়। ধান্দাবাজি, স্বজনপোষণ, মিথ্যাভাষণ, হাওয়া বুঝে শিবির বাছা এবং বদল করা— মেয়েদের মধ্যে সবই আছে। মেয়েরা(ও) তো মানুষ! ফলে মিটু আন্দোলনে বেনোজলের সম্ভাবনা ততটাই, যতটা অন্যত্র। অথচ আশঙ্কার বহর দেখে মনে হচ্ছে, মিটু-র আগে কোনও দিন ভুয়ো অভিযোগ হয়নি আর মিটু বন্ধ হয়ে গেলে কোনও দিন হবেও না! নারী আন্দোলনের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁরাও কাঁটা হয়ে আছেন। তাঁরা জানেন, দু’একটা ভুয়োই যথেষ্ট! সেই ধাক্কায় অন্য অগুনতি অভিযোগ গণ-অবিশ্বাসের স্রোতে ভেসে যাবে!

ঘটনা হল, পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও আন্দোলন সর্বাংশে ত্রুটিমুক্ত, বেনোজলমুক্ত থাকেনি। মিটু-ও নয়। সেটা বাঞ্ছনীয় না হোক, স্বাভাবিক বটে। এ কথা বলা মানে বেনোজলকে বৈধতা দেওয়া নয়। কিন্তু বেনোজলের ধুয়ো তুলে একটা আন্দোলনকে ‘ওয়াক থু’ করতে চাওয়াটাও সমর্থনযোগ্য নয়।

ভুয়ো-ভীতরা বলছেন, মেয়েগুলো মিটু না করে এত দিন ঠিকঠাক কাউন্টারে নালিশ ঠোকেনি কেন! জগৎ ও জীবনের জটিলতা সম্পর্কে তাঁদের এই সারল্যপ্রসূত অজ্ঞতা দেখে জানতে ইচ্ছে করে, এঁরা কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে, আজ যাঁরা মুখ খুলেছেন তাঁদের কত জন অভিযোগ জানাতে গিয়ে অপমানের শিকার হয়েছেন? কত জনকে তাঁর পাশের লোকেরাই হাতেপায়ে ধরে বলেছেন, অভিযোগ করে ঝামেলা বাড়িয়ো না? কত জন অভিযোগ করতে চেয়েও করতে পারেননি এই বাধ্যবাধকতায় যে, কাজটা তাঁর বড় প্রয়োজন! কত জন কুঁকড়ে গিয়েছেন এই ভেবে যে তাঁকে কেউ বিশ্বাস করবে না, উল্টে চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠবে? মেয়েদের জীবনে যৌন নিগ্রহ যেন কলেজের র‌্যাগিং, যার সম্পর্কে দীর্ঘ দিন যাবৎ বলা হত— ওটাই নাকি জীবনসংগ্রামের প্রশিক্ষণ! তফাত একটাই— কলেজের র‌্যাগিংটা ফার্স্ট ইয়ার পেরোলে শেষ হয়, যৌন র‌্যাগিং অনাদি অনন্ত!

অতি সতর্কতার আর একটা রূপ এ প্রসঙ্গেই চোখে পড়ছে। পাছে ভিকটিম/ সারভাইভার বললে দুর্বল শোনায়, এই ভয়ে নিজেদের জাহির করার অতিরিক্ত দায়িত্বও নিয়ে ফেলছেন অনেকে! কেউ বলছেন, আমার দিকে এগোলেই জুজুৎসু হাঁকড়ে দিই! কেউ বলছেন, আমার এমন লৌহকঠিন ব্যক্তিত্ব যে সবাই ল্যাজ গুটিয়ে পালায়! হেনস্থা? ফুঃ ও সব নিয়ে প্যানপ্যান করার বান্দাই নই!

উত্তরে একটাই কথা— দুর্ভাগা সে দেশ যেখানে শুধুই বীরাঙ্গনার প্রয়োজন হয়! যাঁর মনে হচ্ছে, যৌন হেনস্থার মোকাবিলা করা কোনও ব্যাপারই নয়, তিনি নমস্য নিঃসন্দেহে! কিন্তু বাকিদের কমজোরি ভাবার অধিকার তাঁকে কে দিল? ‘আমরাও তো এ সব সামাল দিয়েই দিব্যি এগিয়েছি’, এই জাতীয় কথা শুনলে বড় ধাঁধা লাগে। রাস্তা ভাঙা থাকলে লাফিয়ে-ডিঙিয়ে চলা অভ্যেস হয়ে যায়। কিন্তু রাস্তা আদৌ ভাঙা থাকবে কেন, সেই প্রশ্নটা উঠবে না? রাস্তা মেরামতির দাবিতে অনেকে একজোট হচ্ছে দেখলে ‘আগে কী সুন্দর গর্ত ডিঙাইতাম’ বলে গান ধরব?

মানি বা না মানি, মিটু একটা টেকটনিক প্লেট নাড়িয়ে দিয়েছে। যা ছিল পৌরুষের বাহাদুরি, আজ তা সামাজিক অপমান হয়ে ধেয়ে আসছে! মিটু আন্দোলন-পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, আছেও। কিন্তু নদীতে ক্রমাগত বাঁধ দিলে তা এক দিন ঘরবাড়ি ভাসাবেই। সেটা নদীর দোষ নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement