Bengali News

শবরীমালা: এক দুর্ভাগ্যজনক প্রশ্নের সামনে আমরা

অত্যন্ত আশ্চর্য হতে হচ্ছে দেশের পরিস্থিতি দেখে। ১৮২৯ সালের ভারতেও সতীদাহের মতো প্রথা রদ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আজ একবিংশ শতকের ভারতে একটা মন্দিরে প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত বৈষম্য দূর করা যাচ্ছে না কিছুতেই।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:৫৩
Share:

আজ গোটা দেশের নজর থাকবে শবরীমালা পাহাড়ের দিকে। ফাইল চিত্র।

শবরীমালা পর্বত থেকে কোনও শুভ সঙ্কেত এখনও এসে পৌঁছল না। আজ এক দিনের জন্য খুলছে আয়াপ্পা স্বামীর মন্দিরের দরজা। তার আগে ফের যুযুধান কট্টরবাদী আয়াপ্পা ভক্তরা এবং কেরলের প্রশাসন। এক দিকে কট্টরবাদী হিন্দু সংগঠনগুলোর উদ্যোগে গোঁড়া ভক্তরা সমাগম শুরু করেছেন পর্বতের বাঁকে বাঁকে। ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সের কোনও নারীকে শবরীমালা পর্বতের চূড়ায় পৌঁছতে না দেওয়ার লক্ষ্যে বদ্ধপরিকর তাঁরা। উল্টোদিকে বদ্ধপরিকর কেরলের পুলিশ-প্রশাসন। কঠোর নিরাপত্তায় মুড়ে দেওয়া হচ্ছে মন্দিরে পৌঁছনোর পথ, লিঙ্গ এবং বয়স নির্বিশেষে সব ভক্তকে শবরীমালার চূড়ায় পৌঁছনোর পথ করে দিতে সঙ্কল্পবদ্ধ হচ্ছে প্রশাসন। বলাই বাহুল্য, এই পরিস্থিতি কোনও শুভ সঙ্কেত দেয় না। দেয় প্রবল সঙ্ঘাতের আভাস।

Advertisement

কট্টরবাদ তথা গোঁড়ামির চশমা পরে দেখলে কোনটা শুভ সঙ্কেত আর কোনটা অশুভ ঠেকবে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু আইন-কানুন, সংবিধান, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এই পরিস্থিতি মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। দেশে আইনের শাসন থাকবে কি না, তা নিয়ে খুব বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি করছে শবরীমালাকে ঘিরে ঘনীভূত হওয়া অশান্তির মেঘ। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছে যে, শবরীমালার মন্দিরে প্রবেশাধিকার দিতে হবে সব বয়সের নারীকে। এর পরে আর কোনও কথা চলে না। আইনের শাসন বহাল রাখাটা যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়, তা হলে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করা অত্যন্ত জরুরি। কেরলের প্রশাসন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালন করতে সচেষ্ট। কিন্তু বিভিন্ন প্রভাবশালী সংগঠন এবং দেশের প্রধান শাসকদল যে ভাবে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করছে, যে ভাবে তারা এক উদভ্রান্ত জনাবেগকে প্ররোচিত করছে, তাতে পুলিশ-প্রশাসনের কাজটা অনেক বেশি কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

হিন্দু ধর্মে রীতিনীতি সংক্রান্ত সংস্কারের চেষ্টা এই প্রথম হচ্ছে, এমন নয়। ১৮২৯ সালে রাজা রামমোহন রায় এক ভীষণ সংগ্রামে জয় পেয়েছিলেন। মূলত তাঁর চেষ্টাতেই ব্রিটিশ সরকার সতীদাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বর্তমানের বিশ্বায়িত জগতের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল সে দিনের পৃথিবীটা। গোঁড়ামি, কুসংস্কার অন্ধবিশ্বাস অনেক বেশি ছিল। এ সব বিষয়ে সমাজের এক বিরাট অংশের মানসিকতা বেশ অনুদার ছিল। এত কিছু সত্ত্বেও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সতীদাহ প্রথা রদ হয়েছিল। কিন্তু আজ পরিস্থিতি একদম অন্য রকম। সমৃদ্ধশালী গণতন্ত্র হিসেবে গোটা বিশ্বে পরিচিত ভারত আজ মহাসাংবিধানিক সঙ্কটে। দেশের সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, শবরীমালার মন্দিরে ঢুকতে দিতে হবে সব বয়সের নারীকে। কিন্তু দেশের জনসংখ্যার একাংশ সে রায়ের বিরোধিতা করছে এবং দেশের প্রধান শাসকদল-সহ বিভিন্ন সংগঠন অদ্ভুত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়ে প্রকাশ্যে এবং সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করছে। ফলে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ এখনও রূপায়িত হয়নি। আজ যখন মন্দির খুলছে, তখনও সে নির্দেশ রূপায়িত হবে কি না, তা নিশ্চিত করা যায়নি।

Advertisement

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

অত্যন্ত আশ্চর্য হতে হচ্ছে দেশের পরিস্থিতি দেখে। ১৮২৯ সালের ভারতেও সতীদাহের মতো প্রথা রদ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। আজ একবিংশ শতকের ভারতে একটা মন্দিরে প্রবেশাধিকার সংক্রান্ত বৈষম্য দূর করা যাচ্ছে না কিছুতেই। সুপ্রিম কোর্টের শবরীমালা রায়ের পর থেকে আয়াপ্পা স্বামীর যে ভক্তরা বার বার হইহই করে পথে নামছেন ঋতুযোগ্য মহিলাদের মন্দির প্রবেশ আটকাতে, তাঁরা তো আইন ভাঙছেনই। কিন্তু আরও বেশি বিচলিত হতে হচ্ছে দেশের প্রধান শাসকদলকে দেখে। আইন বা সংবিধানের তোয়াক্কা না করে, যে ভাবে প্রকাশ্যে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা শুরু করেছেন বিজেপি নেতারা, তেমন পরিস্থিতি এ দেশ আগে দেখেছে কি না, তা নিয়ে সংশয় বিস্তর।

আরও পড়ুন: মহিলা সাংবাদিক পাঠাবেন না, শবরীমালায় সংবাদমাধ্যমকে হুঁশিয়ারি ‘হিন্দুত্ববাদী’দের

যে কোনও মূল্যে ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সের নারীর মন্দির প্রবেশ আটকাতে বদ্ধপরিকর এক দল লোক। শবরীমালা পাহাড়ে তাঁরা কিছুতেই পৌঁছতে দেবেন না ঋতুযোগ্য নারীকে। সংবাদমাধ্যমকেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আয়াপ্পার এই তথাকথিত ভক্তরা। ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে বয়স যে মহিলা সাংবাদিকদের, তাঁদেরও যেন পাঠানো না হয় শবরীমালার পরিস্থিতি দেখতে— এমনই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন আগে কখনও হয়নি ভারত। এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের মুখে দেশ। আজ গোটা দেশের নজর থাকবে শবরীমালা পাহাড়ের দিকে। রাষ্ট্রীয় কাঠামো সফল হবে, না কি এক দল বিভ্রান্ত নাগরিকের অবান্তর প্রতিরোধ, তার উত্তর আজই মিলবে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর ভারতে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নটার সম্মুখীন হওয়াই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement