দ্বিশতবর্ষের লজ্জা

নারীশিক্ষার অবস্থা করুণতর। সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০.৫%। অথচ, নারীশিক্ষারই পথিকৃৎ ছিলেন বিদ্যাসাগর। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের তীব্র বাধা সত্ত্বেও পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় গড়িয়া তোলেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:১৭
Share:

একশত-য় পৌঁছাইতে গেলে যে দুইশত বৎসরও কম পড়িয়া যায়, মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রাম তাহার প্রমাণ। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকীর আড়ম্বরের আড়াল হইতে উঁকি দিতেছে এই তথ্য যে, বীরসিংহ এখনও পূর্ণ সাক্ষর নহে। সাক্ষরতার হার ৯৪ শতাংশ। বামেরা কটাক্ষ করিয়াছে, তাহাদের আমলেই তো বীরসিংহ ৯৪ শতাংশে পৌঁছাইয়াছিল। বিমান বসুরা অবশ্য বলেন নাই, বাম শাসনেই কেরল প্রায় পূর্ণ সাক্ষর রাজ্য হইয়া উঠিতে পারিলেও পশ্চিমবঙ্গ পারিল না কাহার দোষে? চৌত্রিশ বৎসরও কি কম পড়িয়াছিল? বস্তুত, কমিউনিস্ট পার্টি নামে পরিচিত একটি দল তিন দশকের উপর একটানা কোনও দেশ বা প্রদেশ শাসন করিয়াছে এবং সেই দেশ বা প্রদেশ পূর্ণ সাক্ষর হয় নাই— এমন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে একটিই আছে, তাহা বামফ্রন্টের পশ্চিমবঙ্গ।

Advertisement

নারীশিক্ষার অবস্থা করুণতর। সাক্ষরতার হার মাত্র ৭০.৫%। অথচ, নারীশিক্ষারই পথিকৃৎ ছিলেন বিদ্যাসাগর। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের তীব্র বাধা সত্ত্বেও পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় গড়িয়া তোলেন। সমাজের নিকট পৌঁছাইয়া দেন মনুসংহিতার সেই মহামন্ত্র— কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ। অর্থাৎ, কন্যাকেও যত্নের সঙ্গে পালন করিতে হইবে, শিক্ষা দিতে হইবে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর পশ্চিমবঙ্গ দেখিল, নাবালিকা বিবাহ, নাবালিকার সন্তানধারণ, মেয়েদের নিরক্ষরতা এবং স্কুলছুট হইবার ধারা এখনও সমাজে প্রচলিত। সংখ্যা হয়তো কমিয়াছে, তবে এত দিনেও নির্মূল হয় নাই! বিদ্যালয়ে মেয়েদের নাম লিখাইবার প্রচলন বাড়িয়াছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত স্কুলের গণ্ডি পার না করিবার সংখ্যাও বিস্তর। শিক্ষা তো শুধুমাত্র বিদ্যালয়ে যাওয়া এবং নাম সহি করিতে পারার মধ্যে আবদ্ধ নহে। প্রকৃত সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা যাহাকে বলে, মেয়েরা এখনও তাহা পায় না। শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্যও প্রকট। পাঠ সম্পূর্ণ করিবার পরিবর্তে সংসারের কাজে বাড়ির মেয়েটিকে অধিক প্রয়োজন। অথচ রাজ্য সরকার উদাসীন। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করিয়াছেন, আগামী দিনে বাংলার মেয়েরা পথ দেখাইবে। নিশ্চয়ই, কিন্তু তাহার জন্য প্রয়োজন নারীর ক্ষমতায়নের। স্ত্রীশিক্ষার হারে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ভিন্ন তাহা অসম্ভব।

সার্বিক ভাবে রাজ্যের স্কুলশিক্ষার হালও জরাজীর্ণ। পরিকাঠামোগত দিক হইতে সরকারি বিদ্যালয়গুলি ধুঁকিতেছে। কোথাও শিক্ষক নাই, কোথাও পড়ুয়া নাই, কোথাও ক্লাসঘর নাই। খাস কলিকাতায় বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত বড়বাজারের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট স্কুল পরিকাঠামোগত সমস্যার কারণে বন্ধ হইয়াছে। অনেক বিদ্যালয়েই লেখাপড়ার কাজটি কোনও ক্রমে চলিলেও শিশুর যথার্থ মানসিক বিকাশ হয় না। নজরদারিরও চূড়ান্ত অভাব। বিদ্যালয়গুলি সার্থক ভাবে প্রমাণ করিয়াছে, বিদ্যালয় শুধুমাত্র পরীক্ষা লইবার জায়গা। লেখাপড়া শিখিতে হইলে প্রাইভেট টিউশনই শিক্ষার্থীর একমাত্র ভরসা। অথচ বিদ্যাসাগর স্বয়ং ইহার বিপরীতে হাঁটিয়াছিলেন। গৃহশিক্ষার ধারার পরিবর্তে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপর জোর দেন। দেখাইয়া দেন আদর্শ বিদ্যালয় কেমন হওয়া উচিত। বিদ্যালয় সেখানে প্রকৃত অর্থেই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। অথচ সেই পথে তাঁহারই রাজ্যের মানুষ হাঁটিতে অসমর্থ। বাঙালি এক জন বিদ্যাসাগরকে পাইয়াছিল, তাহা সত্ত্বেও সমাজ, শিক্ষায় আমূল সংস্কার হইল না, ইহার অপেক্ষা দুর্ভাগ্য আর কী হইতে পারে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement