Delhi Violence

প্রথম শর্ত

ভারতীয় নাগরিক সমাজ এই ক্ষেত্রে ১৭৯১ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর কথাগুলি মনে রাখিতে পারে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২০ ০০:১৮
Share:

ছবি এপি।

নূতন নাগরিকত্ব আইনটি যতখানি সমস্যাজনক, সেই আইনের বিরুদ্ধে নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার কাড়িয়া লওয়া উহা অপেক্ষা কম বিপজ্জনক নহে। গণতান্ত্রিক দেশে আইন প্রণয়ন যেমন জননির্বাচিত সরকারের সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার, বাক্‌স্বাধীনতাও নাগরিকের বিতর্কোর্ধ্ব সাংবিধানিক অধিকার। যে কোনও আইন বিষয়ে সমালোচনার অধিকারও ইহার মধ্যে পড়ে, সরকার এবং সরকারি নেতাদের সমালোচনার অধিকারও। শিলচরের শিক্ষক সৌরদীপ সেনগুপ্তকে যে ভাবে গ্রেফতার করা হইল, তাহাতে এই প্রশ্ন আবারও জরুরি হইয়া উঠিতেছে। দিল্লির গণনিধন লইয়া গণমাধ্যমে মন্তব্য করিয়াছিলেন সৌরদীপ। অভিযোগ যে, তাহার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য ছিল। প্রথমত, অবমাননা বিষয়টির সংজ্ঞা কখনওই প্রসঙ্গ-নিরপেক্ষ নহে। দ্বিতীয়ত, নেতার বিরুদ্ধে সমালোচনামূলক মন্তব্য করা যাইবে না, তাহা ঠিক নহে। তৃতীয়ত, সৌরদীপ ঘটনার জন্য ক্ষমা স্বীকার করিয়াছেন। এবং চতুর্থত, মন্ত্রী বা নেতা বিষয়ে কোনও অভদ্র বা অন্যায় মন্তব্য শুনিলেই মন্তব্যকারীকে গ্রেফতার করিতে হইবে, আইন এমন বলে না। জাতীয় নিরাপত্তার হানির আশঙ্কা এখানে প্রাসঙ্গিক কি না, ভাবিয়া দেখিবার অবকাশ আছে। সৌরদীপের মন্তব্যে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইতে পারে, সরকার-পক্ষে যদিও এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হইয়াছে, কিন্তু কোনও নাগরিকের একটি ‘অবমাননাকর’ মন্তব্যে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কতখানি বিঘ্নিত হওয়া সম্ভব, সে বিষয়ে বিতর্ক চলিতে পারে বইকি। নাগরিকের মুখ বন্ধ করিয়া তাঁহাকে গ্রেফতার করিবার আগে এই সব জরুরি বিবেচনা থাকিবার কথা। কেবল সৌরদীপ কেন। কাশ্মীর হইতে অসম, দেশের নানা স্থলে সাংবাদিক ও নাগরিকদের ভয় দেখাইবার পদ্ধতি হিসাবে যে গ্রেফতাির চলিতেছে, তাহা চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক।

Advertisement

সোজা কথা, কত দূর অবধি মতপ্রকাশ গণতান্ত্রিক এবং কিসের পরে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হইবার ভয় আছে, ইহা লইয়া তর্ক না চালাইতে পারিলে স্বৈরাচারী শাসক উহাকে একপাক্ষিক ভাবে হাতিয়ার করিবেই। উল্লেখ্য, সমরূপ মামলায় অসমের কারারুদ্ধ কংগ্রেস কর্মীর জামিন মঞ্জুর হইয়াছে। বিচারবিভাগ নিশ্চয়ই নিজের দায়িত্ব পালন করিবে। কিন্তু শাসনবিভাগকেও সীমারেখাটি মানিয়া চলিতে হইবে। সরকার ভ্রান্ত পথে চালিত হইলে বিরোধী দলগুলির কাজ, আপত্তি তোলা। কিন্তু সাম্প্রতিক ভারতে বিরোধী দলগুলি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে অসক্রিয়। সিএএ বিরোধী আন্দোলনে তাহাদের উপস্থিতি এতই ক্ষীণ, যে তাহারা জীবন্ত কি না ইহাই ঠাহর করা যায় না। নাগরিক সমাজই আন্দোলন পরিচালনা করিতেছে। অতএব বাড়তি দায়িত্ব তাহাদেরই লইতে হইবে।

ভারতীয় নাগরিক সমাজ এই ক্ষেত্রে ১৭৯১ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর কথাগুলি মনে রাখিতে পারে। ‘ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট’ বলিয়াছিল, আইন রচনা সরকারের দায়িত্ব হইলেও বিশেষ কিছু বিষয়ে তাহারা কখনওই আইন প্রণয়ন করিতে পারে না। বিষয়গুলি হইল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়ন্ত্রণ, স্বাধীন ধর্মাচরণে বাধাদান, বাক্‌স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার ও ক্ষোভ মিটাইতে সরকারের নিকট আবেদন করিবার অধিকার হরণ। যে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে অনুসরণ করিয়া বহু গণতন্ত্রের রূপরেখা রচিত, তাহার ভিত্তি এই স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার। গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত। এই ব্যবস্থার সমস্যাও রহিয়াছে: বাক্‌স্বাধীনতার যুক্তিতেই আমেরিকায় ‘হেট স্পিচ’ বা বিদ্বেষ ও উস্কানিমূলক উক্তির বাড়বাড়ন্ত। তবু, সীমা অতিক্রমের ভয় সত্ত্বেও গণতন্ত্রের মৌলিকতম শর্তটি বিস্মৃত হইলে চলিবে না। নাগরিকত্ব লইয়া যে আন্দোলন ও প্রতিবাদ উৎসারিত হইতেছে, নাগরিকত্বের এই প্রথম শর্ত তাহার সম্মুখভাগে আসা জরুরি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement