চুরি যাচ্ছে আমাদের সবার তথ্য। আর সেই দিয়ে কষা হচ্ছে হিসেব, ভোটের ফলাফলের। এই নিয়ে সম্প্রতি ডিজিটাল দুনিয়া তোলপাড় হয়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আট কোটি সত্তর লক্ষ নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নিয়ে সেই তথ্যে প্রভাবিত করা হয়েছে সে দেশের ২০১৬-র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনী প্রচার। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েই নাকি হোয়াইট হাউস দখল করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
২০১৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী আলেক্সান্দর কোগান সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজমাধ্যমে দিয়েছিলেন পার্সোনালিটি কুইজ় অ্যাপ: দিস ইজ় ইয়োর ডিজিটাল লাইফ। ২ লক্ষ ৭০ হাজার ডাউনলোড-এর রেকর্ড। ব্যবহারকারীরা নিজেদের যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য, কোনও বিষয়ে ভাল-মন্দ লাগা, রাজনৈতিক ও সামাজিক মতামত প্রভৃতি জানিয়েছিলেন অ্যাপটিতে। যেমন আপনি ফেসবুক খুললে দেখবেন: আনসার অ্যান আইস ব্রেকিং কোয়েশ্চেন অ্যান্ড শেয়ার সামথিং ফান অ্যাবাউট ইয়োরসেল্ফ। আপনার ব্যাপারে বিশদ জানতে চেয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন। আপনিও একের পর এক উত্তর দিয়ে চলেছেন বেমালুম। ‘দিস ইজ় ইয়োর ডিজিটাল লাইফ’ অ্যাপটাও অনেকটা সে রকম।
শুধু ব্যবহারকারীর তথ্যই নয়, তালিকায় থাকা সমস্ত বন্ধু ও বন্ধুর বন্ধুদের তথ্য সংগ্রহ করে তৈরি হয়েছিল এক বিশাল তথ্যভাণ্ডার। মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে সেই বিপুল তথ্যের চাঁই বেচে দেওয়া হয়েছিল একটি সংস্থাকে। তারা এক উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে তৈরি করে জনসাধারণের ‘সাইকোগ্রাফিক প্রোফাইলিং’ বা মানসিক প্রবণতার রূপরেখা। সংস্থার প্ৰাক্তন কর্মী এবং তথ্য চুরি ফাঁস করে দেওয়ার মূল পান্ডা খোলসা করেছেন, ব্যক্তির অজান্তে তাঁর তথ্য নিয়ে তাঁর ব্যক্তিত্বের ব্যবহারে পরিবর্তন ঘটিয়ে মক্কেলকে নির্বাচনের বৈতরণি উতরে দেওয়া বা বিকল্প কোনও উপায়ে লাভবান করানোই সংস্থাটির মূল কাজ। আর এই কাজ তারা করে মোটা অর্থের বিনিময়ে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিদ্যার এক প্রাক্তন অধ্যাপক পদ্ধতিটির নাম দিয়েছেন ‘সার্ভেলান্স ক্যাপিটালিজ়ম’। পদ্ধতিটা কেমন? ভোটারদের পছন্দ, চাহিদা, ভীতি, আশঙ্কা, মতাদর্শের ভিত্তিতে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীতে ভাগ করা হয়। এক একটা গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ‘কাস্টমাইজ়ড অ্যাড’ বা পছন্দের বিজ্ঞাপন তাঁদের মোবাইল ফোনে এসএমএসের মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচার করা হয়। সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে যে রাজনৈতিক প্রার্থী বা দলের গাঁটছড়া তৈরি হয়, ক্রমশ মানুষকে নানা প্রলোভনের মাধ্যমে সেই রাজনৈতিক চিহ্নের প্রতি আনুগত্য তৈরি করাতে উঠে পড়ে লাগে সংস্থাটি। বিশেষত ‘সুইং’ বা ‘ফ্লোটিং’ ভোটারদের আয়ত্তে নিয়ে নেয়, যার প্রতিফলন ঘটে ভোটের ফলাফলে।
শুধু অতলান্তিকের ও পারে নয়, আরব সাগরের এ পারেও হইচই। এক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ৫ লক্ষ ৬২ হাজার ভারতীয় নাগরিকের তথ্যও লোপাট হয়েছে। ভারতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দল, বিজেপি ও কংগ্রেসের মধ্যে তথ্য লোপাটকে কেন্দ্র করে বাধে তুমুল কাজিয়া। অনেকেরই আশঙ্কা, নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য ২০১৯-এ লোকসভা ভোটের ফলাফলের ভোল আমূল বদলে দিতে পারে।
দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কিছু দেশেই— যেমন পাকিস্তান, নেপাল, তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, মরিশাস ও মালয়েশিয়া— ডিজিটাল দুনিয়ার তথ্য ব্যবহার করে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠেছে।
নির্বাচন এখন অনেকটাই তথ্যসর্বস্ব, ‘বিগ ডেটা’র উপর নির্ভরশীল। আমার আপনার ব্যক্তিগত তথ্য, যা আমরা ইন্টারনেটে ঢালাও বিলিয়ে রেখেছি। এই তথ্যই নির্ধারণ করছে দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং তার ফলাফল। এবং ভবিষ্যতে আরও বড় আকারে করবে। ইন্টারনেটের গতিপ্রকৃতিও দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিপুল তথ্যের ভিড়ে। দাভোস-এ ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম ২০১৮-র সম্মেলনে ইতিহাসবিদ জ়ুবাল নোয়া হারারি বলেই দিলেন, আমরা বসবাস করছি ‘ডিজিটাল ডিক্টেটরশিপ’-এর যুগে। রাষ্ট্রপুঞ্জের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিশেষ সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন্স ইউনিয়ন (আইটিইউ)-এর ওয়েবসাইটে ২০১৭ ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়, ভারতে ‘সর্বাধিক সক্রিয়’ স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা দিনে চার ঘণ্টা সময় কাটান বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনে। ২০১৭ সালে ভারতীয়রা সামগ্রিক ভাবে অ্যান্ড্রয়েড ডিভাইসে ১৪৫০০ কোটি ঘণ্টা অতিবাহিত করে অন্যান্য দেশের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অনেকটাই পিছনে ফেলে দিয়েছেন। এই দেশে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন আর গেমস-এর ব্যবহার বল্গাহীন। এর ফল: তথ্যের অবাধ বারোয়ারিকরণ।
প্রাথমিক স্তরে এই তথ্যগুলো সব ‘র’ ডেটা। বিশেষ কিছু বোঝার উপায় নেই। এই প্রাথমিক তথ্যের উপরেই ডেটা সায়েন্স ও অ্যানালিটিক্স প্রয়োগ করেন তথ্যবিজ্ঞানীরা। সেই তথ্য ভেঙেচুরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে নির্বাচনের উপযোগী করে তোলেন। নির্বাচনে কেমন ভাবে কাজে লাগানো হয় জনগণের ব্যক্তিগত তথ্য? বিভিন্ন সোশ্যাল সাইট বা অ্যাপ-এ আমরা প্রায় রোজ মুড়িমুড়কির মতো রেজিস্টার করি। দেদার সাবস্ক্রাইব করি নানা অনলাইন গেম। এর সঙ্গে রয়েছে বিনামূল্যের অজস্র থার্ড পার্টি অ্যাপ। যেমন গত জন্মে কী ছিলেন, তিরিশ বছর পরে কেমন দেখতে হবেন, আপনার মৃত্যু কী ভাবে হয়েছিল, কোন চলচ্চিত্র শিল্পীর মতো দেখতে আপনি, আপনার আগের জন্মের ফটো দেখতে নামের পিছনে ডট অন ডট কম লিখুন ইত্যাদি। প্রয়োজন মতো এই সব ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে আমরা নিজেদের নাম, ই-মেল আইডি, ফোন নম্বর, বয়স, লিঙ্গ, বৈবাহিক অবস্থা, যেখানে থাকি সেই জায়গার নাম, যে সংস্থায় কর্মরত তার নাম, পেশা, শখ, ছবি, লেখা, পোস্ট, লাইক, পারিবারিক তথ্য, বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থান ও আরও নানাবিধ ব্যক্তিগত বৃত্তান্ত দিয়ে দিই। গোপনীয়তার শর্তাবলির অংশটুকু অনেকে পড়েও দেখি না, তার আগেই ‘আই এগ্রি’ অপশনে ক্লিক করে ফেলি। অর্থাৎ আমি আমার তথ্য স্বেচ্ছায় বিতরণ করতে রাজি। ফলে আমাদের সব ব্যক্তিগত তথ্যের মালিকানা অনায়াসে পাচার হয়ে যায় অজানা কোনও তৃতীয় পক্ষের হাতে।
এ ছাড়াও আমরা যে সব ব্রাউজ়ারে নেটসার্ফ করি, তাতে, মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম সাপেক্ষে, ‘কুকি’ নামের ক্ষুদ্র সফ্টওয়্যার বা ফাইল বাই ডিফল্ট সক্রিয় থাকে। কিন্তু কুকিরা যে সব জায়গায় সক্রিয়, ওয়েব-সার্ফ করার সময় আমাদের কার্যবিধি তারা ‘ট্র্যাক’ করতে শুরু করে। অর্থাৎ আমরা কোন সাইটে ঢুকছি, কী দেখছি বা পড়ছি, কত সময় অতিবাহিত করছি, কেমন তথ্য দিচ্ছি, সব অনুসরণ করে। আর চুপিসারে হাতিয়ে নিতে থাকে আমাদের যাবতীয় তথ্য। আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই না, ওয়েব দুনিয়ার কোন আড়াল থেকে আমাদের উপর চলছে এ রকম নজরদারি। ঘটছে ‘ডেটা হারভেস্ট’, অর্থাৎ আমাদের সম্মতিক্রমে ব্যক্তিগত তথ্য কুড়িয়ে-কাচিয়ে নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
এবং সেই তথ্য ভাঙিয়ে অনৈতিক ভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে নির্বাচনকে। বিপুল অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক পার্টির হাতে চলে যাচ্ছে ক্ষমতার রাশ। এক কথায়, ‘ডিজিটাল রিগিং’। এই দেশে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুর্নীতি নতুন কিছু নয়, আকছার হচ্ছে। ডিজিটালাইজ়েশনের মোড়কে দুর্নীতিও এখন হাই-টেক। স্মার্ট দুর্নীতি। আমাদের হরির লুটের মতো সোশ্যাল মিডিয়ায় বিলিয়ে দেওয়া খামখেয়ালি লাইক আর পোস্টের উপর ভিত্তি করে তৃতীয় পক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া বিশেষ কোনও দলের অনুকূলে নির্বাচন প্রক্রিয়া প্রভাবিত হয়ে যাচ্ছে! নাগরিকদের সার্বভৌম ক্ষমতার পক্ষে এ এক বড় চ্যালেঞ্জ।
এমন পরিস্থিতি আমরাই প্রতিরোধ করতে পারি। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের তথ্য দেওয়ার আগে অনেক সচেতন হওয়া দরকার। কোন তথ্য দেব, কোথায় থামব, সেই সূক্ষ্ম হিসেবটা বোঝা দরকার। কাজের প্রয়োজনে আমরা অনেকটা সময় অনলাইন থাকি। ফলে প্রচুর তথ্যের আদানপ্রদান চলে। কর্মস্থলে তথ্য সুরক্ষার দিকে নজর রাখার ব্যবস্থা জরুরি। নাগরিক তথ্যের পরিমাপ পর্বতপ্রমাণ। এই বিপুল তথ্য চুরি যাওয়ার ঝুঁকিও বড়সড়। সেই ঝুঁকি কমাতে দেশের নীতিপ্রণয়নকারীদের কর্তব্য কনজ়িউমার প্রাইভেসি বিল প্রণয়ন করা। নাগরিক তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন জেনারেল ডেটা প্রটেকশন রেগুলেশন (জিডিপিআর)-এর নির্দেশিকা দেশের আইটি সিকিয়োরিটি অ্যাক্টের অন্তর্ভুক্ত করা। বিপদ যখন নতুন, লড়াইয়ের নতুন অস্ত্রগুলো শিখে নিয়ে ব্যবহার করতে হবে বইকি।