সময়টা জাতপাত নিয়ে মাথা ঘামানোর পক্ষে উপযুক্ত নয়। কিন্তু নিয়ম করে বছরে কয়েক বার সংরক্ষিত শ্রেণির কেউ না কেউ অসংরক্ষিত ‘সাধারণ’ মানুষের হাতে অপদস্থ হলে চুপ করেও থাকা যায় না। রোহিত ভেমুলা, পায়েল তদভি, সুব্রহ্মণ্যম সদরেলা, মেরুনা মুর্মু... তালিকাটা লম্বা হয়েই চলেছে।
ভারতে সংরক্ষণের বয়স নেহাত কম হল না। কিন্তু ‘অসংরক্ষিত’ উচ্চবর্ণের মানুষ কেন এখনও এই ব্যবস্থাকে মেনে নিতে পারলেন না, তার কারণ খুঁজতে গিয়ে মনে হল সংরক্ষণ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণাটাতেই অনেক গলদ রয়ে গিয়েছে। তাই এই সংরক্ষণ বিরোধী অসহিষ্ণুতাকে শুধু নিন্দা করে চাপা দেওয়ার চেষ্টা না করে বরং কারণগুলো তলিয়ে দেখে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলার চেষ্টা দরকার।
উচ্চশিক্ষা আর সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের ক্ষোভের কারণ দু’রকম; প্রথমত, আমাদের মনে হয় ‘ওঁরা’ যথেষ্ট যোগ্য না হয়েও পড়াশোনা বা চাকরির সুযোগ পাচ্ছেন। আর দ্বিতীয়ত, ‘আমাদের’ মুখের গ্রাস ‘ওঁরা’ কেড়ে নিচ্ছেন, মানে আমাদের চাকরির সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছেন। ‘গ্রাস’-টা যে শুধু আমাদেরই ছিল, অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা ও সরকারি চাকরির প্রতিটি ক্ষেত্রে শুধু ‘আমাদের’ প্রতিনিধিদেরই দেখা যাবে, এটাই আমাদের সযত্নলালিত ধারণা, কারণ আমরাই যোগ্য। ‘ওঁরা’ ‘আমাদের মতো’ যোগ্য হয়ে আমাদের সঙ্গে লড়ে চাকরি পাক, তা হলেই ওঁদেরও দেখা যাবে। আমরা জানি, ওঁরা এই ভাবে যোগ্যতা অর্জন করতে পারবেন না। ইস্কুলে শিক্ষক ওঁদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন, অভাবের সংসারে বাবা-মা’ও পড়াতে পারবেন না। তাই ওঁরা ও-ধারেই থেকে যাবেন। যদি তা না হত, তা হলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষিত শ্রেণির প্রতিনিধি আজও এত কম হত না। অর্থাৎ, ওঁরা নিজেরা উঠে আসতে পারছেন না, আর আমরাও ওঁদের দেখতে চাইছি না। এই দুইয়ের ফল হল ওঁদের অদৃশ্য হয়ে রয়ে যাওয়া।
যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কয়েকটা কথা বলতেই হয়। প্রথমত, শিক্ষার ক্ষেত্রে সংরক্ষণ শুধু ঢোকার পথটা একটু সহজ করে দেয়, বেরোনোটা কিন্তু একই রকম থাকে। আর দ্বিতীয়ত, এক জন ছাত্র কত ভাল ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেন, তা নির্ভর করে তিনি পাঠ্য বিষয়টা কতটা ভাল করে পড়েছেন, তার উপর। আমাদের দেশে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিভিন্ন বৃত্তিমূলক শিক্ষায় প্রার্থীর সংখ্যা বিপুল হওয়ার জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষাটা খুব কঠিন করতে হয়; সংরক্ষিত ছাত্ররা সেইখানে হয়তো কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর আগে যাঁরা ডাক্তারের পদবি দেখেন, তাঁরা খেয়াল রাখবেন, সংরক্ষিত ছাত্ররাও একই সিলেবাস পড়ে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। আপনি জানেন না, অসংরক্ষিত ডাক্তারবাবু আপনার অজানা কোনও একটা ‘কোটা’র সুযোগ পেয়েছেন কি না।
কিন্তু যোগ্যতা কোনও বায়বীয় পদার্থ নয় যে, তা এমনি এমনিই সকলের মধ্যে গড়ে উঠবে, পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থানের উপর তা প্রায় সরলরৈখিক ভাবে নির্ভরশীল। যে তথাকথিত যোগ্যতার অহমিকায় আমরা ডগমগ হয়ে থাকি, তা আদৌ শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মেধা বা দক্ষতা নয়, আমরা কে কতটা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি, তার উপরও নির্ভর করে। যে ছাত্র প্রতিটি বিষয়ে দু’জন করে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া ছাত্রটির চেয়ে ‘যোগ্যতর’ হয়ে উঠেছেন, তাঁদের যোগ্যতা কি সত্যিই তুলনীয়! তা ছাড়া যে দেশে যে কোনও স্তরেই বিভিন্ন বোর্ড এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পাঠ্যসূচিতে শিক্ষা দেয়, আর বিভিন্ন প্রাইভেট কলেজ থেকে ছাত্ররা শুধু আর্থিক সঙ্গতির জোরে ‘প্রফেশনাল’ ডিগ্রি নিয়ে বেরোয়, সেখানে যোগ্যতার মাপকাঠিটা কোথায়! উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম হওয়া ছাত্রও কখনও কখনও আইআইটি-র প্রবেশিকা পরীক্ষায় আটকে যায়। আবার বিভিন্ন ‘কোচিং সেন্টার’-এর উদ্যোগে যে সমান্তরাল শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেখানে মোটের ওপর সাধারণ ছাত্রও কঠিন পরীক্ষার বাধা টপকে যায়। সুতরাং, যোগ্যতা ব্যাপারটা অনেকটাই আপেক্ষিক।
বরং এটা মনে রাখা ভাল যে, তফসিলি জাতি-জনজাতি সমেত সংরক্ষিত প্রার্থীরা মোট জনসংখ্যার যত অংশ জুড়ে আছেন, তাঁরা যদি যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা সমান ভাবে পেতেন, তা হলে সর্বস্তরে প্রতিযোগিতা বেড়েই যেত, কমত না।
এই যেমন, এক সময় শিক্ষা ও কাজের জগতে মেয়েরা অনুপস্থিত ছিলেন। তখন তো মেয়েদের অযোগ্য বলেই মনে করা হত। কিন্তু আসল কথাটা হল, তখন মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগই ছিল না। ধীরে ধীরে মেয়েরা সুযোগ পেয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলেন। প্রথমে কেউ ‘মেয়ে ডাক্তার’ কি ‘মেয়ে মাস্টার’-এর কাছে যেতেন না, কারণ মনে করা হত মেয়েরা যথেষ্ট দক্ষ নন। অথচ, আজ মেয়েদের যোগ্যতা যে আসলে এক চুলও কম নয়, তা বলে দিতে হয় না। এই উত্তরণটা সম্ভব হল শুধু সুযোগ পাওয়াতেই। আগে যে মেয়েদের পাওয়া যেত না, সেটা যোগ্যতার অভাবে নয়, সুযোগের অভাবে।
এখানে অবধারিত প্রশ্ন ওঠে, উচ্চবর্ণেও তো প্রচুর দরিদ্র মানুষ আছেন, যাঁরা নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, তাঁদের জন্যও তো তা হলে সংরক্ষণ দরকার। কথাটা সঠিক নয়। কেননা দারিদ্র নানা ভাবে জয় করা যায় (আর্থিক সাহায্য, বৃত্তি, ঋণ ইত্যাদি)। কিন্তু দারিদ্রের পাশাপাশি সামাজিক অবস্থানও যাঁদের পিছিয়ে থাকার একটা কারণ, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সত্যিই আলাদা। অসীম দারিদ্র জয় করে উঠে আসাটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে একটা কৃতিত্ব— যেটা সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষের ক্ষেত্রে একটা স্পর্ধা হিসেবে দেখা হয়। তাই ডাক্তার হয়ে ওঠার পরও উচ্চবর্ণের সহপাঠীরা পায়েল তদভির বিছানায় পা মুছতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রোহিত ভেমুলার গবেষণাবৃত্তি বন্ধ করে তাঁকে রাস্তায় থাকতে বাধ্য করতেন। সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে উচ্চপদে চাকরি করেন, এমন এক জনের কথা শুনেছিলাম, নিজের গ্রামে গেলে যাঁকে এখনও অনেক দূর থেকে জল আনতে যেতে হয়। অর্থাৎ, সামাজিক বৈষম্য এমন এক ধারণা, যা দরিদ্র উচ্চবর্ণ অনুভব করেন না।
তবে মজার কথা হল, জাতপাত ভিত্তিক সংরক্ষণ ছাড়াও আরও বহু ধরনের সংরক্ষণ আমাদের চার পাশে কাজ করে। যে কোনও চাকরিতে যে বয়ঃসীমা থাকে, তাও এক ধরনের সংরক্ষণ। এর সুবিধা আমরা সবাই পাই, তাই এটা নিয়ে আপত্তি নেই। তার পর বিভিন্ন চাকরিতে আছে ‘রাজনৈতিক কোটা’, ‘ডোনেশন কোটা’ এবং শেষ অবধি ‘রিলেশন কোটা’, যার কোনওটাই প্রার্থীর যোগ্যতা বিচার করে না। মোট কথা, আমাদের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে বিভিন্ন ধরনের সমান্তরাল যোগ্যতা তৈরি হয় এবং তার জোরে নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা নেওয়াও চলে। সে সব বিষয়ে চুপ করে থেকে আমরা সরব হই কেবল একটি ক্ষেত্রে।
এর একটা কারণ হল, চোখের সামনে আমরা এমন অনেক সাধারণ পদবির মানুষকে দেখতে পাই, যাঁরা কোনও ভাবেই তেমন পিছিয়ে পড়া নন, অথচ সংরক্ষণের সুবিধা নিয়ে তাঁরা যোগ্যতার তুলনায় অনেক ভাল চাকরি জোগাড় করে ফেলেন। এটা নিঃসন্দেহে পদবি-নির্ভর সংরক্ষণের একটা সীমাবদ্ধতা এবং এই ক্ষেত্রে অসংরক্ষিত প্রার্থীদের ক্ষোভটুকু হয়তো সম্পূর্ণ অসঙ্গত নয়। তবে পরিসংখ্যানে একটু নজর রাখলেই বোঝা যাবে সংরক্ষিত সমস্ত গোষ্ঠীর তুলনায় আমাদের চোখে পড়া এই উদাহরণ নেহতই নগণ্য। কোনও ব্যবস্থাই তো নিখুঁত হয় না। পশ্চিমবঙ্গে আমরা জাতপাতের কড়াকড়ি ততটা দেখি না বলে পদবির গুরুত্ব কতটা, আমরা বুঝি না। সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে যে প্রস্তাবনা করা হয়েছিল, তা সমস্ত জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সমান কার্যকর হবে এমনটা হয় না। হয়তো সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও অঞ্চল বা রাজ্যভিত্তিক পরিবর্তন বা সংশোধনের দরকার আছে।
সংরক্ষণ বিরোধিতার গোড়ায় আসলে আছে ‘রিলেট’ করতে না পারা এবং সমস্যার গভীরে না যাওয়া। মানুষ আসলে নিজের জীবন ও পরিমণ্ডলের বাইরে নজর ফেলতে পারেন না, তাই যেটুকু নজরে পড়ে তার ভিত্তিতেই মন্তব্য করেন। তবে যে ক্ষোভ পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে জেগে আছে, শুধু নিন্দা করে, বা পুলিশ লেলিয়ে তা মানুষের মন থেকে দূর করা যাবে না। বরং, যে কোনও বিরোধিতার মতোই সংরক্ষণ-বিরোধিতার কথাও শুনতে হবে, তার উত্তর দিতে হবে এবং দরকারে ভোটবাক্সের কথা না ভেবে কিছু পরিবর্তনও আনতে হবে। একটা দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ যদি শিক্ষা ও কর্মধারার মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন, সেটা ঠিক হতে পারে না।