ত্রিকোণ? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর জাপানি প্রেসিডেন্ট শিনজ়ো আবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মোদী, ওসাকা, ২৮ জুন, ২০১৯। ছবি: গেটি ইমেজেস।
প্রশ্ন: তেল থেকে বন্দর— ইরানের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে চিনের বিপুল বিনিয়োগ ভারতের কপালে ভাঁজ ফেলেছে। আপনার কী মনে হচ্ছে দেখেশুনে?
শ্যাম সারন: ঠিকই যে সাম্প্রতিক অতীতে ইরানের সঙ্গে চিনের অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং সামরিক সম্পর্ক ক্রমশই বেড়েছে। কিন্তু তার গুরুত্বকে একটু বাড়িয়ে দেখা হচ্ছে বলেই মনে হয়। ২০১৬ সালে চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর ইরান সফরে, ১০ বছরের জন্য ষাট হাজার কোটি ডলার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়েছিল। বাস্তবে দেখা গিয়েছে, কোনও বছরই তা সাড়ে তিন হাজার কোটি ডলার ছাড়ায়নি। ইরান-চিন কৌশলগত অংশীদারিত্বের খসড়াটি গত বছর প্রকাশ্যে আসে। তাতে দেখা যায়, ইরানের পরিকাঠামো, তেল ও গ্যাস-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিনের সম্ভাব্য বিনিয়োগ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এখন ব্যাপার হল, এই বিষয়টি আন্তর্জাতিক সংলাপের অন্যতম উপাদান হয়ে উঠেছে প্রবল ভাবে। খোদ ইরানই তো বলেছে, গোটা ব্যাপারটা প্রস্তাবের স্তরে রয়েছে, যা চিনকে পাঠানো হয়েছে। এর পর সে দেশের সংসদের অনুমতি প্রয়োজন। চিন তো কোনও মন্তব্যই করতে চাইছে না। আবার অন্যান্য উপসাগরীয় দেশ, বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ইজ়রায়েলের সঙ্গেও চিন সম্পর্ক প্রসারিত করেছে, যাদের সঙ্গে ইরানের অহি-নকুল সম্পর্ক। ভারতের কাছে ইরান বরাবরই একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। আমাদের উচিত তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং সহযোগিতা বজায় রাখা। ভারতের পরিচালনাধীন চাবাহার বন্দর, নর্থ-সাউথ করিডর— যার মাধ্যমে আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া ছাড়িয়েও সংযোগ গড়া সম্ভব।
প্র: নেপালের সঙ্গে সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটছে। ভারত-নেপাল সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
উ: নেপালের সঙ্গে সম্পর্কের এই অধঃপতন বেড়ে চলেছে কে পি ওলি সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পর। দুর্ভাগ্যজনক। ভারত-বিরোধী আবেগ খুঁচিয়ে তুলে রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জন সে দেশের রেওয়াজ হয়ে গিয়েছে এবং ওলি তাকেই সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে চলেছেন, তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে বহু ধাপ এগিয়ে কালাপানির মতো সামান্য মতবিরোধকে ভূখণ্ডের দাবিতে পরিণত করছেন, যা কৌশলগত ভাবে ভারত-চিন-নেপালের ত্রিপাক্ষিক সীমান্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। সংবিধানের সংশোধন ঘটিয়ে নেপালের মানচিত্রে একতরফা ভাবে এই ভূখণ্ডটি অন্তর্ভুক্তও করছেন। আগামী দিনে নেপালের কোনও সরকারের পক্ষে এই মানচিত্রকে ফের আগের জায়গায় নিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক ভাবে অসম্ভব। ভারতের পক্ষেও এটা মেনে নেওয়া মুশকিল। আমার মনে হয়, এটি একটি অমীমাংসিত বিষয় হিসেবেই থাকবে। আশা করি, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অন্য দিকগুলিতে এর প্রভাব পড়বে না। আসলে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে কূটনৈতিক দৌত্যের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির বিভিন্ন রাজনৈতিক স্তরে যোগাযোগ রেখে চলা উচিত। একমাত্র তা হলেই বড় সঙ্কট তৈরি হওয়ার আগে সর্তকবার্তা পাওয়া যায় এবং সমস্যাটি অঙ্কুরেই বিনাশ করা যায়।
প্র: চিনের সঙ্গে সীমান্তে সংঘাতময় পরিস্থিতির কোনও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কি ভারত-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে পড়তে চলেছে বলে মনে হয়?
উ: ভারত-চিন প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতার মধ্যে সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় থেকেছে বরাবর। দু’দেশের নেতারাই এ যাবৎ প্রতিশ্রুত থেকেছেন সম্পর্ককে একটা সুষম পর্যায়ে ধরে রাখতে। এলএসি-র সাম্প্রতিক ঘটনা অবশ্যই তাকে বদলে দিল। চিন এখন এতটাই শক্তিশালী যে, নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একতরফা ভাবে ভারতের উপর চাপ তৈরি করার মতো ক্ষমতা তারা রাখে, এবং এশিয়াতে চিনের একাধিপত্য মেনে নিতে ভারতকে বাধ্য করতে পারে। ১৯৮৮ সালে চিনের নেতা দেং জিয়াওপিং তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে বলেছিলেন, এশিয়ার শতক তৈরি করা সম্ভব একমাত্র ভারত-চিন অংশীদারিত্বের মাধ্যমেই। আজকের চিন, এশিয়ার শতককে আসলে চিনের শতক হিসেবে দেখে থাকে। সেখানে ভারতের কোনও জায়গা নেই। ভারত-চিন সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, চিনের এই পরিবর্তিত মানসিকতার দিকটি ভারতকে হিসেবের মধ্যে রাখতে হবে।
প্র: ভারত-চিন সংঘাতে মস্কোর ভূমিকাকে কী ভাবে দেখছেন? গালওয়ান-কাণ্ডে তাদের পরোক্ষ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে। রাশিয়ার কোনও স্বার্থ এর পিছনে রয়েছে বলে মনে হয়?
উ: ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের নিজস্ব ব্যাকরণ এবং বন্ধুত্বের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই সম্পর্ককে চিনের নিরিখে মাপা ঠিক হবে না। তবে রাশিয়ারও নিজের স্বার্থ রয়েছে। চিনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কে ব্যালান্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে ভারত থাকুক, সেটা রাশিয়া চায়। আমাদের অর্থনৈতিক আদানপ্রদান রাশিয়ার সঙ্গে কমেছে, কিন্তু রাশিয়া এখনও শক্তিক্ষেত্রে ভারতের বড় অংশীদার রাষ্ট্র এবং উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন অস্ত্রের সরবরাহকারীও বটে। আমি খুব একটা নিশ্চিত নই যে, রাশিয়া এই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা কত দিন পালন করতে পারবে। শেষ পর্যন্ত চিনের সঙ্গে সম্পর্ককে আমাদের নিজেদেরই বুঝে নিতে হবে।
প্র: ভারত-জাপান-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া। এই চর্তুদেশীয় অক্ষ বা কোয়াড-কে সামরিক পোশাক পরানো নিয়ে আলোচনা চলছে। তাতে কি চিনকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে সুবিধা হবে? যদি না হয়, তা হলে ভূকৌশলগত ভাবে চিনের পাল্টা হিসেবে আমাদের হাতে কী রইল?
উ: চিনের ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একমাত্র পথ ভারতের সমস্ত শক্তিকে একজোট করা। অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগত যে বিস্তর ব্যবধান চিনের সঙ্গে তৈরি হয়েছে, তা কমানো। তার জন্য প্রয়োজন সঙ্কল্পবদ্ধ নেতৃত্ব, জনসমর্থন, বুদ্ধিদীপ্ত ভাবে সামগ্রিক নীতিনির্ধারণ। আয়তন, জনসংখ্যা, সম্পদ, আধুনিক প্রযুক্তির নিরিখে সম্ভবত ভারত একমাত্র দেশ, যাদের চিনকে ধরে ফেলার, এমনকি ছাপিয়ে যাওয়ারও ক্ষমতা রয়েছে। তবে তার জন্য প্রয়োজন কঠোর পরিশ্রম এবং স্থির ও একাগ্র লক্ষ্য ধরে রাখা। এর মধ্যে অবশ্যই উচিত, যে সব শক্তিধর দেশ চিনের এই একতরফা আগ্রাসন নিয়ে ভারতের উদ্বেগে সমব্যথী, তাদের সঙ্গে নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্ক জোরদার করা। আমরা তো চাই চিন-সহ বাকিদেরও সঙ্গে নিয়ে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি বহুপাক্ষিক নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে। এখন এটা চিনের ব্যাপার যে, তারা একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করতে চায়, না কি এই অঞ্চলের অন্য শক্তিধর দেশগুলি যে ভাবে আন্তর্জাতিক আইনকানুন মেনে চলে, সেই ব্যবস্থার শরিক হতে চায়। যদি চিন ভাবে যে, তারা এশিয়ায় একটি উচ্চতন্ত্র তৈরি করে তার মাথায় গিয়ে বসবে, তা হলে স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধিতা করে অক্ষ তৈরি হবে চিনের একাধিপত্যকে প্রতিহত করার জন্য। চিন-বিরোধিতার প্রশ্নে কোয়াড অবশ্যই একটি শক্তিধর অক্ষ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু পুরোদস্তুর সামরিক জোট হতে তার এখনও অনেক দেরি আছে।
প্র: অনেকের মত, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের লেখচিত্র ক্রমশ নিম্নগামী, কিছু রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক কারণে। চিন সেই ফাঁকা জায়গাটি দখল করতে সক্রিয়। এ ব্যাপারে আপনার কী মত?
উ: ভারতের সব প্রতিবেশী রাষ্ট্রেই চিন তার প্রভাব ক্রমশ বাড়াচ্ছে, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। এটা ঘটনা, চিন যে পরিমাণ টাকা ঢালতে সক্ষম, তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমার মনে হয়, চিনের কাছ থেকে আর্থিক আনুকূল্য নেওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ অনেকের থেকেই (যেমন, শ্রীলঙ্কা) বেশি সতর্ক। দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে ওঠার ক্ষমতা রয়েছে ভারতের। কিন্তু তার জন্য দেশগুলির কাছে নিজের বাজার খুলতে হবে, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির জন্য বিনিয়োগ করতে হবে। নিজেদের এমন পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে অন্যান্য রাষ্ট্র টাকা ঢালতে উৎসুক হয়। আমার মতে, মোটের উপর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঠিক পথেই চলছে। তবে কাঁটাও অনেক রয়েছে। সে সব কাঁটার কিছু তৈরি হয়েছে আমাদের ঘরোয়া রাজনীতির কারণে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় অনুপ্রবেশের বিষয়টা। বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষদের কথা বলতে গিয়ে ‘উইপোকা’র মতো শব্দ ব্যবহার করা হলে অথবা তাতে সাম্প্রদায়িক রং দেওয়া হলে যদি বাংলাদেশের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হয়, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সিএএ-তে বাংলাদেশের হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের বিষয়টি রয়েছে, যা ঢাকাকে আহত করেছে।
প্র: পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে ফোনে কথা হল হাসিনার। পাকিস্তানের দাবি, তাঁদের আলোচনায় নাকি উঠে এসেছে কাশ্মীর প্রসঙ্গও...
উ: পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অন্য যে দেশের নেতার সঙ্গে কথা বলবেন, সেখানেই কাশ্মীর প্রসঙ্গ তুলবেন, এটা ধরে নেওয়াই যায়। এখন দেখার যে, অন্য পক্ষের কাছ থেকেও এ ব্যাপারে কোনও ইতিবাচক সাড়া তিনি পাচ্ছেন কি না। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করেছেন, এমন কোনও প্রমাণ আমি পাইনি। তাই এর মধ্যে অন্য কোনও অর্থ খোঁজার পক্ষপাতী নই।
প্র: বিদেশনীতিতে প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগত রসায়ন এবং অপটিক্স-কে খুব গুরুত্ব দেন। প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কে এই বিষয়গুলি কতটা সাহায্য করে?
উ: দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক লালন করতে ব্যক্তিগত রসায়নের একটা ভূমিকা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলির নিজেদের স্বার্থের মেলবন্ধন ঘটাও প্রয়োজন। একটি দেশের নেতা যখন অন্য দেশের নেতার সঙ্গে দেখা করেন, তখন তাঁরা নিজ নিজ দেশের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। ব্যক্তিগত রসায়ন এবং অপটিক্স হয়তো সেই স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্রে কিছুটা কাজে আসতেও পারে। কিন্তু সামগ্রিক সম্পর্কের বিকল্প এগুলি হতে পারে না। শীর্ষ পর্যায়ের সফর বা সম্মেলনের আয়োজন করার ফলে একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি হতে পারে। কিন্তু যে প্রতিশ্রুতি পরস্পরকে দেওয়া হল, তা অবশ্যই রাখতে হবে। না হলে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ভাল বলে, অথবা প্রকাশ্যে তিনি তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন বলে, ট্রাম্প ভিসার কড়াকড়ি শিথিল করবেন না, যদি ঘরোয়া রাজনীতির জন্য বিষয়টি তাঁর কাছে সুবিধাজনক হয়। এই বিষয়গুলিকে আমাদের ঠিক পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখতে হবে।
শ্যাম সারন প্রাক্তন বিদেশসচিব।
সাক্ষাৎকার: অগ্নি রায়