তর্কে বহু দূর

আদালতের রায়েই এমন কিছু মন্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ আছে, যেগুলিতে এই সমাপনের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠিতে পারে। যেমন, আদালত জানাইয়াছে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সমীক্ষা হইতে জানা গিয়াছে যে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের নীচে অ-ইসলামি কাঠামোর অস্তিত্বের সন্ধান মিলিয়াছে; কিন্তু রাম মন্দির ভাঙিয়াই বাবরি মসজিদ নির্মিত হইয়াছিল কি না, তাহার নির্দিষ্ট উত্তর আদালতের রায়ে নাই।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০১৯ ০৩:০১
Share:

এখানেই গড়া হবে রামমন্দির

অযোধ্যা জমি-বিবাদে সুপ্রিম কোর্ট শনিবার চূড়ান্ত রায় দিয়াছে। অর্থাৎ, আইনের পরিসরে বিবাদটির ক্লোজ়ার বা সমাপন ঘটিল। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও দুইটি মূলগত প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন। সমাপন একটি গন্তব্য— তাহা যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, যুক্তির কোন পথে সেই গন্তব্যে পৌঁছানো গেল, তাহার গুরুত্ব তুলনায় তিলমাত্র কম নহে। আদালতের রায়েই এমন কিছু মন্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ আছে, যেগুলিতে এই সমাপনের সম্পর্কে প্রশ্ন উঠিতে পারে। যেমন, আদালত জানাইয়াছে, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সমীক্ষা হইতে জানা গিয়াছে যে ধ্বংস হওয়া বাবরি মসজিদের নীচে অ-ইসলামি কাঠামোর অস্তিত্বের সন্ধান মিলিয়াছে; কিন্তু রাম মন্দির ভাঙিয়াই বাবরি মসজিদ নির্মিত হইয়াছিল কি না, তাহার নির্দিষ্ট উত্তর আদালতের রায়ে নাই। ১৯৩৪ সালের দাঙ্গা, ১৯৪৯ সালে মসজিদে সহসা রামলালার মূর্তির ‘আবির্ভাব’ ইত্যাদি ঘটনাবলি যে জমি-দখল সংক্রান্ত সংঘাতের লক্ষণ বহন করিতেছে, আদালত তাহা স্বীকার করিয়াছে। অর্থাৎ, মুসলমানরা যে মসজিদের দাবি ছাড়েন নাই, তাহা স্পষ্ট। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের ঘটনাও যে আইনভঙ্গ, আদালত জানাইয়াছে। এবং সর্বোপরি, বিতর্কিত জমিটির উপর সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডের মামলাটি যে আইনগ্রাহ্য (মেনটেনেব্‌ল), আদালত তাহাও মানিয়া লইয়াছে। এই কথাগুলি যোগ করিলে কি বিতর্কিত ২.৭৭ একর জমির মালিকানা রামলালার নামে বর্তাইতে পারে? প্রশ্ন থাকিতেছে। আদালত জানাইয়াছে, বিতর্কিত জমিটিতে রামলালার জন্ম হইয়াছিল, হিন্দুদের এই বিশ্বাস ‘প্রকৃত’ বলিয়া প্রমাণ হইয়াছে। বিশ্বাসের ‘প্রমাণ’ কাহাকে বলে, সে প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি থাকুক। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাস আইনি দাবির, এবং ‘স্বাভাবিক ন্যায্যতা’র (ন্যাচরাল জাস্টিস) দাবিকে অতিক্রম করিতে পারে কি না, সেই প্রশ্নটি অনিবার্য নহে কি? লক্ষণীয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় বিশ্বাস যে আদালতের বিবেচ্য হইতে পারে না, তাহার কাজ শুধুমাত্র আইনের ব্যাখ্যা করা— অনতিঅতীতে সুপ্রিম কোর্টই এই কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানাইয়াছিল। মহামান্য আদালতের নিকট বিনীত প্রশ্ন: অযোধ্যা মামলার রায় তাহা হইতে ভিন্ন কথা বলিতেছে না তো?

Advertisement

‘সমাপন’ সম্পর্কে দ্বিতীয় প্রশ্নটির মূলও এইখানেই— সত্যই কি বিবাদের সম্ভাবনা মিটিল, না কি ভবিষ্যতে আরও অনেক বিবাদ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে তাহার ফয়সালার একটি বিপজ্জনক পথ খুলিয়া গেল? ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণের গুরুত্ব যদি খর্ব হয়, স্বাভাবিক ন্যায্যতা যদি যথেষ্ট স্বীকৃতি না পায়, তবে কি সংখ্যালঘুর দাবিগুলি বিপন্ন হয় না? যে দাবির মর্যাদা রক্ষা যথার্থ গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান শর্ত? যে শর্তের কথা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাঁহার কথায় ও কাজে বারংবার মনে করাইয়া দিয়াছিলেন? হিন্দুত্ববাদীরা ১৯৯২’তেই জানাইয়াছিল, অযোধ্যা সূচনামাত্র, তাহাদের কর্মসূচি আরও অনেক লম্বা। কাল যদি ধর্মোন্মাদদের আর এক দল আবার কোনও ঐতিহাসিক ‘কাঠামো’র উপর চড়াও হয়, এবং সম্মিলিত বিশ্বাসের দোহাই দেয়, আপত্তি করিবার মতো জোর ভারতীয় গণতন্ত্রের থাকিবে কি? স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সংখ্যালঘুরা বহু বার সংখ্যাগরিষ্ঠের আক্রমণের মুখে পড়িয়াছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস তাঁহাদের টিকিয়া থাকিবার সাহস দিয়াছিল। সেই বিশ্বাসটিই ভারতকে প্রতিবেশীদের হইতে উজ্জ্বল ভাবে পৃথক রাখিত। সেই জায়গাটি যদি বিপন্ন হয়, তাহাকে কি সমাপন বলা চলে?

বস্তুত, গণতান্ত্রিক ভারতের চরিত্রলক্ষণ ছিল সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর দায়বদ্ধতার কথা রাষ্ট্রীয় স্তরে স্বীকার করিয়া লওয়া। তাহা আইনের প্রশ্ন নহে, আদর্শের প্রশ্ন। অযোধ্যা জমি-বিতর্কটিকেও হয়তো সেই দর্শনের দৃষ্টিকোণ হইতে দেখা যায়। আবেগের প্রশ্নটিকেই যদি গুরুত্ব দেওয়া হয়, তবে স্মরণ করাইয়া দেওয়া যায়, সংখ্যালঘুর মনে নিরাপত্তার আশ্বাসটি বজায় রাখিবার জন্যই তাহাদের দাবিকে মান্যতা দেওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠের কর্তব্য। সংখ্যাগুরুর সেই উদারতাই স্বাধীন ভারতকে তাহার বিশিষ্ট চরিত্রটি উপহার দিয়াছিল। এবং, ভারতকে যদি সংখ্যাগুরুবাদের পথে যাওয়া হইতে আটকাইতে হয়, তবে এই দাবিটির কথা ভুলিলে কখনও চলিবে না। আদালত আপন অবশ্যমান্য সিদ্ধান্ত জানাইয়াছে। এ-ক্ষণে দায়িত্ব সরকারের। সত্যই যাহাতে এই রায় দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক টানাপড়েনে ইতি টানিতে পারে, তাহা নিশ্চিত করাই এই মুহূর্তের সর্বাপেক্ষা জরুরি কর্তব্য।

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

পৃথিবী কী পরিপূর্ণ পলিটিকালি কারেক্ট হয়ে উঠছে, তার প্রমাণ, ‘বুলবুল’ ঝড়খানি হিসেব কষে এল শনি-রবিবার। সে জানে, এ সময় বহু স্কুল বন্ধ থাকে, অফিসও, সর্বোপরি যাঁদের ক্ষতি হবে না তাঁরা টিভিতে জমিয়ে অন্যের ক্ষয়ক্ষতি লাইভ উপভোগ করতে পারবেন, উইকএন্ডে কাজের তাড়া থাকবে না। আবার ‘নাচ মেরে বুলবুল তো পয়সা মিলেগা’ পঙ্‌ক্তিতে ভারতীয় লোকগাথায় বুলবুলদের প্রতি যে অপমান খচিত, এ ঝড় তারও মূর্ত প্রতিবাদ। দেখবি, নাচ কাকে বলে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement