তখন কতই বা বয়স আমার। মেরেকেটে পাঁচ কী ছয়। মহরমের দিন বাবা-মায়ের হাত ধরে রাস্তার এক পাশে সন্তর্পণে দাঁড়িয়ে পড়তাম তাজিয়ার মিছিল গেলে। কেমন যেন ভয়ে সেঁধিয়ে যেতাম আর মাকে জড়িয়ে ধরে অস্ফূটে বলে উঠতাম— ‘‘এত অস্ত্র কেন?’’ একটু বড়বেলায় পরিচয় হল রবিঠাকুরের ‘বিসর্জন’এর সঙ্গে। বলা ভাল, সেই অমোঘ প্রশ্নের সঙ্গে— ‘‘এত রক্ত কেন?’’
নয়-নয় করে চল্লিশ দশকের বেশি সময় পেরিয়ে আজ যখন ছোটবেলা আর বড়বেলা একাকার হয়ে যায় একই ব্যঞ্জনাবহ দু’টি প্রশ্নের পিঠে চেপে, তখন মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি বড় হয়েছি? না কি একই আবর্তে ঘুরছি শুধু একই প্রশ্নের উত্তরের আকাঙক্ষা বুকে নিয়ে?
উত্তর বেশ সহজ। হয়তো বা একটু বেশি মাত্রাতেই সহজ এবং আমাদের তা জানা। আর জানা বলেই মানার দায়টা নেহাতই কম। আর দায় কম বলেই জগৎজোড়া অস্ত্রের ঝনঝনানি, চরাচর জুড়ে কান্নার রোল। কারবালার কান্নার বয়স হয়ে গেল ১৪০০ বছর। থামল না আজও। বরং বেড়েই চলেছে। কাঁদছে সিরিয়া, দামাস্কস; কাঁদছে মিশর, কাঁদছে ইয়েমেন, ইরাক, প্যালেস্তাইন, ইজরায়েল। কেন? যে কারণে কেঁদেছিল কারবালা। না, সভ্যতা সেই অর্থে এগোয়নি, যার দৌলতে মুছে যেতে পারে কান্নার দাগ। ঠিক যেমন আমরাও বড় হইনি, শুধু শরীরের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে কিছুটা সময়।
সভ্যতার বড় হওয়ার শর্ত কী? স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। স্বেচ্ছাচারী একনায়কের অবসানে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। হয়েছে কি? রাখতে পারছি অশুভের বিরুদ্ধে হোসেনের জেহাদ ও আত্মত্যাগের মর্যাদা? যদি রাখতে পারতাম, তা হলে বোধ হয় আজ পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদ ও মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় উগ্রপন্থার বাড়াবাড়িতে পশ্চিম এশিয়াকে বারুদের স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হত না।
প্রায় ১৪০০ বছর আগে হজরত মহম্মদ (স)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন (রা:) মুয়াবিয়া খলিফাতন্ত্রের মনোনীত প্রতিনিধি অত্যাচারী এজিদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। অধুনা ইরানের কুফা নগরীর অধিবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা তাঁকে এজিদের মুখোমুখি ফেলে দিল চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে (১০ মহরম, ৬১ হিজরি, অক্টোবর ১০, ৬৮০ খ্রি)। জলের জোগানের উৎস ফোরাত নদীকে অবরুদ্ধ করল এজিদ বাহিনী। তীব্র জলকষ্টে আপ্রাণ লড়েও প্রাণ দিলেন ইমাম হোসেন।
মীর মোশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’র এ অশ্রুসিক্ত বিবরণ আমাদের অজানা নয়। কিন্তু এই জানা ইতিহাস যে শিক্ষাটা নিয়ে জ্বলজ্বল করছে ১৪০০ বছর ধরে, তার ধারে-কাছে না ঘেঁষে আমরা যারা মহরমের তাজিয়া বের করে অস্ত্রের আস্ফালন আর প্রতীকী শোকের উদ্যাপনে ব্যস্ত তারা কি সত্যিই বড় হলাম? কিংবা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যারা হোসেনের স্বৈরাচারী একনায়কত্বের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও শান্তি (যার প্রতিশব্দ ইসলাম) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে হোসেনের শহিদ হওয়ার কান্নাভেজা স্মৃতিকে ঠিক একই রকম প্রদর্শনসর্বস্ব শোক উদ্যাপনে সীমাবদ্ধ রাখে, আর আজও দাঁড়িয়ে থাকে একরোখা রাজতন্ত্রকে আঁকড়ে গণতন্ত্র থেকে আলোকবর্ষ দূরে, তারা কি প্রকারান্তরে এজিদেরই প্রতিরূপ নয়?
শুধুই কি জেহাদ ও আত্মত্যাগের দীক্ষা? কারবালা জেগে আছে ন্যায় ও সহিষ্ণুতা, স্থিতধী চিন্তন তো বটেই, এমনকি, রক্তপাতকে এড়ানোর প্রচেষ্টাকে বুকে নিয়ে। ইতিহাস বলছে, অত্যাচারী এজিদ খলিফা হওয়ার পরেই যখন মদিনায় ইমাম হোসেনকে বায়াত (আনুগত্য) প্রদর্শনের নির্দেশ জারি করে, তখন হোসেন এই অধার্মিক, দুরাচারীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে প্রথমে যুদ্ধ এড়াতে অনুচরদের নিয়ে চলে এলেন মদিনায়। এবং পাঁচ মাস ধরে ধার্মিক প্রাজ্ঞজনের সঙ্গে পরামর্শ করেন ও জনগণের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করতে থাকেন।
এটাই তো স্বৈরাচারের বিপ্রতীপে আধুনিক গণতন্ত্রের পথ। অবশেষে, কুফাবাসীর সমর্থনসূচক চিঠি পেয়ে তবে এজিদের মুখোমুখি হওয়ার সামরিক সিদ্ধান্ত নিলেন। এমনকি, কুফাবাসীর সমর্থন আদৌ যথাযথ কি না, তা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করতে নিজে সামরিক ভাবে অগ্রসর হওয়ার আগে মুসলিম ইবনে আকিলকে কুফাতে পাঠলেন। মনে পড়ে, মহাভারতের যুদ্ধ এড়াতে পাণ্ডবদের একের পর এক প্রচেষ্টার কথা, মনে পড়ে একই উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের কূটনৈতিক দৌত্যের কথা। আর শেষ পর্যন্ত কুফাবাসীর বিশ্বাসঘাতকতা ও এজিদের নৃশংসতায় হোসেনের মর্মান্তিক প্রাণত্যাগ মনে করায় অভিমন্যুর মর্মন্তুদ মৃত্য। নিমেষে কুরুক্ষেত্র আর কারবালা যেন একাকার। প্রশ্ন জাগে, কুরুক্ষেত্র ও কারবালার এই যুগান্তকারী যুগলবন্দি আমাদের কতটা শিক্ষিত করল? অধর্মের বিরুদ্ধে এই সব ধর্মযুদ্ধ, জেহাদ থেকে শিক্ষা নিয়ে এ পৃথিবী কতটা সভ্য হল?
জানি, এ প্রশ্ন অনেকেরই গাত্রদাহের কারণ হবে। গাত্রদাহ হবে তাদের, যারা ন্যায়ধর্ম থেকে দূরে কায়েমী স্বার্থ সিদ্ধিকেই ধর্ম মনে করে। এমনকি, ধর্মের নামে স্বকল্পিত ধর্মবিধিকে ঘরে-বাইরে সর্বত্র নিজেদের সুবিধামতো ব্যবহার করে। ইসলাম তো মহরমের ‘আশুরা’ পালন করতে বলছে নীরবে, নিভৃতে। মহরম মাসের ৯, ১০ ও ১১ তারিখ রোজা রাখা এবং রমজান পালনের মতো চূড়ান্ত সংযমে থেকে অসহায়, দুঃস্থের পাশে থাকা, প্রয়োজনে যে কোনও অনাচারের বিরুদ্ধাচরণ হল ‘আশুরা’। তাজিয়ার প্রদর্শন, পিঠে চাবুকের দাগ তুলে নির্মম আত্মপীড়ন, কিংবা বুক চাপড়ে সমষ্টিগত ‘মাতম’-এ শোকের উদ্যাপনের কোনও সমর্থন ইসলামে নেই। অথচ, আশ্চর্য— ধর্ম পালনের পরিসরে এই বিকৃতি সিঁধ কেটে ঢুকে পড়েছে। এবং কালে কালে তার এমনই বহর ও কর্তৃত্ব যে সেটাই মান্যতা পেয়ে গিয়েছে। এমনকি, অশান্তি এড়াতে, কখনও বা সম্প্রীতির স্বার্থে এই বিকৃতিই পাচ্ছে প্রশাসনিক সুরক্ষা।
তা হলে প্রকৃত ব্যাপারটা কী?
আরবি শব্দ ‘মহরম’-এর অর্থ সম্মানিত। কোরানের সূরা তাউবার ৩৬ নং আয়াত বলছে, ১২ মাসের মধ্যে বিশেষ ভাবে পবিত্র ও সম্মানিত ৪ টি মাসের মধ্যে মহরম একটি। বাকি তিনটি রজব, জিলকাদ ও জিলহাজ। আর এই সম্মানিত মাসে সম্মানিত সে-ই, যে ন্যায়নীতি ও আদর্শের জন্য আত্মত্যাগ করে। কারবালা আসলে জিঘাংসা, অনাচার ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই আত্মত্যাগের পরাকাষ্ঠা। প্রকৃত মুসলিম এই আত্মত্যাগের মহিমার সঙ্গে আপন সত্তার সংযত সম্পৃক্তিতে বিশ্বাস করে, শোকের প্রদর্শনে নয়।
মহরম মাসের ১০ তারিখ এক জন প্রকৃত মুসলিমের কাছে আরও কতগুলি কারণে বিশেষ ভাবে পবিত্র। সে বিশ্বাস করে এই দিনেই স্রষ্টা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্ম শুরু করেন। এই দিনেই প্রথম মানব-মানবী আদম ও হাওয়া (বাইবেলে বর্ণিত ইভ)’র আবির্ভাব। নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার কারণে এই দিনেই তাদের স্বর্গচ্যুতি, আবার এই দিনেই তাদের মুক্তি তথা স্বর্গারোহণ। এই পবিত্র দিনেই মুসা(আ:), যাঁকে ইহুদিরা বলে মোজেস, তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য হন ও ফেরাউন (অশুভ শক্তির প্রতীক) তার সঙ্গীদের নিয়ে নীল নদে তলিয়ে যায়। উল্লেখ্য, ইহুদিরাও তাই মহরমের এই দিনটিকে পবিত্র জ্ঞান করে উপোস থাকে।
কাজেই বুঝতে অসুবিধা হয় না, মহম্মদ (স:)-এর আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই দিনটি পবিত্র জ্ঞানে পালিত হয়ে আসছে মুসলিম-ইহুদি নির্বিশেষে। আশ্চর্য সমাপতন এটাই যে ওই দিনটিতেই মহম্মদ (স:)-এর আদর্শ রক্ষায় তাঁরই দৌহিত্র শহিদ হলেন। ততোধিক আশ্চর্যের, সেই আত্মত্যাগের তাৎপর্য আজ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে প্রদর্শন-সর্বস্ব যুথবদ্ধ শোক উদ্যাপনের বিকৃতির বহরে।
কারবালার প্রান্তে প্রাণত্যাগের আগের মুহূর্তে ইমাম হোসেন শেষ বার বলে ওঠেন— “আমার মৃত্যুতে যদি মোহাম্মদ(স:)-এর দ্বীন(ধর্ম) জীবন্ত হয়, তবে আমাকে তরবারি দ্বারা টুকরো টুকরো করে ফেলো।”
আত্মত্যাগের সেই পুণ্যভূমি থেকে প্রকৃত ধর্মের ফিনিক্স আজও উড়ল কি?
(মতামত নিজস্ব)
শক্তিনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা:
edit.nadia@abp.in
যে কোনও ইউনিকোড ফন্ট-এ টাইপ করে পাঠাবেন। অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।