মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে যাঁহারা তীব্র উচ্চারণে অভ্যস্ত, তাঁহারাও নির্ভয়া কাণ্ডের ন্যায় নির্মম ও বীভৎস অপরাধের ক্ষেত্রে, অপরাধীদের ফাঁসির বিপক্ষে তেমন কথা বলেন না, থমকাইয়া থাকেন, কারণ সেই কথাগুলি যেন সমাজের বিবেককে আহত করিয়া এক তাত্ত্বিক ঔচিত্যকে আঁকড়াইয়া থাকে মাত্র। কিন্তু যখন জানা যায়, ওই চার কয়েদিকে ১৪ দিন একা থাকিতে হইবে, তখন যদি কেহ কেবল তত্ত্বগত চিন্তাব্যায়ামের খাতিরেই সেই একাকী সেল-এ তাহাদের মানসিক পরিস্থিতি আন্দাজ করিতে বসেন, তবে এক ভয়াবহ নিসর্গ উন্মোচিত হইতে পারে। এ বিষয়ে কামু বা দস্তয়েভস্কি কী বলিয়াছিলেন, তাহা না পড়িলেও, এই অনুমান কঠিন নহে যে দণ্ডিতেরা প্রতি মুহূর্তে নিজেদের আসন্ন মৃত্যুর কথা ভাবিয়া আতঙ্কিত হইতেছে, হাহাকার করিতেছে, প্রতিটি পল-অনুপলকে জাপ্টাইয়া ধরিয়া রাখিতে চাহিতেছে। মৃত্যুর পূর্বে তাহারা সহস্র বার মরিতেছে। ইহাও তাহাদের শাস্তির অঙ্গ, হয়তো এই আতঙ্ক যাহাতে কিছুতেই এতটুকু এড়াইয়া না থাকা যায় সেই হেতুই তাহাদের একা করিয়া দেওয়া, কিন্তু এই পরিমাণ মানসিক পীড়ন সভ্য সমাজে কাহারও প্রতি রাষ্ট্র করিতে পারে কি না, সেই তর্ক ভিত্তিহীন নহে। তাহাদের সেল-এ থাকিবে চড়া আলো, প্রহরী থাকিবে সারা ক্ষণ, সম্ভবত তাহাদের আত্মহত্যার সম্ভাবনা বিনষ্ট করিতে। রাষ্ট্র যাহাদের ফাঁসিতে ঝুলাইবে ঠিক করিয়াছে, তাহাদের আত্মহত্যার অধিকার কাড়িয়া লইতেই হইবে, কারণ তাহারা নিজেরা কোনও ভাবে মৃত্যুবরণ করিলে তাহা এক রকম পলায়ন হইবে। এই সময় দণ্ডিতের প্রবল বিষাদ ও অবসাদে আচ্ছন্ন হইবার সম্ভাবনা থাকে, তাহা হইতে শারীরিক অসুস্থতারও সৃষ্টি হইতে পারে, তাই তাহাদের খাবার দেওয়া হইবে যথাসম্ভব সাদাসিধা ও মানসিক শুশ্রূষার জন্যই কাউন্সেলরের পরামর্শ। কোনও পরামর্শ বা ধর্মশ্লোক শ্রবণে সাধারণ মানুষ নিশ্চিত মৃত্যুর ভয় জয় করিতে পারে কি না, বা ভয় জয় করিবার প্রতি আদৌ তাহার মনোযোগ থাকে কি না, তর্কের বিষয়। কিন্তু রাষ্ট্রের এই কাজগুলি প্রায় সংবেদনশীল বলিয়াও চালাইয়া দেওয়া যায়।
হয়তো অনেকেই বলিবেন, যে তাহার শিকারের প্রতি নিগ্রহের সময় কোনও দয়ামায়া দেখায় নাই, তাহার প্রতি রাষ্ট্র দয়ামায়া দেখাইবে কেন। নির্ভয়ার মাতা পিতা বা অন্য আত্মীয়দের কথা না ভাবিয়া অকস্মাৎ চার অমানুষের কথা ভাবিতে বসিবার মধ্যে কি নিরাবেগ বুদ্ধিবিলাস নাই। কিন্তু কোনও প্রতিশোধস্পৃহা কি রাষ্ট্রের পক্ষে সমীচীন? রাষ্ট্র কেবল তাহার অসংখ্য সদস্যের সম্মিলন মাত্র নহে, তাহার অস্তিত্ব ইহার অধিক, তাহার কর্তব্য শ্রেয়তার প্রতি যাত্রা। লাল খামের ভিতর মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা যখন দণ্ডিতদের পরিবারের মানুষদের হাতে তুলিয়া দেওয়া হইবে, তাহাদের মানসিক অবস্থা বিচার করিবার দায়ও রাষ্ট্রের উপর বর্তায়। দণ্ডিতদের জামাকাপড়ের মাপ যখন লওয়া হইবে, ফাঁসির সময় তাহারা যে পোশাক পরিবে তাহা বানাইবার জন্য, তখন তাহাদের ভিতর পাকাইয়া কী ভাবে আত্মাটি গলা দিয়া উঠিয়া আসিতে চাহিবে তীব্র বিবমিষায়, তাহাও বিচার্য। চতুষ্পার্শ্বের তীব্র হিংসা ও চক্ষুর বদলে চক্ষু উপড়াইবার নিরন্তর মিছিলের মধ্যে সেই বিচারগুলি জাগ্রত থাকিবে, এমন আশা বৃথা, কিন্তু অধমতার উপশম কখনও অধমতা নহে, ইহা ইতিহাসের শিক্ষা।