মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলীয় জনসভায় ইভিএম বর্জনের ডাক দিয়াছেন। তাঁহার ঘোষণা, পুরসভার ভোট এবং পঞ্চায়েত ভোট ব্যালট বাক্সেই গৃহীত হইবে। প্রশ্ন হইল, তাঁহার এই ঘোষণা কি সমর্থনের যোগ্য? গত কয়েক বৎসর বিজেপির বিরুদ্ধে ইভিএম কারচুপির অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যালট বাক্সে ফিরিবার কথা শুনা গিয়াছে ঠিকই, কিন্তু এখনও কোনও অভিযোগ সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। উপরন্তু, শাসক দলের প্রত্যভিযোগটিও উড়াইয়া দেওয়া যায় না যে, ইভিএম হইতে কাগজের ছাপে ফিরিবার দাবি পরাজিত দলগুলি বরাবরই করিয়াছে। ২০০৯ সালে সাধারণ নির্বাচনে হারিয়া বিজেপি ইভিএম যন্ত্রে কারচুপির অভিযোগ করিয়াছিল। গত কয়েক বৎসরে বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনে, এবং এ বৎসর সাধারণ নির্বাচনে হারিয়াই কি কংগ্রেস-সহ বিরোধী দলগুলিও একই অভিযোগ তুলিতেছে? নিরপেক্ষ নাগরিক পড়িয়াছেন মহা মুশকিলে। ভাবিতে হইতেছে, যন্ত্রে কারচুপির দাবি কি কেবল পরাজিতের ব্যর্থ ক্ষোভ? না কি সত্যই প্রযুক্তির অপব্যবহার করিয়া জনমত বানচাল করিবার অভিযোগটি গুরুত্বের সহিত বিবেচনাযোগ্য? নির্বাচন কমিশন ২০১৭ সালে সকল রাজনৈতিক দলকে আহ্বান করিয়াছিল, ইভিএম যন্ত্রে কারচুপি করিয়া দেখাইয়া দিবার জন্য। ‘হ্যাক’ করিবার সেই আমন্ত্রণ কোনও দল গ্রহণ করে নাই। অবশ্যই ইহার অর্থ এই নয় যে, ইভিএম যন্ত্র সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। মহাকাশযান হইতে এটিএম, সকল প্রযুক্তির নিরাপত্তাতেই ছিদ্র বাহির হওয়া সম্ভব। অতএব বিবিধ প্রযুক্তির মধ্যে কোনটি অধিক গ্রহণযোগ্য, তাহাই ভাবা জরুরি। উত্তেজনার হুঙ্কার কিংবা ষড়যন্ত্রের আশঙ্কা, কোনওটি দিয়াই ইভিএম বনাম ব্যালট বাক্সের ধাঁধার সমাধান সম্ভব নয়।
ইভিএমের জায়গায় ব্যালট বাক্সের মতো নিম্নপ্রযুক্তির সমাধানে ফিরিবার কারণ কী হইতে পারে? মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দেন নাই, তবে দৃষ্টান্ত দিয়াছেন। পাশ্চাত্য দেশগুলি ব্যালট বাক্স ব্যবহার করে। তাঁহার অকথিত প্রশ্ন, উন্নত গণতন্ত্রে কাগজের ব্যালট গৃহীত হইলে ভারতে ইভিএম কী প্রয়োজন? উত্তরে বলা যায়, উন্নত গণতন্ত্র বলিয়াই বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, কিংবা ব্যালট-ভরা বাক্স কাড়িয়া পুকুরে ভাসাইবার কথা পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে অকল্পনীয়। ভারতে চিত্রটি ঠিক বিপরীত। বাহুবলী নেতাদের থেকে জনতার ভোটবাক্সকে বাঁচাইতে, জনগণের ভোটকে নিরাপদে রাখিতে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও ভোটদাতাকে এক কালে হিমশিম খাইতে হইয়াছিল। গত বৎসরের পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনেও নাগরিকের উপর হিংসার মূক সাক্ষী ছিল ব্যালট বাক্স। সুতরাং, এমন দেশে ভোটের নিরাপত্তার জন্য প্রযুক্তির আশ্রয় লইবার যুক্তিটি ফেলনা নহে।
হিসাবে রাখিতে হইবে ভারতের বিশাল জনসংখ্যাও। ইভিএম যন্ত্র দ্রুত ভোট গণনা করিয়া দেয়। ব্যালট বাক্সের ভোট গুনিতে হইলে প্রচুর কর্মদিবস লাগে। অর্থের অপচয় ঘটে। গণনায় ভ্রান্তি ও দুর্নীতি থাকিবার সম্ভাবনাও অধিক হয়। অপর দিকে, ইভিএম লইয়া নানা আপত্তি উঠিয়াছে বটে, কিন্তু এখনও কারচুপির নিশ্চিত প্রমাণ মেলে নাই। ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে ইভিএমের সুবিধাগুলি স্পষ্ট, সমস্যাগুলি নহে, আর ব্যালট বাক্সের অসুবিধাগুলি স্পষ্ট, সুবিধা কী তাহাই বোধগম্য নহে। সদ্যসমাপ্ত সাধারণ নির্বাচনে কুড়ি হাজারেরও অধিক ইভিএম যন্ত্রে গৃহীত ভোটের সহিত তাহার প্রমাণস্বরূপ কাগজ বা ‘ভিভিপ্যাট স্লিপ’ মিলাইয়া দেখা হইয়াছিল। নির্বাচন কমিশনের দাবি, একটি ক্ষেত্রেও গরমিল দেখা যায় নাই। অবশ্য নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা লইয়া এমনিতেই এ বার বহু প্রশ্ন উঠিয়াছে। সেই প্রশ্নের মীমাংসা ইভিএম পাল্টাইয়া হইবে না। সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে, প্রকৃত সমস্যাটি ইভিএম লইয়া নয়। সমস্যা আসলে রাজনীতির প্রকারটিকে লইয়াই।