ব্যক্তিগত তথ্য গোপন রাখিবার অধিকার কি মৌলিক অধিকার? এই প্রশ্ন লইয়া ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে আলোচনা চলিতেছে। নয় জন বিচারপতির একটি বেঞ্চ দুই পক্ষের মতামত শুনিতেছেন, নানা প্রশ্ন তুলিতেছেন। এই বিতর্কের সূত্রপাত আধার কার্ড প্রসঙ্গে। আধার কার্ড বাবদ প্রতিটি নাগরিকের অনন্য পরিচিতি সরকারের নিকট দাখিল করা বাধ্যতামূলক করা উচিত কি না— এই জিজ্ঞাসা হইতেই ব্যক্তিগত গোপনীয়তার (প্রিভেসি) অধিকারের মৌলিকত্ব বিষয়ক প্রশ্নটি ওঠে। প্রশ্নটি সংক্ষিপ্ত। কিন্তু ইহার সরল জবাব নাই। তবে এই বিষয়ে সওয়াল-জবাবের সূত্রে সরকারি প্রতিনিধি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলিয়াছেন: গোপনীয়তার অধিকারটি একটি সম্পূর্ণ ‘শর্তাধীন’ (কোয়ালিফায়েড) মৌলিক অধিকার— তাহার অনেকগুলি দিক রহিয়াছে, সব কয়টি দিক মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পাইবার যোগ্য নহে।
দ্বিতীয় এক প্রশ্নও এই বিতর্কে বড় আকারে উঠিয়া আসিয়াছে: সরকার আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করিলে গোপনীয়তায় ব্যাঘাত ঘটিতে পারে— এই আশঙ্কা কতটা সংগত, কতটাই বা গ্রহণযোগ্য? আধার কার্ডে ব্যক্তিগত তথ্য দিলেই তাহা জনপরিসরে প্রকাশ হইয়া যাইবে বা সরকার তাহার অপব্যবহার করিবেই— এমন নহে। সরকার সেই তথ্য যথেষ্ট সুরক্ষিত রাখিবে বা রাখিতে পারিবে কি না, সেই প্রশ্ন গুরুতর। অন্য দিকে, সরকার আধার কার্ডের মাধ্যমে দরিদ্রদের ভাতা বিতরণের ও অন্যান্য সুবিধার সরাসরি ব্যবস্থা করিয়াছে। এই সব সুবিধা নানা ক্ষেত্রেই দরিদ্রদের নিকট পৌঁছায় না, দালালরা আত্মসাৎ করিয়া লয়। আধার কার্ড থাকিলে সেই ত্রুটি কমিতে পারে। গোপনীয়তার মুখ চাহিয়া আধার কার্ডের মাধ্যমে সুবিধা বণ্টনের ব্যবস্থাটি কার্যকর না হইলে দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হইবেন। সুতরাং প্রশ্ন উঠিবেই, দরিদ্রদের নিকট সরকারি সুবিধা পৌঁছানো জরুরি, না কি গোপনীয়তার মৌলিক অধিকারের দার্শনিক দাবি পূরণ করা।
সুপ্রিম কোর্টে আলোচনা ও বিতর্কের এই প্রক্রিয়াটি একটি অতি মূল্যবান উপলব্ধির সম্মুখে নাগরিকদের দাঁড় করাইয়া দেয়: সব প্রশ্নের উত্তর, হ্যাঁ বা না— এই দুই চূড়ান্ত অবস্থানে হয় না। এবং, বিশেষত সেই কারণেই, বিতর্কিত বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পূর্বে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন। তাহা সরকারের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনই প্রযোজ্য প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে। নিজের বা একটি গোষ্ঠীর বোধবুদ্ধির ভিত্তিতে লওয়া সব সিদ্ধান্তই যে উপযোগী হইবে, এমনটা নহে। বরং বিনা প্রশ্নে কোনও সিদ্ধান্ত চাপাইয়া দিলে বা মানিয়া লইলে বিষয়ের গভীরতায় পৌঁছানো যায় না। এই ক্ষেত্রে যেমন আদালতে সওয়াল-জবাবের মধ্য দিয়াই সরকার পক্ষ ‘গোপনীয়তা মৌলিক অধিকার নহে’— এই অবস্থান হইতে বেশ কিছুটা সরিয়া আসিয়াছে। যুক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে অবস্থান পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়াটি যথার্থ উদার গণতন্ত্রের এক আবশ্যিক অভিজ্ঞান, এবং তাহার শর্তও। কথাটি শাসকদের উপলব্ধি করা বিশেষ আবশ্যক। তাঁহাদের বোঝা উচিত যে, কাশ্মীর অথবা গোমাতা, হিন্দুত্ববাদ কিংবা শিক্ষা নীতি— যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পূর্বে মতামত আদানপ্রদানের প্রয়োজন। সেই প্রক্রিয়াতেই নিহিত থাকে গণতন্ত্রের প্রাণ।