শান্ত হয়ে উঠুক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী

বারুদের গন্ধ আর বন্দুকের শব্দে ত্রস্ত কাশ্মীরের কপাল বেয়ে এতগুলো বছর তো পেরিয়ে গেল! কিন্তু মূল সমস্যার ছিটেফোঁটারও অবসান ঘটানো গেল কি? লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্যবারুদের গন্ধ আর বন্দুকের শব্দে ত্রস্ত কাশ্মীরের কপাল বেয়ে এতগুলো বছর তো পেরিয়ে গেল! কিন্তু মূল সমস্যার ছিটেফোঁটারও অবসান ঘটানো গেল কি?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৯ ০১:০৮
Share:

ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি কিন্তু দেশের সংহতি এবং সমতার পক্ষেই সায় দেয়। জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র মূল্যবোধের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয় দেশের অখণ্ডতা ও সংহতিকে। ফলে ৩৭০ ধারার এই বিলুপ্তির পক্ষে বর্তমান ভারত রাষ্ট্র এই ব্যাখ্যা দিতেই পারে যে, অতীতে সম্পাদিত কোনও ভুলের জের টানার থেকে রাষ্ট্রশক্তির কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দেশের সংহতি ও সমতা রক্ষা করা এবং ভারত রাষ্ট্রের আইনের শাসন তার অধীনস্থ সকল রাজ্যগুলোতেই কায়েম করা।

Advertisement

সেই অর্থে সংবিধানের ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি ছাড়া অন্য কোনও উপায়ও ছিল না। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও পাল্টা যুক্তি অঙ্কুরিত হয়। গোয়া, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব এবং উত্তর-পূর্বের বেশ কিছু রাজ্য সংবিধানের ৩৭১ ধারার বলে বেশ কিছু পৃথক সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসছে। এমনকি উত্তর-পূর্বের কিছু রাজ্যে ভারতের অন্য রাজ্যের নাগরিকদের প্রবেশের ক্ষেত্রেও কিছু বিধিনিষেধ এখনও বলবত রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের নাগরিক হিসেবে এই প্রশ্ন মনের আনাচকানাচে উঁকি দিতেই থাকে যে, তবে কি এই সব ক্ষেত্রেও রাষ্ট্রের একতা, সংহতি এবং সমতার জিগির তুলে সেই সব সুযোগ-সুবিধা এবং বিধি-নিষেধ অচিরেই বিলোপ করা হবে?

যদিও এই সব বিধি-নিষেধের পক্ষে জাতিসত্তা সংরক্ষিত রাখার বিষয়টিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তবে তো সংবিধানের ৩৫ এ ধারার অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীরিদের জাতিসত্তাও প্রবল ভাবে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে! ফলে একই যুক্তির ওপর ভিত্তি করে দু’ধরনের ব্যবস্থা জারি কিন্তু রাষ্ট্রের সুবিধাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং প্রতিহিংসাপরায়ণতার রাজনীতির পক্ষেই সায় দেয়।

Advertisement

এ কথা সর্বৈব সত্য যে, ১৯৪৯ সালে যখন জম্মু-কাশ্মীরে জন্য সংবিধানের ৩৭০ ধারা বলবত করা হয়, তখন বিষয়টি ভারতীয় পার্লামেন্টের কোনও কক্ষেই আলোচিত হয়নি এবং এই ৩৭০ ধারা ভারতীয় সংবিধানে ‘সাময়িক’ হিসেবেই চিহ্নিত করা আছে। অর্থাৎ জম্মু-কাশ্মীরের জন্য সংবিধানের ৩৭০ ধারার প্রয়োগ আদপে একটি অস্থায়ী বন্দোবস্ত হিসেবেই লাগু ছিল। সেহেতু ৩৭০ ধারার বিলুপ্তি আসলে সেই সাময়িক বন্দোবস্তটিরই সমূলে উৎপাটন, কিন্তু কোন গণভোটের পরিকল্পনা ছাড়াই!

১৯৬৯ সালে, সম্পৎ প্রকাশ মামলায় দেশের শীর্ষ আদালত সংবিধানের এই ৩৭০ ধারাকে সাময়িক বলে মানতে অস্বীকার করে। পরবর্তী কালে, ২০১৭ সালে দিল্লির উচ্চ আদালত এবং ২০১৮ সালে দেশের শীর্ষ আদালত জানিয়ে দেয় যে, শিরোনামে ‘সাময়িক’ বলে লেখা থাকলেও সংবিধানের এই ৩৭০ ধারা সাময়িক নয়।

এ কথাও সত্য যে, অনুচ্ছেদ ৩৭০-এর মধ্যেই এর বিলোপ পদ্ধতির নিদান দেওয়া আছে। ফলে ভারত সরকার লোকসভা এবং রাজ্যসভায় কোনও রকম আলোচনা না করেই শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরিত আদেশনামার ভিত্তিতে সংবিধানের ৩৭০ ধারার যে বিলোপ ঘটাল, তা ৩৭০ ধারার ৩ অনুচ্ছেদ মোতাবেকই করা হয়েছে বলে দাবি। ১৯৪৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা যখন জম্মু-কাশ্মীরের জন্যে বলবৎ করা হয়েছিল, তখনও একইরকম ভাবে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে রাষ্ট্রপতির আদেশনামার মাধ্যমেই সংবিধানে ৩৭০ ধারার অন্তর্ভুক্তি হয়।

যদিও ৩৭০ ধারার বিলুপ্তির ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদের সম্মতি গ্রহণ প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরে গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘটে গিয়েছে সেই ১৯৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারি। সে ক্ষেত্রে হয়তো জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভার সম্মতি গ্রহণ করলে বিষয়টি অধিকতর আইনসিদ্ধ হতো, কিন্তু বর্তমানে জম্মু-কাশ্মীরে বিধানসভার অস্তিত্ব নেই। ফলে, ৩৭০ ধারার বিলোপের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের সেই পথে হাঁটার প্রয়োজন পড়েনি। তবে পদ্ধতিটা নিখুঁত ভাবে আইনসিদ্ধ কি না সে কথা বলার এক্তিয়ার মহামান্য আদালতেরই আছে।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, ৭০ বছর ধরে কার্যকরী একটি পরম্পরা (সে ঠিক হোক, বা ভুল) জনপ্রতিনিধিদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে, গোটা কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ রেখে, কোনও রকম আগুপিছু না ভেবে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অফিস ঘরের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা কি আদৌ ঠিক হল? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আছে শুধু অমোঘ সময়ের।

অন্য দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করলে, কাশ্মীরে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারার ৭০ বছরের কার্যকারিতার ফলস্বরূপ সেখানকার আম নাগরিকদের মধ্যে কোনও ভাবেই ভারতীয়সত্তার মূল প্রবেশ করানো সম্ভব হয়নি। বরং এত বছর ধরে ভারতীয় সংবিধানের এই ৩৭০ ধারা কাশ্মীরিদের মধ্যে কাশ্মীরি সত্তাকেই প্রবল ভাবে প্রোথিত করে রেখেছিল। ফলে এ কথা মনে করা যেতেই পারে যে, সংবিধানের ৩৭০ ধারার এই অবলুপ্তি কাশ্মীরিদের কাশ্মীরি সত্তার বেড়ি ডিঙিয়ে ভারতীয় সত্তার গর্ভগৃহে প্রবেশকে অনেকটাই সুনিশ্চিত করতে পারবে। কিন্তু সেখানেও বিস্তর প্রশ্ন থেকে যায়।

উত্তরণ প্রক্রিয়ায় কাশ্মীরিদের কোনওরকম ভাবে অন্তর্ভুক্ত না করে, তাঁদের অবরুদ্ধ রেখে কি কাশ্মীরিদের ভারতীয় সত্তায় উত্তরণ আদৌ সম্ভব? এতগুলো বছর তো পেরিয়ে গেল বারুদের গন্ধ আর বন্দুকের শব্দে ত্রস্ত কাশ্মীরের কপাল বেয়ে। কিন্তু মূল সমস্যার ছিটেফোঁটারও অবসান ঘটানো গেল কি?

তবে কি বন্দুক আর বারুদ পেরিয়ে অন্য কোনও বন্ধনশক্তি কোনও এক দিন মিলিয়ে দেবে আম কাশ্মীরিদের আম ভারতবাসীর আবেগের তরঙ্গে! অনেক রক্তস্রোত বয়ে গিয়েছে ঝিলাম বেয়ে। অশান্ত কাশ্মীর শান্ত করার ব্রত নিয়ে কর্মরত ভারতীয় সেনার পরিজনদের উৎকণ্ঠিত হৃদকম্প সকল সহ্যের সীমাকে অতিক্রম করে গিয়েছে। আজ স্তব্ধ হয়ে যাক সব রক্তের নদী-উপনদীর ধারা প্রবাহ। পথ খুঁজতে হবে মানবিক মনন নিয়ে। এক প্রবল মিলনোচ্ছ্বাস এসে মিলিয়ে দিয়ে যাক কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীব্যাপী আমাদের সাধের অখণ্ড ভারতবর্ষকে।

(লেখক শিক্ষক, মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement