সম্পাদকীয় ২
Pariksha Pe Charcha-2020

নব্য-স্বদেশি

তখন হইতে ভারতীয়রা শুধুমাত্র দেশজ পণ্যই কিনিবে? ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে উৎসাহ দিবে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০০
Share:

দেশে কি বিদেশি বর্জনের যুগ ফিরিয়া আসিতেছে? ‘পরীক্ষা পে চর্চা’য় ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর কথোপকথনে অন্তত তেমনই ইঙ্গিত। মোদী প্রশ্ন করিয়াছেন, ভারতীয়রা কি সিদ্ধান্ত করিতে পারে যে ২০২২ সালে দেশের স্বাধীনতা যখন পঁচাত্তর বৎসর পূর্ণ করিবে, তখন হইতে ভারতীয়রা শুধুমাত্র দেশজ পণ্যই কিনিবে? ‘মেক-ইন-ইন্ডিয়া’ প্রকল্পে উৎসাহ দিবে? প্রধানমন্ত্রীর এহেন প্রশ্নের আড়ালে নির্দেশটিও স্পষ্ট— অতঃপর, ভারতীয়দের বিদেশি দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণ কমাইয়া স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের অভ্যাস করিতে হইবে। প্রধানমন্ত্রীর কথায় বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তী যুগের কথা মনে আসিতে পারে। মনে হইতে পারে, অধিকাংশ সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের পশ্চাতে যে জাতীয়তাবাদের অজুহাত সচরাচর প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁহার দল টানিয়া আনেন, সেই দেশপ্রেমই এই বিদেশি বর্জনের মূলে।

Advertisement

তাহা মোড়কমাত্র। ইহার পশ্চাতে রহিয়াছে অর্থনীতির ভ্রান্ত অঙ্ক। প্রধানমন্ত্রীর যুক্তিতে, নাগরিক যদি বিদেশি পণ্যের পরিবর্তে দেশি পণ্য ব্যবহার করিতে শুরু করে, তাহা হইলে দেশের অর্থনীতির ভিত্তিটি মজবুত হইবে। রূপায়ণের ছয়টি বৎসর পার করিবার লগ্নে মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের ব্যর্থতা প্রশ্নাতীত। ক্ষমতায় আসিয়া মোদী ভারতকে এক আন্তর্জাতিক মানের উৎপাদন ক্ষেত্রে পরিণত করিবার স্বপ্ন দেখাইয়াছিলেন। ইহার জন্য বিদেশি সংস্থাদের আহ্বান করা হইয়াছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য। সেই উদ্যোগ কার্যত ধরাশায়ী। কারণ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা থাকিলে তবেই তাহা বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। নোটবাতিল এবং জিএসটি চালুর মাধ্যমে যে ধাক্কা দেশের অর্থনীতিতে লাগিয়াছিল, তাহা সেই স্থিতাবস্থাকে সম্পূর্ণ নষ্ট করিয়াছে। অর্থনীতিতে মন্দার লক্ষণ স্পষ্ট। বিদেশি বিনিয়োগের অপর শর্তটি, রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাও বিপর্যস্ত। সময়ের সঙ্গে সেই অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পাইতেছে। সর্বোপরি, অ্যামাজ়নের শীর্ষকর্তা জেফ বেজ়োসের আরও একশত কোটি টাকা লগ্নির প্রস্তাবে দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী যে চূড়ান্ত ঔদ্ধত্য দেখাইয়াছেন, তাহাতে স্পষ্ট যে বৃহৎ ব্যবসা বা বিনিয়োগের প্রতিও দেশের সরকারের মনোভাব সর্বদা ইতিবাচক নহে। এমতাবস্থায় একটি ব্যর্থ প্রকল্পের পালে হাওয়া দিবার জন্য মেক-ইন-ইন্ডিয়ার সঙ্গে ‘জাতীয়তাবাদী কর্তব্য’-এর কথাটি জুড়িয়া দেওয়া ভিন্ন প্রধানমন্ত্রীর উপায় নাই!

সমস্যা একটাই, বাজার ব্যবস্থা জাতীয়তাবাদ দ্বারা চালিত হয় না। তাহার প্রধান শর্তই হইল, ক্রেতা দাম এবং গুণাগুণ বিচার করিয়া তাঁহার রুচি, পছন্দ অনুযায়ী সেরা পণ্যটি বাছিয়া লইবেন। তাহা দিশি হইলে দিশি, বিদেশি হইলে বিদেশি। ভোগব্যয় বাড়িলে জাতীয় আয়ও বাড়ে— ব্যয়টি দেশি পণ্য কিনিতে হইয়াছে না বিদেশি, সেই বিচার না করিয়াই। সুতরাং, দেশি পণ্য কিনিলে অর্থনীতি মজবুত হইবার তত্ত্বটি অবান্তর। মেক ইন ইন্ডিয়াকে সফল করিতে হইলে ক্রেতাকে দেশি পণ্য কিনিতে বাধ্য করা নহে, প্রয়োজন ভারতীয় উৎপাদনক্ষেত্রের সার্বিক কুশলতা বৃদ্ধি। ভারতীয় পণ্যকে আন্তর্জাতিক মানের করিয়া তুলিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করা হউক, দেশের শ্রমশক্তির কুশলতা বৃদ্ধি করা হউক, তাহার জন্য শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় ব্যয়বরাদ্দ করা হউক। ইহার পরিবর্তে জাতীয়তাবাদে সুড়সুড়ি দিয়া মেক-ইন-ইন্ডিয়া সফল করিবার চাতুর্যটি ধোপে টিকিবে না।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement