হঠাৎ চলে গিয়েছেন অভয় খাখা, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। সমাজবিদ্যাচর্চার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব, আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে গভীর ভাবে যুক্ত ছিলেন। সর্বোপরি, খাখা ছিলেন কবি। স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, আদিবাসীরা গবেষণার ‘ডেটা’ নন। তাঁদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে না পারলে তথ্য আর তত্ত্ব মূল্যহীন। সুধা ভরদ্বাজকে নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রথমেই খাখার কথা মনে হয়, কারণ সুধা সেই মানুষ যিনি নিরলস ভাবে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে পাশে দাঁড়ানোর কাজটি করে গিয়েছেন। জেলবন্দি হবার সময় পর্যন্ত।
সুধা প্রায় দু’বছর জেলবন্দি। তাঁর সঙ্গে আছেন একই মামলায় অভিযুক্ত সোমা সেনও। মাত্র দু’সপ্তাহ আগেও সুধার অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের আবেদন নাকচ হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজের ধারায় নানা অভিযোগ আনা হয়েছে, যদিও তার কোনওটার সমর্থনেই এখনও আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণ দাখিল করেনি পুলিশ। তিনি নাকি সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছেন, যে চক্রান্ত সফল হলে দেশের সার্বভৌমত্ব বিপদে পড়বে। আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের কর্মী সম্পর্কে এ রকম অভিযোগে খটকা লাগাটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতায় জেগে ওঠে সন্দেহ। কেউ নিজের উন্নতি আর স্বার্থসিদ্ধির নকশার বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারেন, অতি-অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত লড়ে যেতে পারেন, বিশ্বাস করতে অস্বস্তি হয়। সুধা ‘সুবিধের লোক’ নন ভাবলে আমাদের সুবিধে হয় জোর গলায় সওয়াল করতে, মধ্যবিত্ত করদাতার টাকায় আদিবাসী ছেলেমেয়েরা কেন উচ্চশিক্ষা পাবে? এ দিকে সুধার উল্টো প্রশ্ন, কেন সেই সব ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েরা ন্যূনতম নাগরিক অধিকার পাবেন না, কেন জমির পর জমি বহুজাতিক কোম্পানি প্রায় বিনামূল্যে আত্মসাৎ করবে, প্রতিবাদ করতে গেলেই কেন জুটবে পুলিশের লাঠি, গুলি, বিনা বিচারের বন্দিত্ব!
সুধার এত কিছু করার দরকার ছিল না। জন্মসূত্রে তিনি মার্কিন নাগরিক। তাঁর জন্মের কিছু দিন পরে পরিবার চলে আসে ইংল্যান্ডে। সুধার বয়স যখন এগারো, তাঁর মা কৃষ্ণা ভরদ্বাজ দেশে ফিরে পড়াতে শুরু করেন জেএনইউ-তে। সুধা পড়েন কানপুর আইআইটি-তে। ওই পাঁচ বছরেই পরিচিত হন উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের শ্রমিকদের সম্পর্কে। আঠারো বছরে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেন মার্কিন নাগরিকত্ব। পড়া শেষ করে যান মধ্যপ্রদেশে শঙ্কর গুহনিয়োগীর ছত্তীসগঢ় মুক্তি মোর্চার সঙ্গে কাজ করতে। আইন পাশ করেন: অধিকার আন্দোলনে আইনের জ্ঞানের মূল্য অসীম।
পড়াশোনা ও সহমর্মিতা, দুই হাতিয়ার নিয়ে সুধা মধ্যপ্রদেশের গ্রামে কাজ করতে থাকেন। সাধারণ শাড়ি-পরা ‘সুধাদিদি’ অগণিত মানুষের ভরসা হয়ে ওঠেন। তাঁর ৯০ শতাংশ সতীর্থ বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্যে পাড়ি দিয়েছেন, বিদেশে থেকে গিয়েছেন। সুধা তা চাননি। যে দেশের নাগরিকত্ব যেচে নিয়েছেন, তার প্রতি তাঁর কিছু দায়িত্ব রয়েছে, বলেছেন তিনি। এই ভাবনাটাই তো মধ্যবিত্তের কাছে সন্দেহজনক।
‘পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টি’-র সদস্য সুধার ‘জনহিত’ নামের সংগঠন সুলভে আইনি সাহায্য করে আদিবাসী ও খেটে-খাওয়া মানুষকে। পুলিশের চোখে তিনি ‘প্রতিষ্ঠানবিরোধী’, টানা সাঁইত্রিশ বছর ক্ষমতাসীনের বিরোধিতা করেছেন। কী সাহস লাগে এই কাজে, বলে দিতে হবে না।
সেই সাহসের পুরস্কার— আজ তিনি জেলে। তাঁর ‘নাশকতামূলক’ কাজকর্ম থেকে দেশকে বাঁচাতে পুলিশের আইনজীবী বলেছেন, সুধা-সহ ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্তরা একটি ‘ফাসিস্ট-বিরোধী ফ্রন্ট’ খুলেছিলেন, যা দেশের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করেছে। সুধার আইনজীবী আদালতে প্রশ্ন করেন, ফাসিস্টদের বিরোধিতাই কি নাগরিকের কর্তব্য নয়? উত্তর মেলেনি। জামিনও না।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস বলে, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি কঠোর হাতে দমন করেছে তাঁদেরই, যাঁরা রাষ্ট্রচালনার মুল বিধিগুলিকে প্রশ্ন করেছেন। স্বাধীন গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধান প্রতিবাদকে অধিকার রূপে গণ্য করে। সংবিধানে বাক্-স্বাধীনতার অধিকার সেই জন্যই। সামাজিক ন্যায়ের দাবিতে সংগঠিত প্রতিবাদ আন্দোলন থেকে যে কণ্ঠস্বরগুলি উঠে এসেছে, তাদের প্রতি রাষ্ট্রের আচরণ তা হলে এমন কঠোর, নিষ্ঠুর কেন?
আসলে প্রতিবাদ আন্দোলনের কর্মীদের দেশের নিরাপত্তার জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে দাগিয়ে দিতে পারলে, প্রতিবাদের অধিকারটা নিরাপত্তার ঢক্কানিনাদে চাপা পড়ে যায়। সত্তর দশকে জরুরি অবস্থা জারির পিছনেও ছিল একই যুক্তি। এখন তো জরুরি অবস্থাও লাগছে না। টিভিতে ‘ব্রেকিং নিউজ়’ আর দেশভক্তি প্রচার করেই আইনরক্ষকদের হাতে তুলে দেওয়া যাচ্ছে প্রতিবাদীদের।
এই দেশে বসে সুধা ভরদ্বাজকে প্রতি দিন মনে করা দরকার। ন্যায়ের দাবির প্রতি রাষ্ট্র সংবেদনশীল না হলেই যে দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, সে সত্যটা জেলের ভিতর থেকে সুধা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
নারীবিদ্যা বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়
(মতামত ব্যক্তিগত)