বাউলের আখড়ায়। ফাইল চিত্র
সংস্কৃতি মানে কৃষ্টি, মানে ‘কালচার’। তার আবার বিভাজন রয়েছে—শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত ইত্যাদি। এখানে যা নিয়ে আলোচনা করতে চাই, তা হল লোকসঙ্গীত, যা এসেছে লোকসংস্কৃতি থেকে। ‘লোক’ অর্থে সমষ্টি, ব্যক্তি নয়। তাই যা কিছু লোকনির্ভর, তাই লোকসংস্কৃতি। সেই হিসেবে যে কোনও দেশের লোকসংস্কৃতি ধরে রাখে লোকসমাজের নানামুখী উৎকর্ষকে। সেই উৎকর্ষ বিশেষ ভাবে ধরা পড়ে তার শিল্পে, সাহিত্যে, সঙ্গীতে।
পরম্পরাগত ভাবে বাক্কেন্দ্রিক লোকসঙ্গীত বা লোকগীতি বহুমুখী লোকসাংস্কৃতিক উৎকর্ষের অন্যতম প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আসলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠেছে এই সব গান। এগুলির বেশির ভাগই ঋতুপ্রধান—যেমন শীতে টুসু, ভাদ্রে ভাদু, গ্রীষ্মে গম্ভীরা, শ্রাবণে মনসার গান ইত্যাদি। এই সব গানে সুর-বৈচিত্রই প্রধান, যা উঠে এসেছে লোকবাংলার জল-মাটি-বাতাসবাহিত স্নিগ্ধতায়। সেই সুর তাই অতি চেনা। কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামনির্ভর জীবনধারা এর অন্যতম ভিত্তি, যা ঐতিহ্যের অনুসারী ও সমসাময়িক।
প্রকৃতপক্ষে এই সব গানের প্রয়োগগত বৈশিষ্ট্যই আলাদা, যা একই সঙ্গে আবেগপ্রবণ ও বক্তব্য-অনুসারী। সে কারণে যে কোনও লোকগানের আবেদন কম গুরুত্বের নয়, কম গুরুত্ব নয় পাঁচমেশালি সুরের বৈচিত্রও। পাঁচালি, কীর্তন, বাউল, মাঝিকণ্ঠের সেই সুর ঢুকে গিয়েছে আমাদের সমাজপ্রবাহে। তবে কালের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই সব গানেও এসেছে বিবর্তন।
তবে সেই বিবর্তন এতটাই বিপরীতমুখী যে, তা আমাদের ভাবিত করছে। ভাবাচ্ছে তামাম বাংলার সঙ্গীতরসিকদেরও। অনেকেরই মত, এখন এই গান অনেক বেশি শিথিল, অবিন্যস্ত। ঠাস বুননের অভাব ধরা পড়ছে সুরেও। বড় বেশি পাশ্চাত্য প্রভাব! স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, দেশীয় সুর-ঝঙ্কার কি সত্যিই শ্রোতাদের আর নাড়া দিচ্ছে না। তাই কি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যকে আহ্বান জানানো? আমাদের কিন্তু তা একবারও মনে হয়নি। বরং লোকগানের আসরে ভাদু, টুসু, ডোমনি, খনা ও মনসার গানের অভাব ইদানীং বড় বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।
লোকগীতির নামে তাই আমরা কী আমদানি করছি, তা ভাবার সময় এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই চটুল অভব্য গান, যা কোনও কৃষ্টির চিহ্ন রাখে না, শুধু হাততালি কুড়োয়, তা-ই আমরা লালন করছি ঐতিহ্যের নামে। একমাত্র বাউল ও সুফি সম্প্রদায়ের মধ্যে এখনও কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তবুও এঁদের অনেকে অর্থের কারণে পথভ্রষ্ট হচ্ছেন। বিদেশি অর্থের লোভ আর ‘হিপি কালচার’ এঁদের ভাসিয়ে দিয়েছে অনেকটা। তারই মধ্যে কেউ কেউ প্রাণপণে ঠেলে চলেছেন ভাঙা নৌকা। ভরসা তাঁদের উপরেই।
যে কয়েকজন শিল্পী এই সব গানের চর্চায় মনপ্রাণ ঢেলে কিছুটা সুস্থ আলো-বাতাস ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছিলেন, নির্মলেন্দু চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। তিনি আজ প্রয়াত। তাঁর পুত্র পিতার পথ অনুসরণ করে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও অনেকের মতে, তাঁর গানে মাটির গন্ধ তেমন নেই। কৃত্রিমতার স্বাদই বেশি। আর্য চৌধুরী কিছুটা চেষ্টা চালিয়েছিলেন আসল গানের পুনরুদ্ধারে। এখন উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, গম্ভীরা ইত্যাদি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করতে দেখছি সুখবিলাস বর্মাকে। পুরুলিয়া-বাঁকুড়ায় ভাদু-টুসুর চল ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালাচ্ছেন সুভাষ চক্রবর্তী। পাশাপাশি, স্বপন বসু, রঞ্জন প্রসাদেরও দেখা যাচ্ছে নাগরিক জীবনে লোকগান পরিবেশনায় ব্রতী হতে।
লোকগানের চর্চা বাড়ছে। কিন্তু তবু একটা হতাশা। এ কোন লোকগান? এই গানের কোথাও তত্ত্বগত গভীরতা নেই—‘তুমি সর্প হইয়া দংশন কর গোরা/ ওঝা হইয়া ঝাড়ো রে।’, যা অনায়াসে পৌঁছে দেয় জ্ঞান-নির্ভর এক বিদ্যায়তনিক ভাবনায়। এখনকার গানে সত্যিই সেই ভাবনার অভাব। কথাতেও তেমন যুক্তি নেই, সুরেও নেই তেমন দোলা। কেবলই চটুলতা আর রঙ্গরস।
রসের ভিয়েনটা অবশ্যই দরকার। কিন্তু অতি রঙ্গ ভাল নয় বঙ্গের কাজলে। যেমন, ‘ও ননদী’ গানটি খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। শিল্পীর গায়কীও মন্দ নয়। তবে কথাগুলি কি খুবই গভীরতাবহ, সন্দেহ জাগে। বেশ হাল্কা গানের কথা। অথচ আমরা খুঁজি ‘কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল গো।’— সেই মরমে পশিবার মতো গানের কথার বড়ই অভাব আজ, বিশেষ করে লোকগানে।
কিন্তু সে কালের সাধারণের প্রচলিত কথায় উঠে এসেছিল কত বড় কথা—‘ফান্দে পইড়া বগা কান্দে রে।’ এ সব ভাবলেও এখন কষ্ট হয়। প্রশ্ন জাগে, লোকগানের চর্চায় আমরা কি তবে পিছু হঠছি। নাকি, আধুনিকতার জগঝম্প বাজিয়ে বিপদঘণ্টা বাজাচ্ছি আসল লোকগানের। বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে। নইলে ‘বড় দেরি হয়ে গেছে’ বলে এক দিন হাপিত্যেশ করতে হবে আমাদের। এ বিষয়ে লোকসংস্কৃতির গবেষকেরা ভাবুন, এটাই দাবি।
লেখক বিষ্ণুপুরের সাহিত্যকর্মী