কল্পনা করুন, কোনও এক অঞ্চলে একশোটা লোকের একশোটা পুকুর রয়েছে। কোনও না কোনও উপায়ে তার মধ্যে নব্বইটা দখল করলাম আমি। বাকি ৯৯ জন বাধ্য হলেন দশটা পুকুর ভাগাভাগি করে কাজ চালাতে। এ বার ধরা যাক, কোনও এক বিপর্যয়ে দশটা পুকুর নষ্ট হয়ে গেল, পাঁচটা আমার, পাঁচটা অন্যদের। কী করে এর মোকাবিলা করা যাবে? আমি এগিয়ে এসে কর্তাদের বললাম, আমি সহায়তায় রাজি (যেমন, ওই ৯৯ জনের কয়েক জনকে আমার পুকুরগুলোতে কাজে লাগাব)। সেই সঙ্গে এ-ও মনে করালাম যে, ওঁদের মতো আমারও পুকুর নষ্ট হয়েছে। আমি ওঁদের সাহায্য করছি, তার জন্য আমাকেও কিছু সহায়তা করতে হবে। কর্তারা আমাকে বাস্তবিক দেশপ্রেমী বলে বাহবা দিলেন, এবং আমাকে কিছু সরকারি সুযোগ সুবিধেও দিতে সম্মত হলেন। তার ফলে যে এখন আমার পুকুরের সংখ্যা দাঁড়াল নব্বইয়ের মধ্যে পঁচাশি, সেটা কোথাও উল্লিখিত হল না।
এ বার ভাবুন, আপনি বাকি ৯৯ জনের এক জন, যাঁরা পাঁচটি পুকুর ভাগাভাগি করছেন। কিংবা বাইরের কোনও গ্রহ থেকে আপনি পুরো বিষয়টা দেখছেন। এমন সমাজ সম্পর্কে কী ধারণা হবে?
তার একটা উত্তর, এই সমাজ ধনীদের আতুপুতু করে রক্ষা করে, আর গরিবকে বলে ‘আত্মনির্ভর’ হতে। ভারতের সমাজকে এমন সমাজ বললে ভুল হবে না। দু’টি তথ্য: এক, ভারতের বৃহত্তম (এনআইএফটিওয়াই ৫০) কোম্পানিগুলিতে শীর্ষ ম্যানেজারদের সঙ্গে কর্মীদের গড় বেতনের অনুপাত। দুই, নির্মাণক্ষেত্রে নেট যুক্ত-মূল্যে লাভের অংশ।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে আপৎকালীন পরিস্থিতি, অর্থনীতিতে বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে, লকডাউন এক মানবিক সঙ্কটও তৈরি করেছিল। তখন সরকারের কাছে ছাড়, ভর্তুকি প্রভৃতি বিশেষ সুবিধা দাবি করে সবচেয়ে বেশি সরব হয়েছিল কর্পোরেটগুলো। কর মকুব, কিংবা শ্রম আইনের বিধি শিথিল, কিংবা সহজ শর্তে ঋণ— সব দাবির পিছনেই তাদের যুক্তি ছিল এই যে, এই সুবিধাগুলো পেলে তবেই তারা ধসে-পড়া অর্থনীতিকে ফের খাড়া করার কাজে (যেমন, কর্মী ছাঁটাই না করে) অংশগ্রহণ করতে পারবে। প্রকৃতপক্ষে তারা যা বলছে তা হল, বেহাল অর্থনীতির জন্য আমরা দায় বহন করতে পারব না। যদি প্রত্যাশা করো যে, কর্মীদের বেতন দিয়ে যাব, তা হলে সরকারকে তার খরচ বহন করতে হবে।
কোনও সংস্থার শীর্ষ কর্তার বেতনের সঙ্গে গড় বেতনের অনুপাত (‘পে রেশিয়ো’) হল সংস্থার মধ্যে বেতন-অসাম্যের একটা পরিমাপ। অনুপাত যদি হয় ২, তার মানে শীর্ষ কর্তা মাঝারি (গড়) বেতন-পাওয়া কর্মীর দ্বিগুণ পান। বৃহত্তম পঞ্চাশটি সংস্থার মধ্যে সর্বাধিক অসাম্য এক মোটরসাইকেল তৈরির সংস্থায়, যেখানে শীর্ষ কর্তার বার্ষিক বেতন ছিল ৮৪.৬ কোটি টাকা, যা গড় বেতনের ৭৫২ গুণ। সবচেয়ে কম অসাম্য ছিল একটি গাড়ি তৈরির সংস্থায়, সেখানে ওই অনুপাত ১:৩৯। গড় অনুপাত ১:২৬০। পনেরোটি কোম্পানির ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, শীর্ষ কর্তার বেতন বৃদ্ধির হারও অধিক, গড় বেতন বৃদ্ধির হারের থেকে। যার অর্থ, অসাম্য বাড়ছে। এই অসাম্যকে ‘অশ্লীল’ ছাড়া আর কিছু বলা চলে না, কারণ জাতীয় নমুনা সমীক্ষা (২০১৭-১৮) থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে পুরুষকর্মীদের কেবলমাত্র সতেরো শতাংশ মাসে দশ হাজার টাকার বেশি আয় করেন।
আরও একটি পরিসংখ্যান এই অসাম্যকে নির্দেশ করে, তা হল উৎপাদন শিল্প ক্ষেত্রে নেট যুক্ত-মূল্যের কতটা লভ্যাংশ বলে ধরা হচ্ছে, আর কতটা যাচ্ছে বেতনে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, লভ্যাংশ হল ৫০ শতাংশের মতো, যেখানে বেতন ২০ শতাংশেরও কম। অন্য ভাবে বলতে হলে, যখন অর্থনীতি চাঙ্গা ছিল, সংস্থা লাভ করছিল, তখনও কর্মীরা তার অপেক্ষাকৃত কম ভাগ পাচ্ছিলেন। বেশিটা পাচ্ছিলেন পুঁজি বিনিয়োগকারীরা।
ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল লিখেছিলেন, ‘‘হয় আমরা সকলেই একটা সুসভ্য জগতে বাস করব, অথবা কেউ করব না।’’ এর মধ্যে রয়েছে এমন এক সমাজের চিন্তা, যার ভিত্তি ন্যায় এবং একতা। এমন এক সমাজে সরকারের অন্যতম কাজ হল সম্পদের বণ্টন। ধনীর থেকে নিয়ে দরিদ্রকে দেওয়া। আজ আমরা দেখছি তার এক বিকৃত রূপ— দরিদ্রের কাছে সম্পদ যেন না যায়, তার জন্য যেন সরকার উঠেপড়ে লেগেছে। ধনীদের মধ্যে যারা অপরাধী, দুর্নীতিগ্রস্ত, তারা দিব্যি চুরি করে পার পেয়ে যাচ্ছে।
অধিক সাম্য প্রতিষ্ঠার উপযোগী নীতি নিয়ে এগোনোর একটা বড় সমস্যা হল, যাঁরা ভারতের শীর্ষ ২০ শতাংশ ধনী, তাঁরা অনেকেই নিজেদের ‘মধ্যবিত্ত’ মনে করেন। যেমন, যাঁদের গাড়ি আছে, ইন্টারনেট আছে, ভূগর্ভস্থ পয়ঃপ্রণালীর সঙ্গে সংযুক্ত শৌচাগার আছে, তাঁরাও নিজেদের মধ্যবিত্ত মনে করেন। যদিও বাস্তব হল, ২০১৭-১৮ সালের রিপোর্ট অনুয়ায়ী কেবল ১৫ শতাংশের ইন্টারনেট সংযোগ ছিল, গাড়ি ছিল ১১ শতাংশের, এবং পয়ঃপ্রণালী-সংযুক্ত ঘরে বাস করছিলেন কেবল ৮ শতাংশ (২০১৫-১৬)। আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান বিষয়ে যথার্থ আত্মোপলব্ধি অন্তত যদি হয়, তা হলে আরও ভাল ভারত তৈরির পথে প্রথম পদক্ষেপ করতে পারব, কেবল ‘নয়া ভারত’ নয়।