বঙ্গভুক্তির দাবিতে পুঞ্চার পাকবিড়রায় জমায়েত। ফাইল চিত্র
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের ঘটনাকে স্মরণ করে সারা পৃথিবী জুড়ে মাতৃভাষার অধিকার ও সম্মানরক্ষার জন্য এই দিনটি বিশেষ ভাবে পালিত হয়।
এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথম উদ্যোগী হন বাংলাদেশের রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম। কানাডায় বসবাসকারী এই দুই বাঙালি ১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি রাষ্ট্রপুঞ্জের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আন্নানের কাছে একটি আবেদনপত্র পেশ করেন। তাতে বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস উল্লেখ করে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার দাবি জানান তাঁরা। এর পরে ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনে বাংলাদেশ ও সৌদি আরব ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব এনেছিল। এই প্রস্তাব ভারত, ইরান, ইতালি, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি ২৭টি দেশ সমর্থন জানায়। ফলে রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় প্রস্তাবটি পাস হয়। ২০০০ সাল থেকে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালিত হচ্ছে।
অবশ্যই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনে সবচেয়ে বড় শরিক বাংলাদেশ। কারণ ১৯৫২ সালের এই ভাষা আন্দোলনের সূত্র ধরে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্ববঙ্গের বাংলাভাষী মানুষদের উপর পাকিস্তান সরকারের উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে আবুল বরকত, রফিকউদ্দিন, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান শহিদ হন। এর পর থেকে সাধারণ মানুষ আন্দোলনে যোগদান করে, শুরু হয় স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধ, অবরোধ, হরতাল। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দুর সঙ্গে বাংলাভাষাকেও পূর্ববঙ্গে স্বীকৃতি দেয়। আর পূর্ববঙ্গের জনগণের পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্য হল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের এই ইতিহাসকে সম্মান জানিয়েই ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের পাশাপাশি ভারতে বাংলাভাষার অধিকারের দাবিতে দু’টি আন্দোলন হয়েছিল। যথা ১৯৬১ সালের অসমের বরাক উপত্যকার ১৯ মে এর আন্দোলন এবং মানভূম জেলার ভাষা আন্দোলন। স্বাধীনতার সময়ে অসমে প্রায় ২০ লক্ষ বাঙালির বসবাস ছিল। কিন্তু ১৯৫১ সালের জনগণনায় বাঙালির সংখ্যা অনেক কম দেখানো হয়। এরপর শিক্ষা, চাকুরি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বাঙালিরা বঞ্চিত হতে থাকে। ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর অসমীয়া ভাষাকে অসমের একমাত্র ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে বরাক উপত্যকার বাঙালিরা প্রতিবাদ শুরু করেন। ১৯৬১ সালের ১৯ মে অসম সরকারের পুলিশ সত্যগ্রহীদের উপর গুলি বর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে ১০ জনের অধিক শহিদ হন। এর ফলে শেষ পর্যন্ত অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার অধিকার মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এই ভাবে এই ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
তবে ভারতে বাংলার অধিকারের দাবিতে আন্দোলন প্রথম শুরু হয়েছিল মানভূম জেলায়। বিস্তৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ ও বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের চেয়ে মানভূমের ভাষা আন্দোলনের বিস্তৃতি কম ছিল এবং শুধুমাত্র মানভূম জেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এটির সূচনা ঘটেছিল ১৯১২ সালে। বঙ্গভঙ্গের সময়ে বাংলাভাষী প্রধান মানভূম জেলাকে বাংলা থেকে বিহার ও ওড়িশার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলেও মানভূম জেলা বিহার ও ওড়িশার মধ্যেই থেকে যায়। একর প্রতিবাদে পুরুলিয়ার বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, কয়লাখনি মালিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মানুষ ব্রিটিশ সরকারের কাছে বারবার দাবিপত্র পেশ করে এবং আন্দোলন শুরু হয়। বাংলাভাষী মানুষদের অধিকার রক্ষার এই আন্দোলন দু’টি পর্যায়ে চলেছিল। যথা স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত এবং স্বাধীনতা পরবর্তী ভাষা আন্দোলন।
প্রাক স্বাধীনতা পর্বে মানভূম জেলায় ভাষা আন্দোলনের চেয়ে স্বাধনতা সংগ্রাম বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। তবে ১৯৩৫ সালের পর বিহার প্রদেশের সরকার বিহারী সমিতির মাধ্যমে মানভূমে হিন্দিভাষার প্রচার শুরু করে। তখন তার বিরুদ্ধে বাঙালি সমিতি বাংলা ভাষার প্রচার চালায়। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর বিহার সরকার মানভূম জেলাকে বাংলাভাষীর পরিবর্তে হিন্দিভাষী জেলায় পরিণত করার জন্য ব্যাপক হিন্দিকরণ নীতি অনুসরণ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মানভূম জেলা কংগ্রেসের প্রথমসারির নেতারা কংগ্রেস দল ত্যাগ করে এবং ১৯৪৮ সালে লোকসেবক সঙ্ঘ নামে নতুন একটি দল গঠন করে। এই লোকসেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। নেতৃত্ব দেন অতুলচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, অরুণচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা দেবী, ভজহরি মাহাতো, ভীমচন্দ্র মাহাতো প্রমুখ।
১৯৪৮ সাল থেকে কয়েকটি পর্যায়ে মানভূমের ভাষা আন্দোলন চলেছিল। যথা- ভাষা সত্যাগ্রহ, বিধানসভআ ও লোকসভায় সাংবিধানিকত পদ্ধতিতে আন্দোলন, টুয়ু সত্যাগ্রহ, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন ও রাজনৈতিক আন্দোলন এবং বঙ্গভঙ্গ সত্যাগ্রহ অভিযান। ১৯৫৬ সাল পর্যন্তএই ভাষা আন্দোলনে মানভূমের কৃষক, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ মানুষ যোগ দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের সুপারিশ অনুসারে মানভূম জেলাকে দ্বিখণ্ডিত করা হয় এবং পুরুলিয়া সদর মহকুমায় ১৬টি থানাকে নিয়ে পুরুলিয়া নামে নতুন একটি জেলা তৈরি হয়। এই জেলা ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু মানভূম জেলার শিল্পসমৃদ্ধ ধানবাদ মহকুমা –সহ বাকি বাংলাভাষী অঞ্চলগুলিকে বিহার রাজ্যের মধ্যেই রেখে দেওয়া হয়।ফলে মানভূম দেলার ভাষা আন্দোলন আংশিক ভাবে
সফল হয়েছিল।
লেখক পুরুলিয়ার মানভূম মহাবিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান