Coronavirus

তথ্যসুরক্ষা বনাম স্বাস্থ্যসুরক্ষা?

ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার রক্ষক বলে বাহবা নেওয়ার সঙ্গে সে এই নজরদারির কাজ করে চলে আরও সূক্ষ্ম ভাবে, বিবিধ অছিলায়।

Advertisement

মাধুরীলতা বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০২০ ০০:২২
Share:

কিছু দিন আগে সিসিটিভি-র একটা বিজ্ঞাপন বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কলেজের হোস্টেলে সিনিয়র দাদারা জুনিয়রদের জ্বালাতন করার চেষ্টা করলে, একটি বুদ্ধিমান জুনিয়র ছেলে ওপরে থাকা সিসিটিভি-র ক্যামেরা দেখিয়ে বলেছিল, ‘উপরওয়ালা সব দেখ রহা হ্যায়!’ এই ‘উপরওয়ালা’রা আমাদের ‘দেখে চলেছেন’, কখনও ‘সুরক্ষা’ দেওয়ার জন্য, কখনও ‘সাহায্য’ করার জন্য। কখনও আবার স্রেফ নজরদারি চালিয়ে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী আমাদের গড়েপিটে নেওয়ার জন্য।

Advertisement

সবচেয়ে বড় উপরওয়ালা— অবশ্যই— রাষ্ট্র। ঘটনা হল, কেবল সাবেক সোভিয়েট বা নাৎসি জার্মানির মতো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র নয়, তথাকথিত আধুনিক উদারবাদী রাষ্ট্রও এই দলে পড়ে। ব্যক্তিস্বাধীনতা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার রক্ষক বলে বাহবা নেওয়ার সঙ্গে সে এই নজরদারির কাজ করে চলে আরও সূক্ষ্ম ভাবে, বিবিধ অছিলায়।

করোনা অতিমারির সময়ে রোগ মোকাবিলাকে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে ঘোষণা করে যুদ্ধের পরিভাষায় ‘শত্রু’ (এ ক্ষেত্রে জীবাণু ও তার বাহক) খোঁজার ছকে শুরু হয়েছে নতুন প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রার নজরদারি। রোগটি অভূতপূর্ব। আর তাই রোগের প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জনস্বাস্থ্যবিধি লাগু করার পাশাপাশি অভূতপূর্ব কিছু কাজও শুরু হয়েছে। আপাত-নিরীহ, প্রয়োজনীয় ডিজিটাল মাধ্যমের আওতায় সবাইকে আনার চেষ্টা হচ্ছে, যাতে আরও বেশি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও শাসকের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা যায়। ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি দেশের নিরাপত্তা সংস্থাকে করোনা রোগী খুঁজে বার করতে সেই ডিজিটাল প্রযুক্তি বা অ্যাপ ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন যা সাধারণত জঙ্গিদের ওপর নজরদারি চালাতে ব্যবহার করা হয়! এ নিয়ে সে দেশের পার্লামেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমিটি আপত্তি জানালে নেতানিয়াহু এমার্জেন্সি ডিক্রি জারি করে সিদ্ধান্তটি বলবৎ করেছেন। তাঁর নিজের টালমাটাল রাজনৈতিক কেরিয়ার (পর পর তিন বার নির্বাচনে পরাজয়) সত্ত্বেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে করোনা অতিমারিকে ঢাল করে পার্লামেন্ট সাসপেন্ড করেছেন, বিচারবিভাগের দরজা বন্ধ করে দিয়েছেন।

Advertisement

তাকানো যাক আমাদের দেশের ‘আরোগ্য সেতু’ অ্যাপটির দিকে। এই অ্যাপ-এর মাধ্যমে করোনা সম্পর্কিত কিছু তথ্য পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে, যে নাগরিকরা এটি মোবাইলে ডাউনলোড করছেন, তাঁদের ব্যক্তিগত তথ্যও নজরদারির আতসকাচের তলায় আসছে। অ্যাপটি বাধ্যতামূলক করার জন্য প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে ভাষণে জোর দিয়ে বলেন, লকডাউন লঙ্ঘনকারীদের ওপর কড়া নজর রাখতেই এই ব্যবস্থা ‘নাগরিক’দের নিতে হবে। দিল্লিতে তবলিগি জামাতের সম্মেলনে যোগ দেওয়া সদস্যদের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে ভেবে তখন দেশময় উৎকণ্ঠা। এই আবহেই ‘জাতীয় সুরক্ষা’-র প্রশ্ন সামনে রেখে জাতীয় মিডিয়ার বড় অংশ নাগরিককে আরোগ্য সেতু-র যৌক্তিকতা ‘বোঝানো’র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।

এই অ্যাপ কার্যকর করতে কোনও অঞ্চলের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষকে তাদের মোবাইল ফোনে এটি ‘ইনস্টল’ করতে হয়। এই সংখ্যা গ্রাম ও শহর অনুযায়ী কমবেশি হতে পারে। যে হেতু আমাদের দেশে গ্রামের চেয়ে শহরে টেলি-যোগাযোগের পরিসর ভাল কাজ করে, তাই স্বাভাবিক ভাবেই শহরে এই অ্যাপ-এর কার্যকারিতা বেশি। দিল্লি সংলগ্ন উত্তরপ্রদেশের নয়ডা কর্তৃপক্ষ একে বাধ্যতামূলক ঘোষণা করল। বলা হল, যারা এটি ইনস্টল করবে না, তাদের ছ’মাস অবধি জেলও হতে পারে। অনলাইন কেনাবেচার ক্ষেত্রেও এই অ্যাপ আবশ্যিক হল। সুইগি বা জ়োম্যাটো-র মতো অনলাইন সংস্থার কর্মীদের ফোনেও তা আবশ্যিক হল। প্রসঙ্গত, এই অ্যাপ কার্যকর করতে হলে সর্বদা ব্লুটুথ এবং ভৌগোলিক চিহ্নিতকরণের অ্যাপ (জিপিএস) চালু রাখা দরকার। এই অ্যাপ-এর মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যাদির কিছু কিছু অন্য সংস্থাকে দেওয়ার ব্যবস্থাও হল। বলা হল, তা এক বারের বেশি ব্যবহার করা যাবে না, এবং এই তথ্য ১৮০ দিন পর্যন্ত রাখা যাবে। অবশ্য এর আগে থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার ব্যক্তিগত তথ্য কেনাবেচার ব্যাপারে চিন্তা শুরু করেছে। ২০১৮-১৯ সালে ইকনমিক সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনেই আমরা পড়েছি, নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যকে কেন ‘সর্বসাধারণের উপকার’-এর (পাবলিক গুড) ধারণার সঙ্গে যুক্ত করা দরকার, নাগরিক তথ্যের কিছু অংশ কেন অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি সংস্থাকে দেওয়া যায় ইত্যাদি। কারণটা সহজই। এতে সরকারের ব্যয়ের বোঝা কমে।

অনেকে বলছেন, কিছু করার নেই, এক দিকে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও অন্য দিকে স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা, দুয়ের মধ্যে কোনও একটিকে বেছে নিতে হলে এ ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই একমাত্রিক বাছাই-এর চিন্তাটাই কি সমস্যার মূল নয়? বাছাইকারীর স্বাধীনতা কি এতে রাখা যায়? কী ভাবে একই সঙ্গে গোপনীয়তা ও স্বাস্থ্য দুটোই রাখা যায়, সেটা কি সত্যিই যথেষ্ট ভাবা হয়েছে? নাগরিক সক্ষমতা বাড়িয়েও স্বাস্থ্য-রক্ষা কি একেবারেই অসম্ভব? না কি এই সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রীয় নজরদারিই একমাত্র পথ?

রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, সরোজিনী নাইডু কলেজ ফর উইমেন

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement