গত বৎসর ইউ এস ওপেন-এ বিশ্বখ্যাত টেনিস খেলোয়াড় রজার ফেডেরার-কে এক শিশু প্রশ্ন করিয়াছিল, সুইটজারল্যান্ডে খুব বেশি জন্তুজানোয়ার নাই শুনিয়াছি, আপনাকে সকলে ছাগল বলে কেন? আসলে ফেডেরার-কে অনেকেই বলে, ‘গোট’। ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’ বাক্যটির প্রতিটি শব্দের আদ্যক্ষর জুড়িয়া এই সংক্ষিপ্ত নির্দেশক-শব্দটি তৈয়ারি হইয়াছে। ইহা সবিশেষ মজার, যে মানুষটিকে বলা হইতেছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ, সে মানুষটিকেই আবার অজও বলা হইতেছে। এই ভাবে সংক্ষেপ করিলে, সংক্ষিপ্ত রূপটিকে ইংরাজিতে বলে ‘অ্যাক্রোনিম’। বহু অ্যাক্রোনিম অহরহ উচ্চারিত হয়, যেমন মেল বা মেসেজে ‘লাফ আউট লাউড’ না লিখিয়া ‘এলওএল’, বা ‘ও মাই গড’ বুঝাইতে ‘ওএমজি’ দিয়া কাজ সারা হয়। কিন্তু অন্য একটি শব্দ হইয়া উঠিবে, এমন বুদ্ধিদীপ্ত অ্যাক্রোনিম বিরল। তাহা করিতে ভাষা ও শব্দের উপর দখল এবং রসবোধ প্রয়োজন। এই ক্রীড়া সকলে পারেন না, শিব্রাম পারিতেন।
কিন্তু শিব ও রাম ভজনে নিপুণ ভারতীয় জনতা পার্টির কিছু কর্তাও শব্দ লইয়া খেলায় যথেষ্ট দড়। সাম্প্রতিক বাজেটে অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করিলেন এক প্রকল্পের কথা: ‘গোবর-ধন’। ‘গ্যালভানাইজিং অর্গানিক বায়ো-অ্যাগ্রো রিসোর্সেস’, ইহার সহিত ‘ধন’ জুড়িয়া দেওয়া হইল। এই প্রকল্পে চাষিরা শিখিবেন, গোবর ও অন্য বর্জ্যকে কীভাবে জমিতে ব্যবহার করা যায়। আবার ওই কঠিন বাক্যটির শব্দে আদ্যক্ষরগুলি জুড়িলেও হয় ‘গোবর’। ইহা অত্যাশ্চর্য, কারণ হিন্দি শব্দ ‘গোবর’কে ইংরাজিতে আংশিক ব্যাখ্যাও করা হইবে, আবার ইংরাজি শব্দগুলির আদ্যক্ষর জুড়িলে সংক্ষিপ্ত রূপটি হুবহু হিন্দি শব্দটির উচ্চারণই পাইবে, ইহা সম্পাদন সহজ কথা নহে। অ্যাক্রোনিম একটি নির্দিষ্ট ভাষায় কিছু খেলাধুলা করিতে পারে নিঃসন্দেহে, কিন্তু এইখানে অ্যাক্রোনিম এক ভাষা হইতে অন্য ভাষায় যাতায়াত করিতেছে, যাহা অদ্যাবধি হইয়াছে কি না সন্দেহ। এইখানে শেষ নহে, কেহ ‘গোবর-ধন’ উচ্চারণ করিলেই যে শব্দটির আভাস আসিবে: ‘গোবর্ধন’। অর্থাৎ, গরুর বৃদ্ধি। যাহা ভারতের শাসক দলের মূল দর্শনের অন্যতম স্তম্ভ। আবার গোবর্ধন কথাটির অর্থ, পুরাণখ্যাত, বৃন্দাবনে অবস্থিত একটি পর্বত, যাহা তৃণাদি দ্বারা আচ্ছাদিত, তাই গো-সমাজের বর্ধনের কারণ। এই পাহাড়ের কথায় তৎক্ষণাৎ মনে পড়িবে ক্যালেন্ডার-চিত্রের ন্যায় ঝলমলে আলেখ্য: কৃষ্ণ বাম হস্তে গোবর্ধন ধারণ করিয়া দাঁড়াইয়া অাছেন। কৃষ্ণ ইন্দ্রযজ্ঞ নিবারণ করিয়া গিরিযজ্ঞ প্রচলিত করেন। ইন্দ্র তাই কুপিত হইয়া বৃন্দাবনে প্রচুর বারিবর্ষণ করেন। বৃষ্টিনিপীড়িত মানুষ ও গরুদের বাঁচাইতে কৃষ্ণ পাহাড়টিকে তুলিয়া ধরেন ও তাহার আশ্রয়ে সকলকে ডাকিয়া লন। তাই প্রকল্পটির নাম উচ্চারণ করিতে গেলে, গরুর প্রতি, বৃন্দাবনের পর্বতের প্রতি, কৃষ্ণের অলৌকিক ক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িবে, এবং গোবর বা গরুর মল যে পরম ধন, এই নিহিতার্থও অন্তরে প্রবিষ্ট হইবে।
ভাষাতাত্ত্বিক দেরিদা বা স্যসুর বাঁচিয়া থাকিলে উদ্বাহু হইয়া অরুণ জেটলিকে আলিঙ্গন করিতে ছুটিয়া আসিতেন। তাঁহারা কী সব কঠিন ব্যাপার ভাবিয়া বাহির করিয়াছেন, তাহা মুষ্টিমেয় পণ্ডিত বুঝিতে পারিয়াছেন এবং প্রাণপণ বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াও ব্যর্থ হইতেছেন, আর কোনও ডঙ্কা না বাজাইয়াই ভারতের সরকারি কিছু মানুষ এমন কাণ্ড করিয়া ফেলিলেন! সাধারণ বোধ অনুযায়ী, বাজেট এক নীরস কাণ্ড, টাকা পয়সা জমা খরচের খতিয়ান মাত্র, কিন্তু তাহার মাধ্যমে ভাষার জগতে নীরব বিপ্লবের সূচনা কেবল এই দেশই করিতে পারে। এই যুগে মানুষের অন্তরে ঢুকিবার প্রশস্ত উপায়, পয়সার কথার মাধ্যমে বার্তা পৌঁছাইয়া দেওয়া। যদি হিন্দু দেবতা, হিন্দু পবিত্র জন্তু ও হিন্দু পূজনীয় পর্বতের অনুষঙ্গ একটি বাজেট প্রকল্পের মাধ্যমে প্রচার করা যায়, তাহা হইলে সুকৌশলে হিন্দুত্বের ধ্বজাও উড্ডীন করা যাইল, কেহ ধরিলে অস্বীকারের অবকাশও রহিল। সাধে তো শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয় নাই। ব্রহ্ম লইয়া যাঁহারা তোলাপাড়া করেন, তাঁহাদের বলা হয় ব্রাহ্মণ, যাহা আবার হিন্দু বর্ণাশ্রম অনুযায়ী শ্রেষ্ঠ বর্ণ। বর্ণ কথাটির অর্থ অক্ষর, আর তাহার অর্থ, যাহার ক্ষয় নাই। শব্দকল্পদ্রুমের কোন উচ্চ শাখায় অধিষ্ঠান করিলে এমন শৃঙ্খলবিন্যাসে ভাষা-দর্শন-ইস্তাহার রচনা করা সম্ভব, ভাবিলে স্তম্ভিত হইতে হয়। হয়তো এই দিকে মন দিতে গিয়াই, বাজেট তেমন ভাল প্রস্তুত করা যায় নাই। কিন্তু, সে অন্য গল্প।
যৎকিঞ্চিৎ
দিল্লির ব্যস্ত রাস্তায় এক যুবককে খুন করল এক যুবতীর পরিবারের লোকেরা। কারণ, ওই যুবক ও যুবতী বিয়ে করবেন ঠিক করেছিলেন। ভারত প্রগতিশীল হয়েছে, লুকোছাপা না করে পথেঘাটে ধর্ষণ বা খুন করা যাচ্ছে, আর সম্মানরক্ষার্থে খুন তো প্রকাশ্যেই করতে হবে, সবাই দেখুক এই পরিবারের কাছে সম্মান কী মূল্যবান! ফিল্ম অপছন্দ হলে সিনেমা হল জ্বলবে, হবু জামাই অপছন্দ হলে তাঁকে কোপানো হবে। মন ও মুখ (এবং অস্ত্র-ধরা হাত) এক হয়ে যাওয়ার সৎ লগ্ন জিন্দাবাদ!