মন্দার লক্ষণ এখন ভারতীয় অর্থনীতির সর্বাঙ্গে। শুধু গাড়ি ব্যবসার ক্ষেত্রেই নয়, গোটা দেশেরই আর্থিক বৃদ্ধির হার কমছে। পারিপার্শ্বিক প্রমাণ বলছে, বেকারত্বও বাড়ছে। দেশের একটা বড় অংশের মানুষের মাইনে গত পাঁচ-ছ’বছরে কার্যত একই জায়গায় থেকে গিয়েছে, হয়তো অনেকের কমেছেও। মোট কথা, অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। গত সপ্তাহে সরকার কর্পোরেট করের হার কমাল। এর ফলে লগ্নিকারীদের লাভের টাকা নিরাপদে থাকবে, এবং সরকারের আশা, তাতে অর্থনীতির পালেও হাওয়া লাগবে।
ভারত হঠাৎ এমন আর্থিক মন্দার মধ্যে গিয়ে পড়ল কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই নোটবাতিল আর জিএসটি-র কথা বলছেন। আমি বলব, সমস্যা আরও গভীরে। নোটবাতিল বা জিএসটি সেই সমস্যাকে তীব্রতর করেছে, কিন্তু আসল কারণ অন্যত্র। ভারতে আর্থিক অসাম্য খুব দ্রুত বেড়েছে। আর তার ফলেই বিনিয়োগে লাভের হার কমেছে, সেই সূত্রে কমেছে বিনিয়োগের হার, এবং আর্থিক বৃদ্ধির গতিভঙ্গ হয়েছে।
আর্থিক অসাম্য বাড়লে কেন লগ্নিতে লাভের পরিমাণ কমতে পারে, সেই কথাটা কথাটা ভেঙে বলা দরকার। দেশে আর্থিক উৎপাদনের শক্তি যে পরিমাণে বাড়ে, একটা বড় অংশের জনসংখ্যার— মূলত শ্রমিক ও কৃষকদের— আয় যদি তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না বাড়ে, তবে দেখা যাবে, যত পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তত বিক্রি হচ্ছে না। কারণ, সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ওপরই দেশের বাজার নির্ভর করে। বিনিয়োগ যে হারে বাড়ছে, তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা যদি সে হারে না বাড়ে, তা হলে বাজারে চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি হবেই। এবং, রফতানির বাজার না থাকলে, দেশের বাজারে জোগানের চেয়ে চাহিদা কম হলে না বিক্রি হওয়া পণ্য সংস্থার গুদামে জমতে থাকবে— লগ্নিকারী লাভ ঘরে তুলতে পারবেন না। তাঁরা আশঙ্কা করবেন যে ভবিষ্যতেও লাভের পরিমাণ কম হবে, ফলে লগ্নির পরিমাণও কমিয়ে দেবেন। সব মিলিয়ে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমবে।
দেশে মোট আয়ের পরিমাণ যদি বাড়ে, তা হলে আর্থিক অসাম্য বাড়লেই বা ক্ষতি কী? ক্ষতি হল, গরিব মানুষ তাঁদের আয়ের বেশিটাই ভোগ্যপণ্যের পিছনে খরচ করেন। বড়লোকদের আয়ের তুলনায় ভোগব্যয়ের অনুপাত অনেক কম। ফলে, গরিবের একশো টাকা আয় বাড়লে যত টাকা ভোগব্যয় বাড়বে, বড়লোকের আয় সমান পরিমাণ বাড়লে ভোগব্যয় বাড়বে তার চেয়ে অনেক কম। ফলে, আর্থিক অসাম্য বাড়লে, দেশের আয় যত বাড়ে, পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা তত বাড়ে না। ফলে, আর্থিক অসাম্য অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনতে পারে।
ভারতে যখন চড়া হারে আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছিল, তখন দেশের সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিকরা তার কতখানি ভাগ পাচ্ছিলেন? অ্যানুয়াল সার্ভে অব ইন্ডাস্ট্রিজ়-এর পরিসংখ্যান বলছে, মাত্র ১৫ শতাংশ। পণ্য উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল বাবদ যে খরচ হয়, সেই পণ্য বিক্রি করে পাওয়া মোট রাজস্ব থেকে সেই খরচ বাদ দিলে পড়ে থাকা অঙ্ককে বলে শিল্পক্ষেত্রের ‘ভ্যালু অ্যাডেড’। দেশে চড়া আর্থিক বৃদ্ধির সময় শিল্পক্ষেত্রের ভ্যালু অ্যাডেড-এর মাত্র ১৫ শতাংশ যাচ্ছিল শ্রমিকদের বেতন দিতে। অর্থাৎ, লাভের গুড়ের বেশিটাই যাচ্ছিল লগ্নিকারী ও ঋণদাতাদের ঘরে। তার চেয়েও বড় কথা, ক’জন শ্রমিক সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন? অসংগঠিত উৎপাদন ক্ষেত্রে বহু ক্ষেত্রে সরকারনির্দিষ্ট ন্যূনতম মজুরিও মেলে না।
কৃষকদের অবস্থা আরও খারাপ। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষি এবং কৃষিশ্রমিকরা এমনই অবস্থায় আছেন যে তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা নেই বললেই চলে। গ্রামীণ ক্ষেত্রে অ-কৃষিশ্রমিকদের অবস্থাও একই রকম, হয়তো আরও খারাপ। তার ওপর রয়েছে লিঙ্গ-ব্যবধান। লেবার ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, গত চার-পাঁচ বছরে ১৩টি কৃষিক্ষেত্র ও ১২টি গ্রামীণ অ-কৃষিক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির হার বাদ দিলে শ্রমিকের মজুরি বিশেষ বাড়েনি। কিন্তু, একই সময়ে জাতীয় আয় বেড়েছে ৬-৭ শতাংশ হারে। স্পষ্টতই দেশের আয় যতটা বেড়েছে, তার প্রায় পুরোটা ঢুকেছে অল্পসংখ্যক লোকের পকেটে। ধনীরা ধনীতর হয়েছেন, দরিদ্ররা দরিদ্রতর— অন্তত আপেক্ষিক ভাবে।
এনএসএসও-সহ যাবতীয় পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে বেশ কিছু দিন ধরেই অসাম্য বাড়ছে। বস্তুত, বাজার অর্থনীতি যে লাভ-ভিত্তিক আর্থিক বৃদ্ধির নিয়ম মেনে চলে, তাতে অসাম্য বাড়বেই। এই অসাম্য কেন গ্রহণযোগ্য, তার একটা সহজ যুক্তি দেওয়া হয়: যদি সবারই আয় বাড়ে, তা হলে তো সবাই আগের চেয়ে ভাল থাকবেন— তা হলে আর কারও আয় অন্যদের চেয়ে বেশি বাড়ল কি না, তাতে কী এসে যায়? অসাম্য বাড়লেও সবাই আগের চেয়ে ভাল, অতএব সুখী, থাকবেন। মুশকিল হল, এই ব্যবস্থাটা আদৌ টেকসই নয়। অন্য সব আর্থ-সামাজিক সমস্যার কথা যদি ভুলেও যাই, তা হলেও অসাম্য-সৃষ্টিকারী আর্থিক বৃদ্ধি নিজের চাপেই নিজে ভেঙে পড়ে। ওপরে যে কারণটার কথা আলোচনা করলাম, তার জন্য।
আর্থিক বৃদ্ধির অন্য একটা পথও আছে— মজুরি ও বেতনবৃদ্ধির ওপর নির্ভরশীল আর্থিক বৃদ্ধি। এই পথে হাঁটলে গেলে গোড়াতেই আয়ের বণ্টন সুষম হওয়া দরকার, যাতে সবার হাতে যথেষ্ট টাকা থাকে, যাতে সবার ভোগব্যয়ের সামর্থ্য থাকে, যাতে সেই ব্যয়ের প্রবণতা বাড়ে। বেশি সংখ্যক মানুষের হাতে টাকা থাকার ফলে ভোগব্যয়ের প্রবণতা যত বেশি হবে, সরকার একটা বাড়তি টাকা খরচ করলে, এক টাকা বেশি লগ্নি হলে বা এক টাকার বিনিয়োগ বাড়লে জাতীয় আয় বাড়বে এক টাকার চেয়ে তত বেশি হারে। এবং, এ ভাবেই চলতে থাকবে, যত ক্ষণ না গোটা অর্থনীতিতে সবার কর্মসংস্থান হয়, অথবা দেশের উৎপাদন ক্ষমতা তার চরম সীমায় পৌঁছে যায়। ভারত এখন এই দুটোর চেয়েই ঢের দূরে রয়েছে। বস্তুত, কর্মসংস্থান না হওয়াই এখন দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটা। এই পথে হেঁটে যদি কর্মসংস্থান বাড়ে, তার চেয়ে ভাল কিছু হয় না।
অন্য দিকে, নেট রফতানির (অর্থাৎ, মোট আমদানির সঙ্গে মোট রফতানির ব্যবধান) পরিমাণ যদি বাড়ে, তা হলেও দেশের বাজারে চাহিদা খানিক হলেও বাড়তে পারে। কিন্তু, যে দেশগুলোতে ভারত মূলত রফতানি করে, সেগুলোর অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যের ওপর মোট রফতানির পরিমাণ নির্ভরশীল। উন্নত দুনিয়ায় খুব ভাল আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছে না। এবং, সেই পরিস্থিতি ভারতের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আর একটা উপায় হল রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়িয়ে বাজারে চাহিদা বাড়ানো। যদি মানুষকে কম কর দিতে হয়, তা হলে হাতে খরচ করার মতো টাকার পরিমাণ বাড়বে।
সরকার কোনও ভাবে নিজের খরচ বাড়ালে মানুষের হাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে আয়ের পরিমাণ বাড়বে। তাঁরা সেই টাকা খরচ করলে অন্যদের আয়ও বাড়বে। তাঁরা আবার সেই টাকা পণ্য ও পরিষেবার পিছনে খরচ করবেন। দেশে যদি অব্যবহৃত উৎপাদন ক্ষমতা থাকে, এবং বেকার শ্রমশক্তি থাকে, তা হলে উৎপাদনের পরিমাণও বাড়বে। অর্থনীতির ভাষায় এরই নাম কেন্স-কান মাল্টিপ্লায়ার প্রসেস। কিন্তু মুশকিল হল, ফিসক্যাল রেসপনসিলিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) অ্যাক্ট-এর ফলে রাজকোষ ঘাটতি বাড়ানোর ব্যাপারেও সমস্যা আছে।
গত শুক্রবার কেন্দ্রীয় সরকার যে কর্পোরেট কর ছাড় ঘোষণা করল, তাতে সরকারের মোট রাজস্ব ক্ষতি হলে এক লক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার কোটি টাকা। জিডিপি-র ০.৭৫%। কিন্তু, এই কর ছাড় আর্থিক অসাম্য আরও বাড়াবে— অসাম্যের ফলেই যে সমস্যার সূত্রপাত, এতে সেই সমস্যা গভীরতর হবে। কর্পোরেট কর ছাড় না দিয়ে এই টাকা সরকার পরিকাঠামোর উন্নতিতে ব্যয় করতে পারত। খরচ করতে পারত সামাজিক ক্ষেত্রে— শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা পরিকাঠামোতে। তাতে অর্থনীতিকে উৎসাহ দেওয়া যেত, আর একই সঙ্গে আর্থিক অসাম্য খানিক হলেও কমত। সরকারকে যদি এফআরবিএম আইন মেনেই চলতে হয়, তবে কর ছাড় দেওয়ার ফলে যে রাজস্ব কমল, তাতে পরিকাঠামো বা সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ আরও কমাতে হবে।
রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ বাড়ানো না হলে এক দিকে কর ছাড় দিয়ে অন্য দিকে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনলে কাজের কাজ কিছু হবে কি? সরকার যদি মূলধনী ক্ষেত্রে ব্যয় করত, তা হলে বেসরকারি ক্ষেত্রেরও লাভ হত, আবার কর্মসংস্থানও বাড়ত। সরকার সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ালে গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ত। সরকার গরিবের কথা ভেবে পদক্ষেপ করলে অসাম্য কমত। আর্থিক মন্দার সঙ্গেই যদি লড়তে হয়, তা হলে কর্পোরেট কর ছাড় দেওয়ার চেয়ে অনেক জরুরি কাজ করার ছিল। সরকার তার কিছুই করল না।
লেখক- অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি