অ্যালয় স্টিল প্লান্ট। ফাইল ছবি
চলতি বছরে লোকসভা ভোটের পরে দেশের অর্থনীতি নিয়ে সরকারের ভাবনা কী তা দেখার জন্য আপামর ভারতবাসীর সঙ্গে শিল্পাঞ্চলবাসীও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। প্রথম বার সরকারে থাকাকালীন প্রধানমন্ত্রীর নোটবন্দি ও জিএসটি-র মতো কয়েকটি সিদ্ধান্তের জেরে শিল্প বিশেষ করে ক্ষুদ্রশিল্প সঙ্কটের মুখে পড়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। সেই একই সমস্যা এই শিল্পাঞ্চলেও দেখা দিয়েছিল। পাশাপাশি, এর মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার অ্যালয় স্টিল প্লান্টের মতো সরকারি কয়েকটি সংস্থার বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে, শিল্পাঞ্চলের শ্রমিকদের সামনে এমনিতেই কাজ হারানোর ভ্রুকূটি ছিল। এমন অবস্থায় পুরনো কারখানার পুনরুজ্জীবন, কর্মসংস্থান, শিল্পে লগ্নি নিয়ে আসা প্রভৃতি বিষয়ে সরকার কী পদক্ষেপ করে তা নিয়ে উদগ্রীব ছিলেন শিল্পাঞ্চলবাসী। শেষ পর্যন্ত যে বাজেট পেশ করা হল তাতে শ্রমিক তো বটেই চাকরিপ্রার্থী ও সাধারণ মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হল বলেই মনে হয়।
এ বারের বাজেটে কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে সরকারের প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বেসকারি বিনিয়োগের পথকে সুগম করতে হবে। তার জন্য সরকারি স্তরে লালফিতের ফাঁসকে আলগা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পাশাপাশি, বিলগ্নিকরণ নিয়ে সরকারের এই উৎসাহ শ্রমিকদের কাছে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কয়েক জনের মতে, চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ (সিএলডব্লিউ) ভারতের প্রথম সারির রেল ইঞ্জিন উৎপাদক কারখানাগুলির মধ্যে অন্যতম। এটি রেলের ‘অটোনমাস বডি’র ‘প্রফিটেবল’ বা লাভজনক সংস্থা। এটিকে কর্পোরেট ধাঁচে গড়ে তুলতে গেলে অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়তে পারেন বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন ।
চলতি বাজেটে রেল পরিষেবাকে উন্নত করে তুলতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের উপরে গুরুত্ব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে রেলের সামনে বেসরকারি পুঁজি বিনিয়োগের দরজা খুলে যাবে বলেই মনে করছেন অনেকে। ২০১৮-’৩০-এর মধ্যে রেলের পরিকাঠামোগত উন্নতির জন্য পঞ্চাশ লক্ষ কোটি টাকা দরকার বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। কিন্তু অর্থনীতিবিদদের প্রশ্ন, কোথা থেকে এই বিপুল পরিমাণ লগ্নি আসবে সে সম্পর্কে কোনও সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই বাজেটে। এ বার অর্থমন্ত্রক ৬৫,৮৭৩ কোটি টাকা রেলকে দেবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি টাকা বিভিন্ন খাত থেকে রেলকে জোগাড় করে নিতে বলা হয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে, এর জন্য যাত্রীভাড়া বাড়ানো হতে পারে। তারই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে সরকার ঘোষিত প্রকল্পগুলির ভবিষ্যত নিয়েও। বিগত কয়েক বছর ধরে একের পর এক যে প্রকল্পগুলি ঘোষণা করা হয়েছিল তার বেশ কয়েকটিকে নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এগুলি লোকসানে চলায় রেলের ঘাড়ে আর্থিক বোঝা বাড়ার আশঙ্কা থাকছে। এগুলিকে বাঁচাতে গিয়েই এই বিদেশি ও বেসরকারি পুঁজিকে স্বাগত জানানো বলে মনে করছেন অনেকে। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, এতে রেলের সিএলডব্লিউ-র মতো অতীতের লাভজনক সংস্থাগুলি বিপদে পড়বে।
শিল্পাঞ্চলের ভোটের ইস্যু হয়ে উঠেছিল এএসপি-র মতো সংস্থার ভবিষ্যৎ। অনেকেই বলেন, এই ধরনের সংস্থার বিলগ্নিকরণের রূপরেখা আগে থেকেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। তার পরেও ভোটের সময় প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল এই সংস্থাকে বাঁচানোর। সংস্থাটির বিলগ্নিকরণের পরে কী হবে তা নিয়ে শিল্পাঞ্চলের মানুষ রীতিমতো দোলাচলে। অথচ এই সংস্থাটির পুনরুজ্জীবনের এক বিরাট সম্ভাবনা এ বারের বাজেটে ছিল। এই সংস্থায় উৎপন্ন ‘১৫ সিডিভি-৬’ গ্রেড স্টিল নানা ক্ষেত্রে কাজে লাগে। প্রতিরক্ষার নানা যন্ত্র, বিমান ও অন্য যানবাহনের যন্ত্রাংশ তৈরিতে এই স্টিল ব্যবহৃত হয়। এএসপি-র নিজস্ব পরিকাঠামোর উপরে নির্ভর করে নানা ধরনের স্টিল তৈরি করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞদের দাবি, সুযোগ পেলে উৎপাদন বাড়িয়ে সংস্থাটিকে লাভজনক করে তোলা সম্ভব ছিল। কিন্তু তার বদলে খুলে দেওয়া হল বেসরকারি বিনিয়োগের দরজা।
আবার দুর্গাপুরের অন্য সংস্থা ডিএসপি-র জন্যও বাজেটে তেমন কোনও আশার আলো নেই বলে অভিযোগ উঠছে। ডিএসপি-র আয়ের অন্যতম উৎস রেলের এলএইচবি কোচের চাকা তৈরির বরাত। কিন্তু সেই বরাতও কেন্দ্র সরকার কমিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ। এতে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টের আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। এর আগে কিন্তু উপযুক্ত পরিকল্পনা না নেওয়াতেই আসানসোলের বার্ন স্ট্যান্ডার্ড, হিন্দুস্তান কেব্লস, দুর্গাপুরের এমএএমসি, এইচএফসিএল-র মতো সংস্থা কিন্তু বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
বাজেটে সেন্ট্রাল সেলস ট্যাক্সের বৃদ্ধির ফলে ভারতের বিভিন্ন বেসরকারি রেস্তরাঁ ও হোটেলগুলির পরিষেবামূল্য বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে লাভ ঠিক রাখতে হোটেল কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটতে পারেন বলে মনে করা হচ্ছে। তাতে আখেরে কর্মসংস্থানের সমস্যা আরও বাড়তে পারে।
বাজেটে পেট্রোল ও ডিজেলের উপরে বাড়তি সেস বসানোর কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ার আশঙ্কা থাকছে। অথচ মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস বিভিন্ন ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিসে সঞ্চয়ীকৃত অর্থের সুদ কমানো হল। তাতে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সমস্যা রয়েছে। দুর্গাপুর, আসানসোলের মতো শিল্পনির্ভর শহরের অনেক বাসিন্দা কর্মজীবনে জমিয়ে রাখা অর্থের উপরেই নির্ভর করে অবসরে জীবনযাপন করেন। কিন্তু দিনের পর দিন সরকারি ব্যাঙ্ক ও পোস্ট অফিসের মতো প্রতিষ্ঠানে সুদের হার কমে যাওয়ায় তাঁদের পক্ষে জীবন নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। তার উপরে মূল্যবৃদ্ধির অশনি সঙ্কেত তাঁদের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মিলিয়ে ২০১৯-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে এমন কোনও আশার আলো দেখা গেল না যা শিল্পাঞ্চলবাসীকে একটু স্বস্তি দিতে পারে।
একটি বেসরকারি সংস্থার পূর্বাঞ্চলের মার্কেটিং প্রধান