পথ দেখানোর লোক নেই
Kaushik Basu

বিশ্বাসের অভাবে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে, বললেন কৌশিক বসু

আমাদের দেশে হরেক রকম বিভেদ চিরকালই ছিল, কিন্তু ১৯৪৭-এর পর থেকে ক্রমশ একটা বোধ তৈরি হচ্ছিল যে আমাদের সবাইকে মিলেমিশে এই দেশটাকে তৈরি করতে হবে।

Advertisement

কৌশিক বসু

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২০ ০০:০৬
Share:

দিশেহারা: নীতি আয়োগে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনায় নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ। পিটিআই

প্রশ্ন: আপনি বারে বারেই বলছেন যে ভারতে এখন সামাজিক বিশ্বাসের ঘোর অভাব, এবং অর্থনীতির স্বাস্থ্যভঙ্গের পিছনে তার ভূমিকা প্রকট। শুধু আপনি নন, মনমোহন সিংহ বা রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতিবিদেরাও একই কথা বলছেন। অর্থনীতির সঙ্গে সামাজিক বিশ্বাসের যোগসূত্রটা ঠিক কী?

Advertisement

কৌশিক বসু: সামাজিক বিশ্বাস, এবং একটা সেন্স অব বিলঙ্গিং— এই বোধ, যে সমাজটায় আমি আছি, আমিও তার অংশ— অর্থনীতির স্বাস্থ্যের পক্ষে এই দুটো জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। মুশকিল হল, বিশ্বাসকে তো মাপা যায় না। রাজকোষ ঘাটতি বা টাকার জোগানের সঙ্গে আর্থিক বৃদ্ধির হারের সম্পর্ক অর্থনীতির তত্ত্ব ও যুক্তি দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু, বৃদ্ধির হারের ওপর সামাজিক বিশ্বাসের কী প্রভাব পড়ছে, সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে সরাসরি ধরা যাবে না। কিন্তু, সেই সম্পর্ক ধরা যায়। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা গোটা পৃথিবীর একটা বিপুল পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, যে সমাজে পারস্পরিক বিশ্বাস বেশি, সেখানে আর্থিক বৃদ্ধির হারও তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেশি। অন্য একটা গবেষণার ফল বলছে, আফ্রিকার দেশগুলোতে যদি স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর মতো সামাজিক বিশ্বাস থাকত, তবে সেখানে মাথাপিছু জিডিপি ছ’গুণ বেশি হত। হার্ভার্ড বিজ়নেস রিভিউয়ে খুব সম্প্রতি একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যাতে দেখানো হয়েছে যে কোনও সংস্থায় কর্মীরা যদি মনে করেন যে তাঁদের কদর আছে এবং তাঁরা সংস্থাটির অঙ্গ, তবে তাঁদের কাজে ৫৬% উন্নতি হয়, অসুস্থতাবাবদ ছুিটর সং‌খ্যা কমে ৭৫%। যে সংস্থায় কর্মিসংখ্যা দশ হাজার, সেখানে শুধু এই কারণেই বছরে পাঁচ কোটি ডলারের বেশি সাশ্রয় হয়। যেটা একটা সংস্থার জন্য প্রযোজ্য, সেটা গোটা দেশের জন্যও প্রযোজ্য।

ভারতের কথায় যদি আসি— আমাদের দেশে হরেক রকম বিভেদ চিরকালই ছিল, কিন্তু ১৯৪৭-এর পর থেকে ক্রমশ একটা বোধ তৈরি হচ্ছিল যে আমাদের সবাইকে মিলেমিশে এই দেশটাকে তৈরি করতে হবে। সেই বোধটাই আমাদের এই দেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে রেখেছিল। সাম্প্রতিক অতীতে, ২০০৩ থেকে ২০১১ অবধি ভারতে একটা অভাবনীয় আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছিল— গোটা দুনিয়ায় আলোচনা হচ্ছিল তা নিয়ে। এই সময়টাতে দেশে সামাজিক বিশ্বাসও বেড়েছিল বিপুল ভাবে। গত তিন-চার বছরে সেই বিশ্বাস একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

Advertisement

প্র: আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সামাজিক বিশ্বাসের এতখানি গুরুত্ব কেন?

উ: ধরো, আমি ব্যাঙ্ক থেকে বাড়ি তৈরি করার জন্য ঋণ নিচ্ছি। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের খুব একটা ভাবার দরকার নেই আমি ভাল লোক না খারাপ লোক— আমার ঋণ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য আছে, এটুকু জানতে পারলেই ব্যাঙ্ক আমায় টাকা দিয়ে দেবে। কারণ, সেই টাকাটা দেওয়া হবে একেবারে লিখিত চুক্তির ভিত্তিতে— আমি চুক্তি অমান্য করলে ব্যাঙ্ক আমায় আদালতে নিয়ে যেতে পারবে। বড় কর্পোরেট সংস্থার আর্থিক লেনদেন মূলত চুক্তিভিত্তিক হয়, ফলে সামাজিক বিশ্বাসের ওপর ততটা গুরুত্ব তাদের না দিলেও চলে। কিন্তু, এখানেও যদি কথায় কথায় আদালতে ছুটতে হয়, তা হলে ব্যবসার মস্ত অসুবিধা। ফলে, সামাজিক ভাবে যদি বিশ্বাসের পরিমাণ কমে যেতে থাকে, বড় ব্যবসা চালানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা হবে।

কিন্তু, এক বার চোখ বন্ধ করে ভাবো তো, আমরা জীবনে ক’টা জিনিস চুক্তি সই করে করি, আর কতগুলোর ক্ষেত্রে শুধু বিশ্বাসের ওপর চলি? আমার বাড়ি রং করার জন্য যখন আমি কাউকে নিয়োগ করি, হয় আমি তাঁকে কাজ শুরু করার আগেই একটা বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে দিই, অথবা তিনি কাজ শেষ করার পর আমার থেকে টাকা নেন— অর্থাৎ, দু’জনের মধ্যে এক জন অন্য জনকে বিশ্বাস করছেন যে টাকা নেওয়ার পরও তিনি কাজটা করবেন, বা কাজটা পেয়ে যাওয়ার পরও তিনি টাকাটা দেবেন। বাড়ি থেকে ট্যাক্সি চেপে হাওড়া স্টেশন যাওয়ার পর তো ট্যাক্সিচালককে ভাড়া দিই। অর্থাৎ, পুরো পথটা তিনি আমায় এই বিশ্বাস করে নিয়ে এলেন যে আমি তাঁকে ভাড়া না দিয়ে পালিয়ে যাব না। পাড়ার মুদিখানায় ধারে মাল বিক্রির কথাও ধরা যেতে পারে। একটু ভাবলেই দেখা যাবে, গোটা অসংগঠিত ক্ষেত্র দাঁড়িয়ে আছে বিশ্বাসের ওপর— এই বিশ্বাস যে উল্টো দিকের লোকটা ঠকাবে না। গোটা গ্রামীণ অর্থনীতি চলছে এই বিশ্বাসের ভরসায়। সেই সামাজিক বিশ্বাসটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে অনেক অর্থনৈতিক কাজই আর করা হবে না। কেউ ভরসা করে করতেই পারবেন না। ভারত কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ওপরই।

প্র: এই সামাজিক বিশ্বাসের সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক কোথায়?

উ: সামাজিক বিশ্বাস জিনিসটা তো স্বয়ম্ভু নয়, সেটা সমাজের থেকেই তৈরি হয়। আগে সামাজিক বিশ্বাসের প্রসঙ্গ এলেই স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কথা বলা হত। কিন্তু এখন পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে— জাপানে, দক্ষিণ কোরিয়ায়— সামাজিক বিশ্বাস অত্যন্ত বেশি। দেশের সরকার যদি কোনও একটা জনগোষ্ঠীকে সন্দেহের চোখে দেখে, তাদের সম্বন্ধে ক্রমাগত খারাপ কথা বলতে থাকে, তবে সামাজিক বিশ্বাসের ক্ষতি হবেই। ধর্ম, জাতি— যে কোনও পরিচিতিকে আক্রমণ করা থেকেই এটা হতে পারে। উত্তরপ্রদেশে সম্প্রতি যা চলছে, তার পর সেখানে কি সামাজিক বিশ্বাস থাকতে পারে? এটা সামাজিক ক্ষতি করে, সেটা বোঝা সহজ, কিন্তু এর অর্থনৈতিক বিপদের কথা মানুষ সহজে বুঝতে পারেন না।

আমি নিজেও সেটা নিয়ে খুব নিশ্চিত ছিলাম না। কিন্তু, গত এক-দু’বছরে ভারতীয় অর্থনীতির যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, সেটা অবিশ্বাস্য রকম খারাপ। নোটবন্দির ভুল সিদ্ধান্ত আর জিএসটি-র খারাপ ব্যবস্থাপনা— এই দুটো কথা মাথায় রেখেও বলছি, অবস্থা এতখানি খারাপ হওয়ার কথা ছিল না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গত শতকের ষাটের দশকের পর এত খারাপ অবস্থা কখনও হয়নি। এটা হয়েছে সামাজিক বিশ্বাসে ঘাটতির কারণেই। নোটবন্দির পরে আমি একটা হিসেব কষেছিলাম— তখন মনে হয়েছিল, এই সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের জাতীয় আয় দুই থেকে তিন শতাংশ-বিন্দু অবধি কমতে পারে। কমল তার চেয়েও বেশি। তার একটা কারণ, আমার হিসেবে একটা গোলমাল ছিল— নোটবন্দির ফলে কৃষকেরা সমস্যায় পড়লে তাঁরা যে ঋণ নেবেন, এবং সেটা শোধ করতে না পারার ফলে ঋণের দুষ্টচক্রে পড়ে যাবেন, যার ফলে গোটা গ্রামীণ অর্থনীতিতে আরও ক্ষতি হবে, এটা আমার হিসেবে ধরা ছিল না। এখানেও অবশ্য বিশ্বাসের ঘাটতির প্রশ্নটা আসে। ভারতে যদি সামাজিক বিশ্বাস এত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে না কমত, তবে গ্রামের মানুষ হয়তো ঋণ না নিয়েও, শুধু মুখের কথার ভরসাতেই, খানিকটা কাজ করিয়ে নিতে পারতেন। তাতে অর্থনীতির চাকা গড়াতে আরম্ভ করত। কিন্তু, সেটা হয়নি। কাজেই, এই হিসেবের বাইরে থাকা ক্ষতিটা মূলত বিশ্বাসের অভাবের ফলেই।

একটা কথা আমি আগেও বলেছি, আরও এক বার বলছি— দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই ভারত যে গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা আর ধর্মনিরপেক্ষতা, এই তিনটে জিনিসকে প্রভূত গুরুত্ব দিয়েছিল, সেটা ভারতের একটা মস্ত সম্পদ ছিল। সামাজিক বিশ্বাস তৈরির সম্পদ। তার সঙ্গে ২০০৩ থেকে ২০১১-র মধ্যে একটা আশ্চর্য রকম আর্থিক বৃদ্ধি ঘটেছিল— উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ভারত একেবারে স্বতন্ত্র ছিল একই সঙ্গে এই সামাজিক বিশ্বাস আর আর্থিক বৃদ্ধির কারণে। সেটাকে ধরে রাখা খুব জরুরি ছিল। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, ভারত তাতে ব্যর্থ হল।

প্র: আপনি বলছেন গণতন্ত্র আর বাক্‌স্বাধীনতার কথা। কিন্তু, এই দুটো থাকা মানেই আন্দোলন, প্রতিবাদ— মানে, মোটের ওপর কেঅস। বড় পুঁজি তো এই অস্থিরতা পছন্দ করে না। তারা এমন একটা দেশ চায়, যেখানে সাধারণ মানুষের ওপর সরকারের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। মোদী ঠিক যে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে চাইছেন। তা হলে, মোদীর দেশে কেউ লগ্নি করতে সাহস পাচ্ছেন না কেন?

উ: গণতন্ত্র নেই, সরকারের কড়া নিয়ন্ত্রণ আছে, এমন দেশে অর্থনীতি দ্রুত সমৃদ্ধ হয়েছে, এমন উদাহরণ যেমন আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি উদাহরণ আছে এই ঘটনার যে প্রবল রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের চাপে অর্থনীতি শেষ অবধি একেবারে ভেঙে পড়েছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ কঠোর হলে দুর্নীতি কমে, সেটা ঠিক— কিন্তু দেখা যায়, অর্থনীতিটা চলে গিয়েছে জনাকয়েক পুঁজিপতির হাতে। তাঁরা সবাই সরকারের অতি ঘনিষ্ঠ। সাঙাততন্ত্রের প্রবণতা সব বাজার অর্থনীতিতেই আছে। কিন্তু যেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রবল, সেখানে বাজারের দখল পুরোটাই চলে যায় এই সাঙাতদের হাতে। অন্য ব্যবসাগুলো অসহায় ভাবে মার খায়। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে ব্যবসায়িক সাফল্য যে শুধুমাত্র সেই একনায়কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পরিমাণের ওপরই নির্ভর করবে, এই কথাটা সব পুঁজিপতিই বুঝতে পারেন। এবং সেই কারণেই তাঁরা ভয় পান। আমি যেটুকু কথা বলেছি, তাতে মনে হয়েছে ভারতীয় বণিক মহলে এই ভয়টা খুব রকম রয়েছে যে শেষ অবধি পুরো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতে গোনা কয়েক জন ব্যবসায়ীর হাতে চলে যাবে।

প্র: রাহুল বজাজ যখন মোদী-শাহ জমানার বিরুদ্ধে মুখ খুললেন, তখন এক কিরণ মজুমদার শ’ বাদে আর কেউই তাঁর পাশে দাঁড়াননি। সেটা তো ভয়ের কারণেই, সরকারের প্রতি বিশ্বস্ততার জন্য তো নয়?

উ: একেবারেই। ইথিয়োপিয়ায় যখন হাইল সালাসির একনায়কতন্ত্র, তখন মনে হত যেন গোটা দেশ এক সুরে তাঁকে সমর্থন করছে। তার পর, যখন তাঁর শাসন ভেঙে পড়ল, মাসখানেকের মধ্যে দেখা গেল, তাঁর এক জন সমর্থকও অবশিষ্ট নেই। এই ধরনের ভয়ের শাসনে ঠিক এটাই হয়। স্বৈরতন্ত্রী শাসক ক্ষমতায় থাকার সময় যাঁরা সমর্থন করেন, তাঁদের অনেকেই আসলে নিজেদের যাবতীয় অসন্তোষ, ক্ষোভ চেপে রেখে সমর্থনের অভিনয় করতে থাকেন, যাতে শাসকের চক্ষুশূল না হতে হয়। এক বার শাসক ধাক্কা খেলেই এই সমর্থনের অভিনয়ের আর প্রয়োজন থাকে না।

প্র: একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। ভোগব্যয়ের যে পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় সরকার প্রকাশ করতে দিল না, তার যেটুকু ফাঁস হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ২০১১-১৮, এই সময়কালে গ্রামীণ ভারতে প্রকৃত ভোগব্যয় কমেছে প্রায় আট শতাংশ। অন্য দিকে, এই সাত বছরে আর্থিক বৃদ্ধি কমপক্ষে বছরে গড়ে ৫ শতাংশ হারে হয়েছে। তার মানে, বিপুল অসাম্য তৈরি হয়েছে। কেন?

উ: এটা একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। গ্রামীণ ভারতে ভোগব্যয় বৃদ্ধির পরিমাণ কখনও কখনও খুব কমে গিয়েছে বটে, কিন্তু ব্যয়ের পরিমাণ এতখানি হ্রাস বহু কাল হয়নি। আরও একটা পরিসংখ্যান আছে, যেটা বলছে যে ভোগব্যয় কমছে— গত ত্রিশ বছরে বিদ্যুৎ ব্যবহার বৃদ্ধির হার কখনও এত কম হয়নি। বিপুল অসাম্য তো বটেই। ক্রেডিট সুইসের হিসেব বলছে, ভারতে মাত্র এক শতাংশ লোকের হাতে দেশের ৫৩ শতাংশ সম্পদ রয়েছে। পুরো অর্থনীতিটা যখন খুব কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীন হয়, অল্প কয়েক জন লোক গোটা অর্থনীতিটাকে চালাতে থাকেন, তখন অসাম্য বাড়ে। পাশাপাশি এখন বেকারত্বের হারও গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ভারতে আর্থিক অসাম্য চিরকালই ছিল, এই কথাটা মনে রাখতেই হবে। কিন্তু, আগে আমরা বলতাম, ভারতে অসাম্য আছে, কিন্তু সেটা পাকিস্তানের মতো চরম নয়। আর্থিক অসাম্যের প্রশ্নে আমরা ক্রমশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছি।

প্র: ভারতীয় অর্থনীতি এখন যে বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব?

উ: ঘুরে দাঁড়ানো যে অসম্ভব, তা মনে করি না। দিনকয়েক আগেই পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বড় লগ্নির কথা ঘোষণা করল সরকার। অর্থনীতিতে মন্দা এলে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যয়— এটা তো একেবারে কেনসিয়ান প্রেসক্রিপশন। সত্যিই যদি সরকার টাকাটা ঠিক ভাবে খরচ করে, তা হলে অবস্থা ফিরতে পারে। কিন্তু, কী ভাবে খরচ করতে হবে, সেটা রাজনীতির প্রশ্ন নয়, অর্থনীতির প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের ঠিক উত্তর দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞ চাই। এই সরকারের নাগালে তেমন বিশেষজ্ঞের খুবই অভাব। পরিকাঠামো খাতে খরচ করলে তার লাভ পেতে পাঁচ-দশ বছর সময় লাগতে পারে। কিন্তু, বাজারে এই পরিমাণ টাকা ঢুকে গেলে মূল্যস্ফীতির হার চড়চড়িয়ে বাড়তে পারে। এখানেই বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন— এমন কেউ, যিনি বুঝবেন, কোথায় কী ভাবে খরচ করলে মূল্যস্ফীতির ওপর রাশ রাখা যাবে। তেমন বিশেষজ্ঞ না থাকলে আগামী দু’বছরে বিপদ আরও বাড়বে, সেই আশঙ্কা থাকছে।

কিন্তু, তার চেয়েও বড় আশঙ্কা হল, সামাজিক বিশ্বাসের মাত্রা যদি না বাড়ে, ভারতের অবস্থা পাকিস্তানের মতো হবে। ১৯৪৭ সালে যখন দেশভাগ হল, তখন আর্থিক ভাবে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান, তার পর ভারত, তার পর পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার সময়ও অবস্থাটা একই ছিল। অথচ, গত ১৮ বছর ধরে বাংলাদেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার পাকিস্তানের চেয়ে বেশি— গত বছর মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অঙ্কে পাকিস্তানকে টপকে গেল বাংলাদেশ। সেই সূচকে এখনও ভারতের থেকে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ, কিন্তু সেখানে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ভারতের চেয়ে তিন বছর বেশি। এত সম্পদ নিয়ে শুরু করেও পাকিস্তান পারল না, তার সবচেয়ে বড় কারণ সামাজিক বিশ্বাসের অভাব। এ রকম উদাহরণ ইতিহাসে অজস্র। একশো বছর আগে আর্জেন্টিনা দুনিয়ার ধনীতম দশটা দেশের অন্যতম ছিল। দারুণ হারে আর্থিক বৃদ্ধি হচ্ছিল। তার পরই সেখানে উগ্র জাতীয়তাবাদ আরম্ভ হল। পণ্য ও মানুষের জন্য সীমান্তে বাধানিষেধ আরোপিত হল। উচ্চশিক্ষাকে অবহেলা করল সরকার। আর্জেন্টিনার অর্থনীতিও পিছিয়ে পড়ল দৌড়ে। স্বাধীনতার পর ভারতের পথ খুব সহজ ছিল না। কিন্তু আমরা একটা সর্বজনীন, ধর্মনিরপেক্ষ, সহিষ্ণু দেশ তৈরি করছিলাম। অর্থনীতির বৃদ্ধির হারও ভাল হচ্ছিল। আমরা যদি এই পথ থেকে সরে যাই, যদি ব্যর্থ দেশগুলোকে অনুসরণ করতে থাকি, সেটা খুবই দুর্ভাগ্যের বিষয় হবে।

ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনীতিবিদ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক

সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement