— ফাইল চিত্র
প্রশ্ন: বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরেই নানা ঘটনা ঘটার পর ১৫ জুনের রক্তপাত। আপনি যাকে ‘ওয়াটারশেড মোমেন্ট’ বলেছেন। যদি একটু ব্যাখ্যা করেন।
নিরুপমা রাও: প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার লাদাখ সেক্টরের কিছু পকেটে মে মাসের গোড়া থেকেই অশনিসঙ্কেত পাওয়া যাচ্ছিল। বাষট্টির সংঘাতের পর থেকে গালওয়ান উপত্যকায় কোনও অশান্তির ঘটনার কথা শোনা যায়নি। কিন্তু ২০২০ সালের ১৫ জুন যা ঘটল, তা এক সঙ্গে অনেক কিছু বদলে দিল। প্রথমত, গত সাড়ে চার দশকে চিনের সঙ্গে ওই এলাকায় আমাদের সেনা কখনও কোনও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েনি। সেই সময়কালের অবসান ঘটল। দ্বিতীয়ত, সাম্প্রতিক ওই ঘটনা চিনের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে গুরুতর ছাপ ফেলল। আমার এখন চিনের যে শত্রুভাবাপন্ন এবং হিংস্র আগ্রাসী মুখ দেখতে পাচ্ছি, তা গত তিন দশকে তাদের সঙ্গে আমাদের গঠনমূলক সহযোগিতার ছবিটার তুলনায় অনেকটাই ভিন্ন।
প্র: চিনের সঙ্গে কি আগের মতো চলা সম্ভব হবে?
উ: এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহই নেই যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বড় ধাক্কা দিয়েছে ওই ঘটনা। কিন্তু এক রাতের মধ্যে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে বিচ্ছিন্ন হওয়া যায় না। আমাদের চিন-নীতির অবশ্যই পুর্নবিন্যাস প্রয়োজন। চিনের এই আগ্রাসন, সীমান্ত বিবাদ নিয়ে অনড় মানসিকতা, ভারত-বিরোধী নীতির মুখে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা কমানোর ফলাফল বিচার বিবেচনা করে দেখতে হবে; তার ফলে অভ্যন্তরীণ এবং বর্হিজগতে কতটা দাম দিতে হবে, সেটাও মেপে দেখতে হবে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে যে উত্তাপ তৈরি হয়েছে, তাকে কমানোর জন্য সামরিক এবং কূটনৈতিক স্তরে যোগাযোগ বজায় রাখাটা জরুরি।
পণ্যের ক্ষেত্রে চিন আমাদের অন্যতম বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। ফলে আমরা যদি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রদবদল করি, তা এমন ভাবে ভেবেচিন্তে করতে হবে যাতে আমাদের মুখ্য উৎপাদন শিল্পের সরবরাহে যেন কোনও সমস্যা না হয়। অন্যান্য দেশ থেকেও যেন জোগানের ব্যবস্থা থাকে। সে ক্ষেত্রেই চিনের উপর নির্ভরশীলতা কমানো যাবে। ভারতের পরিকাঠামো শিল্পে একশোরও বেশি চিনা সংস্থা জড়িত। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে আমাদের স্টার্ট-আপগুলিতে চিনের বিনিয়োগ অব্যাহত। এ ছাড়া বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল টাটা, ইনফোসিস, টিসিএস-এর মতো ভারতীয় সংস্থাগুলি চিনে ব্যবসা করছে। ফলে বিকল্প পথগুলিকে দ্রুত সাজাতে হবে, যাতে আমাদের আর্থিক স্বার্থকে কেউ নিশানা করতে না পারে।
প্র: চিনের এই পদক্ষেপের অনেক কারণ উঠে আসছে। আপনার কী মনে হয় ?
উ: আমার ধারণা এক নয়, অনেকগুলি বিষয় এখানে রয়েছে। চিন এমন একটি দেশ, যারা সীমান্তের দাবি এবং ভূখণ্ডের অধিকার নিয়ে ক্রমশ কট্টর অবস্থান নিচ্ছে। পূর্ব এবং দক্ষিণ চিন সাগরে আমরা এর প্রকাশ দেখেছি। আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রে সীমান্তের বেশ কয়েকটি পকেটে গত এক-দু’বছরে অনুপ্রবেশ ওরা বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার এ পারে আমাদের দিকে আইনসম্মত ভাবে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে চিনের বলার তো কিছু নেই। কিন্তু এ ব্যাপারে তাদের ব্যবহার সম্পূর্ণ যুক্তিহীন। গোটা অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য চিন সরকারের নীতি হল আগ্রাসী পদক্ষেপ করা। সমস্ত দেশেরই এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
প্র: চিন প্রসিদ্ধ তার ‘টু স্টেপ ফরওয়ার্ড ওয়ান স্টেপ ব্যাক’ নীতির জন্য। জমি না খুইয়ে কী ভাবে ভারতের পক্ষে সঙ্কটমোচন সম্ভব? ভারতের কাছে কি দরকষাকষি করার মতো কোনও তাস রয়েছে?
উ: তাস থাকলেও সেটা প্রকাশ্যে টেবিলের উপর ফেলা তো ঠিক নয়। কোনও সরকারই সেটা করে না। তবে ধরে নেওয়া যায় যে সব সরকারই দেশের স্বার্থের দিকে নজর রাখবে। বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচিত সরকার এই বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে সচেতন থাকে। খুব সহজে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটা আশা করা যায় না। এ সব ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে আবেগদৃপ্ত বক্তৃতায় উল্টো ফল হতে পারে।
প্র: জম্মু ও কাশ্মীর থেকে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করার সঙ্গে চিনের এই আচরণের কি কোনও সংযোগ রয়েছে?
উ: আমাদের সরকার যখন এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, তখন তার কিছু অংশ নিয়ে চিন প্রতিবাদ জানিয়েছিল। এটা তাদের একটি বিরোধিতার ক্ষেত্র। তবে ২০১৯ সালের অগস্টের সেই ঘোষিত সিদ্ধান্তের কারণেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় এই পরিস্থিতি তৈরি হল, এ ভাবে দেখাটা ঠিক নয়।
প্র: গালওয়ান সীমান্তের পাশাপাশি হঠাৎই নেপালের সঙ্গেও সীমান্ত নিয়ে সমস্যা শুরু হয়েছে। কী ভাবে দেখছেন?
উ: ঐতিহাসিক ভাবেই নেপালের সঙ্গে আমাদের খোলা সীমান্ত। উত্তরাখণ্ড-নেপাল সীমান্তে কালাপানি এলাকা নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। এর পূর্ব ইতিহাস রয়েছে— স্বাধীনতার আগেই তার সূত্রপাত। এই এলাকায় ভারত এবং নেপাল, দু’দেশের সীমান্ত সম্পর্কে মূল্যায়ন এবং ধারণা দু’রকম। বিগত কয়েক দশকে ভারত এবং নেপালের কূটনীতিকদের মধ্যে এই নিয়ে কথাবার্তাও হয়েছে।
ভারত-নেপাল সীমান্তের বেশির ভাগ সেক্টর নিয়েই দু’দেশের কূটনৈতিক স্তরে ঐকমত্য রয়েছে। কালাপানি নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা রয়েছে। গত বছর স্থির হয়েছিল, টেকনিক্যাল গ্রুপ সমাধানে ব্যর্থ হওয়ার পর দু’দেশের বিদেশসচিব পর্যায়ে এ বার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু সম্প্রতি নেপাল সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত এই বিতর্ককে নজিরবিহীন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। মিডিয়া রিপোর্টে এটাও দেখছি যে নেপালি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদী বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে।
সাম্প্রতিক এই ঘটনাবলি নিয়ে ভারত এবং নেপালের উচিত শীঘ্র রাজনৈতিক স্তরে বিষয়টিকে নিয়ে যাওয়া। যাতে দু’তরফের সন্তোষজনক সমাধান পাওয়া যায়। প্রশ্নটাকে বিপজ্জনক ঢাল অবধি গড়াতে দিলে ভুল হবে। চিন বিরাট শক্তিধর হয়ে উঠেছে এবং নেপালের ভিতরেও তার প্রভাব বাড়িয়ে তুলেছে। এটা অবশ্যই একটা নতুন দিক যা বর্তমান সমস্যাকে জটিল করেছে। ভারত-নেপাল সম্পর্কে ইতিবাচক ভারসাম্য অবশ্যই ফিরিয়ে আনতে হবে। আমার মতে, বৃহত্তর দেশ হিসাবে ভারতের উচিত তার ভ্রাতৃসম প্রতিবেশী সম্পর্কে পরিণত, সুচিন্তিত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা, দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা নেপালের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের দিকটিকে বজায় রাখা। দু’তরফেরই উচিত পরস্পরের দিকে বাক্যবাণ না দেগে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানসূত্র খোঁজা।
ভূতপূর্ব বিদেশসচিব, ভারত সরকার
সাক্ষাৎকার: অগ্নি রায়